রাজধানীতে নানা আয়োজনে পালিত হলো পবিত্র আশুরা
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২৩, ০৪:৩৫ পিএম
শনিবার ১০ মহররম পবিত্র আশুরা। যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দেশে পবিত্র আশুরা পালিত হয়েছে।
সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম হজরত ইমাম হোসেন (রা.), তার পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠ সহচরবৃন্দ বিশ্বাসঘাতক ইয়াজিদের সৈন্যদের হাতে কারবালার প্রান্তরে শহীদ হন। সেসময় থেকে কারবালার এ বিয়োগাত্মক ঘটনাকে স্মরণ করে ত্যাগ ও শোকের প্রতীক হিসেবে প্রতিবছর দিবসটি পালন করা হয়। বিশ্বজুড়ে ত্যাগ আর শোকের মহিমায় দিবসটি যুগযুগ ধরে পালন করা হচ্ছে।
ঢাকায় শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় শিয়া সম্প্রদায়ের উদ্যোগে লালবাগের হোসেনি দালান ইমামবাড়া থেকে আশুরার তাজিয়া মিছিল বের হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন হোসেনি দালানের সুপারিন্টেডেন্ট এম এম ফিরোজ হোসাইন এবং হোসেনি দালানের সদস্য সৈয়দ বাকির হোসাইন মাজলুম। আশুরার শোক মিছিল উপলক্ষে সকাল থেকে পুরান ঢাকার ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা হোসেনি দালানে জড়ো হন। তাজিয়া মিছিলে যুবক, বৃদ্ধ, শিশুসহ সব বয়সের নারী-পুরুষের সরব উপস্থিতি ছিল।
হোসেনি দালান ইমামবাড়া ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাজিয়া মিছিল ঘিরে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
পবিত্র আশুরা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির তার বাণীতে বলেন,পবিত্র আশুরার মহান শিক্ষা আমাদের সবার জীবনে প্রতিফলিত হোক। কারবালার শোকাবহ ঘটনার স্মৃতিতে ভাস্বর পবিত্র আশুরার শাশ্বত বাণী আমাদের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে উদ্বুদ্ধ করে, প্রেরণা যোগায় সত্য ও সুন্দরের পথে চলার। তিনি আরও বলেন, আমি হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসেনসহ (রা.) কারবালা প্রান্তরে শাহাদাত বরণকারী সব শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
পবিত্র আশুরা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য এক তাৎপর্যময় ও শোকের দিন। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম হজরত ইমাম হোসেন (রা.), তার পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠ সহচরবৃন্দ বিশ্বাসঘাতক ইয়াজিদের সৈন্যদের হাতে কারবালার প্রান্তরে শহীদ হন। রাষ্ট্রপতি বলেন, ইসলাম শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম। সব ধর্মই হানাহানি, হিংসা, দ্বেষ বা বিভেদ ভুলে মানুষকে শান্তির পথে আহ্বান করে। পবিত্র আশুরার এ দিনে আমি সাম্য, ন্যায়ভিত্তিক ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি ও অব্যাহত অগ্রগতি কামনা করি।
প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেন,পবিত্র আশুরা অত্যন্ত শোকাবহ, তাৎপর্যপূর্ণ মহিমান্বিত একটি দিন। বিভিন্ন কারণে দিনটি বিশ্বের মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, পবিত্র ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ। পবিত্র আশুরার মর্মবাণী অন্তরে ধারণ করে জাতীয় জীবনে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনকল্যাণমুখী কাজে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আরও বলেন, আসুন পবিত্র আশুরার মর্মবাণী অন্তরে ধারণ করে জনকল্যাণমুখী কাজে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের বৈষম্যহীন, সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সোনার বাংলা তথা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন,আল্লাহ বিপদে মানুষের ধৈর্য পরীক্ষা করেন। এসময় সবাইকে অসীম ধৈর্য নিয়ে সহনশীল ও সহানুভূতিশীল মনে একে অন্যকে সাহায্য করে যেতে হবে। ডেঙ্গু সচেতনতার পাশাপাশি তিনি এই মহামারিতে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পবিত্র আশুরা পালন করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আল্লাহ তায়ালার দরবারে বিশেষ দোয়া করি যেন এই সংক্রমণ থেকে সবাই দ্রুত মুক্তি পাই।
