ছাত্র-জনতার কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা ডিউক হুদার
হাসিনা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত খুনি, আ.লীগ নিষিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার অবস্থান চলবে

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:০৭ পিএম

গণহত্যাকারী ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন ছাত্র-জনতা। রোববার থেকে শুরু হওয়া এ কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন মেজর বজলুল হুদার ছোট ভাই ডিউক হুদা।
এর আগে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে রাজু ভাস্কর্যে আমরণ অনশন শুরু করেন ছাত্রদল নেতা মো. ওমর ফারুক ও আবু সাঈদ। এরপর গত শনিবার এ অনশনে যোগ দেয় আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে সোচ্চার ছাত্র সংগঠন বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের নেতাকর্মীরা। তবে রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় জুলাই বিপ্লবের শহিদ রানা তালুকদারের পরিবারের আহ্বানে আমরণ অনশন ভেঙে এ অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়।
সোমবার রাজু ভাস্কর্যে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি থেকে ডিউক হুদা সাংবাদিকদের বলেন, আমি আজ এখানে এসেছি বিপ্লবী ছাত্র-জনতার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে। বিপ্লবের ছয় মাস পার হলেও এখনো ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সন্ত্রাসী ও গণহত্যাকারীরা বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছেন। তাদের নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।
তিনি বলেন, রাজু ভাস্কর্যে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ভাইয়েরা আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধের দাবিতে অবস্থান নিয়েছেন। ফ্যাসিস্ট এই দল নিষিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলবে।
ডিউক হুদা আরও বলেন, আওয়ামী লীগ কুখ্যাত সন্ত্রাসী দল, তারা স্বৈরশাসন কায়েম করেছিল। এজন্য শেখ হাসিনাকে আন্তর্জাতিকভাবে খুনি ও স্বৈরশাসক হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করা হয়েছে; কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এখনো আমরা জাতীয়ভাবে তাকে নিষিদ্ধ করতে পারি নাই।
‘আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। এখন তারা গণবিরোধী ও গণহত্যাকারী একটি কুচক্রী দল। তাই আমি আপনাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে অতি দ্রুত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছি।'
জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে প্রতিটি উপজেলায় ল’ সেল গঠনের আহ্বান জানান ডিউক হুদা। তিনি বলেন, আওয়ামী দোসররা যে অন্যায় অবিচার ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, সেসব অভিযোগ গ্রহণের জন্য এই সেল গঠন করা প্রয়োজন; যাতে ভিকটিমরা অভিযোগ করতে পারেন। অভিযোগগুলো বিবেচনায় নিয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে গ্রেফতার করে অবিলম্বে বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
মেজর বজলুল হুদার ছোট ভাই আরও বলেন, এখনো আমাদের শহিদের লাশ দেখতে হচ্ছে। কয়েক দিন আগেও একজন শহিদ ভাইয়ের লাশ মর্গ থেকে বের করা হয়েছে। না জানি আর কত লাশের বোঝা আমাদের বহন করতে হবে। আমরা ভারাক্রান্ত হয়ে বসে আছি, লাশের বোঝা যেন শেষ হয়ে গহত্যাকারীদের বিচার করার মধ্য দিয়ে হলেও আমরা কিছুটা ঋণমুক্ত হই।
তিনি বলেন, শহিদরা নিজের জীবন দিয়ে এই নতুন বাংলাদেশ দিয়েছেন। আমাদের নতুনভাবে বেঁচে থাকার, লড়াই করার, নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য জীবন দিয়ে গেছেন। তাদের কারণেই আমরা আজ মুক্ত বাতাসে নি:শ্বাস নিতে পারছি; কিন্তু এখনো নি:শ্বাসে গন্ধ আছে। আওয়ামী লীগের বিষাক্ত নি:শ্বাসে এখনো বাংলাদেশ ভারি হয়ে আছে। আমাদের এখন ভারমুক্ত হতে হবে।
ডিউক হুদা বলেন, আমি একজন শহিদ পরিবারের সন্তান। আমার ভাই ১৫ আগস্ট বিপ্লবের অন্যতম নায়ক মেজর বজলুল হুদা। তাকে খুনি শেখ হাসিনা জেলখানায় ঢুকে নিজ হাতে জবাই করে হত্যা করেছে। আমার ভাগ্নিকে (বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল আব্দুল আজিজ পাশার মেয়ে) গাড়িচাপা দিয়ে হত্যা করে হাসিনা তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছে। আমাদের ঘরবাড়ি ভেঙে লুটতরাজ করে আমার মাকে আশ্রয়হীন করে মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করেছে। ১৫ আগস্টের আরেক নায়ক আমার ভগিনীপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল আব্দুল আজিজ পাশাকে মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করেছে। আমার ভাইয়ের কবর পর্যন্ত ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে তারা।
সুশীলদের উদ্দেশে তিনি বলেন, যখন আমার মতো লাখো লাখো মানুষের ওপর জুলুম নির্যাতন করেছে, ঘর-বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, খুনের পর খুন করা হয়েছে, তখন আপনারা কোথায় ছিলেন। তখন তো আপনারা মুখে তালা দিয়ে রেখেছিলেন। এখন মুখ খুলেছেন। শহিদদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আপনারা মুখ খুলেছেন; কিন্তু মুখটা সঠিক পথে পরিচালিত করুন। না হলে আপনাদের মুখও বন্ধ করে দেওয়া হবে, ঠিক যেভাবে শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের বিতাড়িত করা হয়েছে।
‘আমার মতো লাখো লাখো মানুষ নির্যাতিত হয়েছেন। এখনো কেন আমার ভাইয়ের বিচার চাইতে হবে। কেন আমার মায়ের বিচার চাইতে হবে, কেন আমার ভাগ্নি হত্যার বিচার চাইতে হবে, কেন আমার ভগিনীপতি হত্যার বিচার চাইতে হবে। কেন হাজার হাজার ছাত্র-জনতা, মা-বোন-ভাইদের হত্যার বিচার চাইতে হবে। এখন তো আমরা মুক্ত পরিবেশ আছি। খুনিদের কেন এখনো বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না।'
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, দেশ গড়া ও সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে খুনিদেরও বিচার করতে হবে। সারা দেশের থানা, প্রশাসনসহ প্রতিটি সেক্টরে একটি করে ল’ সেল গঠন করে আওয়ামী লীগের ক্রিমিনাল, দোসর, আওয়ামী লীগের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শকারী ও সুশীলদের ধরে বিচারের মাধ্যমে তাদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে।
এ সময় আক্ষেপ করে ডিউক হুদা বলেন, আমার পরিবারের লোকদের হত্যা ও জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইতে অনেক উপদেষ্টার কাছে গিয়েছি; কিন্তু কোনো জায়গা থেকে কোনো সমাধান পাইনি। আমি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গিয়েছি। সেখান থেকে বলা হয়েছে- এখানে শুধু মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা হয়। আপনি জজ কোর্টে যান। আমি বলেছি- শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ যে অপরাধ করেছে তা মানবতাবিরোধী অপরাধ। এখানেই তাদের মামলা নিতে হবে; কিন্তু বারবার কিছু মানুষ বিচারকে প্রলম্বিত করে দিচ্ছে। এর ফলে আমরা সব জায়গা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
জুলাই-আগস্টে শহিদ ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করে পুস্তক আকারে প্রকাশ করার আহ্বানও জানান তিনি। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের অপসারণ দাবি করেন তিনি। ক্ষোভ প্রকাশ করে ডিউক হুদা বলেন, এখনো পর্যন্ত দুর্নীতিবাজ, খুনির দোসর সাহাবুদ্দিন চুপ্পু কিভাবে রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকে। অতি দ্রুত তাকে অপসারণ করতে হবে।

