Logo
Logo
×

শিক্ষাঙ্গন

আমার স্বপ্নযাত্রায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

ফারিহা জেসমিন ইসলাম

ফারিহা জেসমিন ইসলাম

প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২০ এএম

আমার স্বপ্নযাত্রায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

২০০৫-এর শেষের দিক। ডিসেম্বর মাস। তারিখটা ঠিক মনে পড়ছে না। 

বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে গেছে, আমি একটা দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষমাণ। দাঁড়িয়ে আছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের নিচতলায়। আজ আমাদের ভর্তির সাক্ষাৎকার হবার কথা। এই বছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমিও একজন। ডি ইউনিট মেধা তালিকায় আমার স্থান ৩৪। 

আমাদের লাইনে আরও অনেকেই অপেক্ষমাণ। আমার সামনের মেয়েটির ছোট্ট নাম নিতু। মিনিট পাঁচেক আগেই তার সঙ্গে হাই-হ্যালো হয়েছে। সে বলল, সে ঢাকা থেকে এসেছে, কলেজ- হলিক্রস। তার সঙ্গে তার বাবা এসেছেন। আর আমার সঙ্গে আমার কয়েকজন কাজিন, যাদের সবাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ছে। 

নিতু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে পড়তে চায়। ইউনিক সাবজেক্ট, দারুণ ব্রাইট ফিউচার। আমার একটু মন কেমন করল। বললাম আমি তো আইআর পাব না। মাত্র প্রথম দশ-পনের জন পাবে। আমি অর্থনীতি চয়েস দেবো। বাসা থেকে ভাইভা তে যাবার আগে আসলে এমনটাই বলে দেওয়া হয়েছিল আমাকে।

ঘণ্টা না পেরুতেই আমার সিরিয়াল আসল। আমি কলম ছাড়াই ভেতরে প্রবেশ করলাম ভয়ে ভয়ে। অসাবধানতাবশত কলম নাই ব্যাগে। আমাকে একজন মাঝ বয়সি অধ্যাপক (যেহেতু চিনি না কাউকেই) শান্ত এবং স্নিগ্ধ হাসিতে সম্ভাষণ জানালেন। আমি বসলাম চেয়ারে। সামনে বেশ চার-পাঁচজন গুরু-গম্ভীর প্রফেসর বসা। আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো- আমি কি পড়তে চাই। আমি ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলাম অর্থনীতি। শান্ত হেসে যিনি সম্ভাষণ জানিয়েছিলেন তিনি বললেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কেন নয়? আমি বললাম আমি তো পাব না তাই। 

যদি পাও? তাহলে? 

আমি পড়তে চাই– আমার সলজ্জ উত্তর। এরপর আমার হাতে একটা কাগজ দেওয়া হলো এবং আমার একটা স্বাক্ষর নেওয়া হলো। আমি বাইরে এসে কাগজটি খুলে দেখলাম আমাকে অনুমতি দেওয়া একটা চিঠি, যাতে লেখা আছে– ফারিহা জেসমিনকে নিয়ম মোতাবেক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ভর্তির জন্য সুপারিশ করা হলো। সেই স্নিগ্ধ হাসির প্রফেসর ছিলেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সভাপতি ডক্টর এম ইমদাদুল হক। চিঠিটা এখনও সযত্নে রাখা আছে। 

ব্যস, আমার হলো শুরু। তবে মূল যাত্রা অর্থাৎ বিভাগের যাত্রা এরও এক বছর আগে। ২০০৪ সালের আজকের দিনে। ২০০৪ সালের ২৫ নভেম্বর এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছিল। ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদে একটি স্বতন্ত্র অ্যাকাডেমিক ডিসিপ্লিন হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের উত্থান হয়। প্রথিতযশা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ডক্টর এম ইমদাদুল হক প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে যোগদান করেন। কেবল একজন স্টাফ নিয়ে ২০০৪ সালে আনকোরা বিভাগটির পথচলা শুরু হলেও কহরটটি আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে এবং পরের বছর তিনজন শিক্ষক বিভাগে যোগ দেন। 

২০০৫ সালে ১১ জন শিক্ষার্থী দিয়ে প্রথম বর্ষের (সম্মান) পাঠদান আরম্ভ হয় একটি দুই রুমের টিন শেড ভবনে। ওই বড় দুটি কক্ষ থেকে ব্যবস্থা করা হলো আয়তনে খুবই ছোট একটি সভাপতির কক্ষ, দুটি শিক্ষক কক্ষ এবং দুটি ক্লাস রুম এবং স্টাফদের একটা বসার ঘর। 

এই ছিল এই ভবনের পূর্ণ ধারণ ক্ষমতা। সেখানে ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে আমরা আরও ১৮ জনের মতো নতুন শিক্ষার্থী যুক্ত হই। সমাজবিজ্ঞান অনুষদের একপাশে অবস্থিত টিনশেড ভবনটি আমাদের সাদরে গ্রহণ করে নেয় এবং ৬ মার্চ ২০০৬ তারিখ থেকে আমাদের পূর্ণ শিক্ষাগ্রহণ শুরু হলে আমরা আরও কিছু সহপাঠী পেলাম আমাদের সঙ্গে। সর্বমোট আমাদের সংখ্যা দাঁড়ালো ৩৮-এ। 

শিক্ষার্থী সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আমাদের পাঠদান কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হতে লাগল। কারণ ক্লাসরুমের ধারণ ক্ষমতা ছিল খুবই স্বল্প। 