আশুরা উপলক্ষে শনিবার ছিল সরকারি ছুটি। ইসলামের মহান আদর্শকে সমুন্নত রাখতে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) এর আত্মত্যাগ মানবতার ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। কারবালার শোকাবহ ঘটনা মানবজাতিকে অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে এবং সত্য ও সুন্দরের পথে চলতে যুগে যুগে প্রেরণা জোগাচ্ছে। অন্যান্য বছরের মতো এবারও তাজিয়া মিছিলে হাজারো নারী-পুরুষ ও শিশুর সমাগম হয়েছে। তাদের হাতে ছিল লাল-কালো আর সবুজ অক্ষর খচিত নিশান। তারা খালি পায়ে মিছিলে অংশ নেন। মিছিল থেকে হায় হোসেন, হায় হোসেন মাতমে শোকের আবহ ছড়িয়ে ঢাকার বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করেন।
তাজিয়া মিছিল ঘিরে রাজধানীতে নিরাপত্তা জোরদার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সতর্ক অবস্থানে ছিল থাকবে পুলিশ-র্যাব। তাজিয়া মিছিলে নিরাপত্তা নিশ্চিত ও চলাচল নির্বিঘ্ন করতে তাজিয়া মিছিলে দা, ছুরি, কাঁচি, বর্শা, বল্লম, তরবারি, লাঠি ইত্যাদি বহন এবং আঁতশবাজি ও পটকা ফোটানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
এদিকে আশুরার নানা আয়োজন হোসেনি দালান ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি স্থানে অনুষ্ঠিত হয়। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মিরপুর, বকশিবাজার, লালবাগ, ফরাশগঞ্জ, পল্টন, মগবাজার থেকেও তাজিয়া মিছিল বের হয়।। অনেকেই হোসেনি দালানে রওজা জিয়ারত করেন। হোসেনি দালান সুপারিনটেন্ডেট বলেন ১০ মহররম ইমাম হোসেন (রা.) এর প্রতি শোক জানাতে শত শত বছর ধরে তাজিয়া মিছিল বের করে আসছে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন।
পুরান ঢাকার লালবাগের হোসেনি দালান ইমামবাড়া, বড় কাটারা ইমামবাড়া ও এর আশেপাশের শিয়া সম্প্রদায়কেন্দ্রিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও ঐতিহ্যবাহী তাজিয়া মিছিল ঘিরে নেওয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা।
কাউকে ব্যাগ বা অপ্রয়োজনী জিনিসপত্র নিয়ে ওই এলাকায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। নিরাপত্তা জোরদারে কাজ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) বিভিন্ন ইউনিট। সতর্ক অবস্থানে ছিল র্যাব ও সোয়াট সদস্যরাও। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে পুলিশ ও গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মিরপুর, বকশিবাজার, লালবাগ, ফরাশগঞ্জ, পল্টন, মগবাজার থেকেও তাজিয়া মিছিল বের হয়। এর মধ্যে হোসনি দালান থেকে সবচেয়ে বড় মিছিল বের হয়। লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. জাফর হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ১ মহররম থেকে আমাদের পুলিশের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। আজ ১০ মহররম আশুরার মিছিলকে কেন্দ্র করে আটশোর বেশি পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া সোয়াট ও র্যাবসহ পুলিশের বিভিন্ন স্তরে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কাজ করছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর পুরান ঢাকার হোসেনি দালানে পবিত্র আশুরার তাজিয়া মিছিল প্রস্তুতির সময় বোমা হামলায় দুজন নিহত ও শতাধিক আহত হয়। ওই হামলার পর থেকে প্রতিবছর আশুরার সময় সর্বোচ্চ সতর্কতা নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এবারও আশুরাকে কেন্দ্র করে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। দুপুরে হোসেনি দালানে সাধারণ মানুষের মাঝে খিছুড়ি ও পানি বিতরণ করা হয়েছে।