বর্তমান সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, যে বাহাত্তরের সংবিধান মানুষের অধিকারকে সমুন্নত করেনি, অত্যাচার, নিপীড়ন ও স্বৈরাচারের বাহক হয়ে এ দেশের মানুষকে নিপীড়িত করা হয়েছে, নিষ্পেষিত করা হয়েছে- সেই সংবিধান চাই না। আমরা এমন সংবিধান চাই যেটা একটি স্বাধীন দেশ ও জাতির জন্য প্রয়োজন। ব্রিটিশ শাসনতন্ত্র যে সংবিধান রচনা করেছিল, সেটা করেছিল এ দেশের মানুষকে শোষণ, শাসন ও নিপীড়ন করার জন্য। এখনো পর্যন্ত ব্রিটিশের সেই শাসন শোষণ ও নিপীড়ন অব্যাহত আছে। সমস্ত ব্রিটিশ ঔপনেবিশক শাসন ব্যবস্থাকে ভূলুণ্ঠিত করে, মুছে দিয়ে নতুন স্বাধীন জাতির জন্য সংবিধান রচনা করতে হবে এবং সত্যিকারের স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণের ব্যবস্থা করার মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার সফলতা আসবে ইনশাআল্লাহ।
শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলের বর্ণনা করে ডিউক হুদা আরও বলেন, আওয়ামী স্বৈরাচাররা বারবার এ দেশে নির্যাতন চালিয়েছে। ৭২-৭৫ পর্যন্ত স্বৈরাচারী খুনি শেখ মুজিব এ দেশের মানুষের ওপর নির্যাতন ও অত্যাচার করেছিল। একদলীয় স্বৈরশাসন, বাকশাল কায়েম ও রক্ষী বাহিনী গঠনের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ, তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। এ সময়ে ৩৭ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছিল। স্বৈরশাসক শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের মাধ্যমে অত্যাচার করার পর বাকশাল গঠন করে অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।
‘কিন্তু ১৫ আগস্ট এই নায়কেরা; যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন তারা এই বাকশাল পদ্ধতির উৎখাত করে শেখ মুজিবের আস্ফালনকে বন্ধ করে দিয়ে এ দেশের মানুষকে বাঁচিয়েছিলিন এবং গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে শেখ হাসিনা দেশের মানুষের অনুকম্পা নিয়ে ক্ষমতায় এসে এই নায়কদের নৃশংশভাবে হত্যা করেছে। জেলখানায় হত্যা করেছে, নির্বাসিত করেছে।'
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ১৫ আগস্ট বিপ্লবীদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, নির্বাসিত করা হয়েছে, আমরাও যারা ২৪-এর জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে অংশ নিয়েছিলাম, আওয়ামী লীগ যদি পুনর্বাসনের সুযোগ পায় তাহলে আমাদেরও ১৫ আগস্টের বিপ্লবীদের মতো করবে।
দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে ডিউক হুদা বলেন, অতীত থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। আমরা কোনো অবস্থাতেই এর পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেব না। ১৫ আগস্টের বিপ্লবীদের যেভাবে হত্যা করেছে, জুলুম নিপীড়ন চালিয়েছে, তাদের সেই সুযোগ আর দেব না। আমরা ১৫ আগস্টের বীরদের জাতীয় বীর ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি এবং তাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দানের দাবি জানাচ্ছি। একই সঙ্গে যারা ২৪-এর বিপ্লবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন তাদেরও সমভাবে মর্যাদা দেওয়া হোক। আর যে ফ্যাসিস্ট আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেছিল সেই আওয়ামী লীগকে অতি দ্রুত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক। শুধু নিবন্ধন বাতিল নয়, তাদের পরিপূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ও গ্রেফতার করে দ্রুতবিচার আদালতের মাধ্যমে বিচার করা হোক।
মেজর বজলুল হুদা ছিলেন মেহেরপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডে উচ্চ আদালতের আদেশে ১৪ বছর আগে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি রাতে ফাঁসি কার্যকর হয় তার।
কিন্তু স্বৈরশাসক হাসিনার পতনের পর নিকটাত্মীয় ও এলাকাবাসী জানান, মেজর বজলুল হুদাকে ফাঁসিতে নয়, গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। নিরাপত্তার অভাবে বজলুল হুদার গলা কাটার তথ্য গোপন করে রেখেছিল পরিবার ও এলাকাবাসী। চলতি বছরের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতন হলে মুখ খুলতে শুরু করেছেন তারা।