তবে আনন্দের ব্যাপার হলো খুব তাড়াতাড়ি আমরা অনুষদের নিচতলায় দুটি রুমে ক্লাস শুরু করলাম। ততদিনে আমরা নেগোসিয়েশন কি বা কিভাবে করে সেটা না শিখলেও অফিসিয়াল নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে লোকপ্রশাসন বিভাগের দুটি কক্ষ আমাদের ক্লাস করার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেটা বুঝতে কারও অসুবিধা হলো না। 

একটি রুমে একদিন নতুন শিক্ষার্থীদের জন্য একটা পরিচিতি সভা বা ফ্রেসার রিসিপশনের আয়োজন করা হলো বিভাগের পক্ষ থেকে। সেখানে নতুন শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে আমি মঞ্চে দাঁড়িয়ে মাইক হাতে নিলাম। সবাই প্রশংসা করে বলেছিল অনবদ্য বক্তৃতা করেছিলাম সেদিন।  

বলা শ্রেয় যে, ইতোমধ্যে নিতু, যার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সাবজেক্টে পড়ার কথা ছিল, সে বিস্ময়করভাবে অর্থনীতিতে ভর্তি হয়েছে এবং তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবার। আমি হাসিমুখে আইআর-এ ক্লাস করছি জানিয়ে তৃপ্তই হয়েছি বৈকি। 

এর মধ্যে বিভাগ বড় হতে শুরু করেছে, লোকবলও বেড়েছে। আমাদের শ্রদ্ধেয় কামাল উদ্দিন স্যারসহ (বর্তমান উপ-উপাচার্য, প্রশাসন) আরও দুজন শিক্ষক বিভাগে যোগ দিয়েছেন। ২০০৭ সালে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে প্রথম বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষায় প্রথম স্থান নিয়ে পাশ করে গেলাম। যে আমি আইআর পাব না বলে মনে মনে একটা নীরব কষ্টে কাতর ছিলাম, সেই আমি ২০১০ সালে অনার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হলাম। অবশেষে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়ে ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে মাস্টার অফ সোশ্যাল সায়েন্স (এমএসএস) ডিগ্রি পেলাম।

দেখতে দেখতে অনেক দিন পার হয়ে যায়। আমাদের বিভাগ থেকে আমাদের সঙ্গে এবং আগে অত্যন্ত ভালো রেজাল্ট করা কয়েকজন শিক্ষার্থী বিভাগে শিক্ষক হয়ে যোগদান করে, যা বিভাগের জন্য অবশ্যই একটি গৌরবের বিষয়। অপেক্ষার প্রহর শেষ হলে ২০১৪ সালে আমিও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করি। মনের মাঝে উঁকি দেয়, নিতুসহ সেই দীর্ঘ লাইনে অর্থনীতি নিতে অপেক্ষা করার স্মৃতি। 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ এভাবেই জীবনকে দিয়েছে পূর্ণতা, দিয়েছে পরিচয়। সেই সঙ্গে এও বলতে চাই যে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়- আমার শিক্ষালয়, আমার জ্ঞান সাধনার তীর্থ। এখানেই স্মৃতি, এখানেই বসতি। এখানেই জীবন, এখানেই জীবিকা। শিক্ষা দিয়েছ, দিয়েছ পরিচয়। তোমার কাছে আমি চিরঋণী।  সমৃদ্ধ ও উন্নত আগামীর মিছিলে তোমার সঙ্গে থাকার অঙ্গীকার।

দিন যায়, বিভাগের পুরানো কাঠামোতে পরিবর্তন আসতে থাকে। আমাদের বিভাগকে আজ আর অস্তিত্ব রক্ষা করার স্ট্রাগল করতে হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠার বিশ বছর পর, এখন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ একটি অত্যন্ত মানসম্মত জ্ঞান উৎপাদন, বিতরণ এবং সংরক্ষণ কেন্দ্র বললে বাহুল্য হয় না। 

সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ষষ্ঠ তলায় একটি সম্পূর্ণ নিজস্ব অ্যাকাডেমিক প্রেমিসেস, লাইব্রেরি, ক্লাসরুম, টিচারস রুম এবং অন্যান্য সবদিক থেকে আইআর একটি পরিপূর্ণ বিভাগ। ১৮ জন পূর্ণকালীন শিক্ষক নিয়ে এক দক্ষ অ্যাকাডেমিক টিম এই বিভাগকে করেছে অত্যন্ত সফল এবং গৌরবমণ্ডিত। তাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন দেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এসে বিভাগকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং অ্যাকাডেমিক মানকে আরও উন্নত করেছেন। 

বর্তমানে স্বনামধন্য এই বিভাগে বিএসএস (সম্মান), এমএসএস ছাড়াও চালু রয়েছে এমফিল, পিএইচডি। এই বিভাগ ছাড়াও অন্যান্য জায়গা থেকে এসে এখানে এমফিল এবং পিএইচডি করছেন বহু জ্ঞানপ্রত্যাশী শিক্ষার্থী। এই বিভাগ আমার আবেগের একটা অংশজুড়ে আছে। এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগেই জীবন ও জীবিকা। ভালোবাসি, যতখানি নিজেকে বাসা যায়। মঙ্গল কামনা করি যতটুকু নিজের জন্য করা যায়। 

আজ আমার প্রাণের বিভাগ প্রতিষ্ঠার দুই দশক পূর্তিতে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীসহ সবাইকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা। এই বিভাগ এগিয়ে যাক নিজ গৌরবে, অসংখ্য ফুল ফোটাক নিজ সৌরভে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের জয় হোক। 

লেখক: শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম