সুপ্রিয় শিক্ষার্থীবৃন্দ, আশাকরি ভালো আছো। সামনে তোমাদের এইচএসসি বোর্ড পরীক্ষা। এ সময়ে অধিকাংশ শিক্ষার্থী মানসিক চাপে থাকে। কোন বিষয়ে ভালো প্রস্তুতি হয়েছে; কোন বিষয়ে ভালো প্রস্তুতি হয়নি- এসব ভাবনা মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। বাংলা ও ইংরেজির মতো বিষয়গুলোর পরীক্ষা প্রথমে হওয়ায় এ বিষয়ে মানসিক চাপ আরো বেশি থাকে। আমি তোমাদের এমন মানসিক চাপ কমানোর জন্য বাংলা প্রথমপত্রে ভালো ফলাফল করার কিছু দিক-নির্দেশনা দিচ্ছি। আশাকরি তোমারা উপকৃত হবে।
শিক্ষার্থীবৃন্দ, বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুসারে বাংলা প্রথমপত্রে তোমাদের সিলেবাস এবার অর্ধেক করা হয়েছে। তোমরা গদ্যে সাতটি (অপরিচিতা, বিলাসী, আমার পথ, মানব-কল্যাণ, মাসি-পিসি, বায়ান্নর দিনগুলো এবং রেইনকোট) গল্প-প্রবন্ধ পড়বে এবং সাতটি কবিতা (সোনার তরী, বিদ্রোহী, প্রতিদান, তাহারেই পড়ে মনে, আঠারো বছর বয়স, ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ এবং আমি কিংবদন্তির কথা বলছি) পড়বে। উপন্যাস (লালসালু) এবং নাটক (সিরাজউদ্দৌলা) যথারীতি পড়তে হবে। গদ্য অংশ থেকে চারটি প্রশ্ন হবে, কবিতা থেকে তিনটি প্রশ্ন হবে এবং উপন্যাস ও নাটক থেকে দুটি করে মোট চারটি প্রশ্ন হবে। তোমাকে গদ্য ও কবিতা অংশ থেকে কমপক্ষে দুটি করে এবং উপন্যাস ও নাটক থেকে কমপক্ষে একটি করে মোট সাতটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। বহুনির্বাচনী প্রশ্নের ক্ষেত্রে গদ্য অংশ থেকে বারটি, কবিতা অংশ থেকে বারটি এবং উপন্যাস ও নাটক থেকে তিনটি করে মোট ছয়টি প্রশ্ন থাকবে। বহুনির্বাচনী প্রশ্নগুলো বিভিন্ন স্তরে (জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতা) এবং বিভিন্ন গঠনে (সাধারণ, বহুপদী সমাপ্তি সূচক এবং অভিন্ন তথ্যভিত্তিক) ভাগ করা থাকবে।
শিক্ষার্থীবৃন্দ, এবার তোমাদের সিলেবাসভুক্ত গদ্য থেকে অপরিচিতা, বিলাসী, মাসি-পিসি, বায়ান্নর দিনগুলো এবং রেইনকোট বেশি করে পড়বে। অপরিচিতা গল্পের কল্যাণী, অনুপম, শম্ভুনাথ সেন, মামার চরিত্র এবং যৌতুক প্রথার নির্মম দিক নিয়ে প্রশ্ন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বিলাসী গল্পের মৃত্যুঞ্জয়, বিলাসী, ন্যাড়া চরিত্র, তৎকালিন সমাজ ব্যবস্থা, ন্যাড়ার আত্মীয় মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রীর আচরণ, বিলাসী ও মৃত্যুঞ্জয়ের ভালোবাসা সম্পর্কে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ন্যাড়ার খুড়োর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন হওয়ার সুযোগ রয়েছে। মাসি-পিসি গল্পে মাসি-পিসির হার না মানা জীবন সংগ্রাম, দুজনের মধ্যে সহযোগিতামূলক আচরণ, দুজনের ঝগড়া, আহ্লাদির প্রতি তাদের সজাগ দৃষ্টি ও তাকে কেন্দ্র করে দুজনের দূরদর্শী সিদ্ধান্ত, জগু, কৌলেশ ও গোকুলের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি, দুর্ভিক্ষের বর্ণনা এবং সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য সর্বাÍক প্রস্তুতির দিকটি গুরুত্বপূর্ণ। বায়ান্নর দিনগুলো রচনা থেকে বিনা বিচারে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সহকর্মীকে জেলবন্দী করে রাখার ক্ষেত্রে শাসক শ্রেণির মানসিকতা, জেলখানায় অনশন, দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দেয়ার সংকল্প, কোন জেলে নিয়ে যাচ্ছে তা বাইলে জানানোর জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী পদক্ষেপ, ভাষা আন্দোলনের প্রভাব ও ভাষার জন্য আন্দোলনকারীদের গুলি চালানোর মতো পাকিস্তান সরকারের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। রেইনকোট গল্পে নুরুল হুদার ভীত ও সন্ত্রস্ত মানসিকতার বিপরীতে সাহসী হয়ে ওঠার, তার কথায় পাকিস্তানীদের অত্যাচার, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও জিনিসপত্রের লুটপাট করার বর্ণনা, রেইন কোটে মিন্টুর উপস্থিতি, গেরিলা আক্রমণ, তৎকালিন ঢাকা শহরের অবরুদ্ধ অবস্থা, পঁচিশে মার্চ রাতের আক্রমণ, নুরুল হুদার প্রতি তার স্ত্রীর কথোপকথন, কলেজের প্রিন্সিপালের দৃষ্টিভঙ্গি, প্রিন্সিপালের পিয়নের আচরণ ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বর্ষা ঋতুর প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ।
কবিতার মধ্যে সোনার তরী, বিদ্রোহী, প্রতিদান, আঠারো বছর বয়স, আমি কিংবদন্তির কথা বলছি জোর দিয়ে পড়বে। সোনার তরী কবিতায় প্রকাশিত কবির দর্শন, কালের প্রবাহে কর্ম বা কীর্তির অমরত্ব এবং ব্যক্তির মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা, কালের নির্মোহ অবস্থা, প্রতিকূল পরিস্থিতি মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকা গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্রোহী কবিতায় ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে কবির নিজেকে প্রকাশ করার দুঃসাহস, শাসকের নিয়ম-কানুনের বিপরীতে নিজেকে তুলে ধরা, কবিতায় হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের ঐতিহ্যের ব্যবহার, হিন্দু ও গ্রীক পুরাণের ব্যবহার, নিজের স্বরূপ প্রকাশের মধ্যদিয়ে শাসককে ভয় দেখানো এবং প্রতিটি স্বাধীনতাকামীকে এভাবে বিদ্রোহী হওয়ার আহ্বান থেকে প্রশ্নের বিষয় হতে পারে। প্রতিদান কবিতায় যেকোনো ধরনের হিংসা ও হানাহানির বিপরীতে প্রেম ও ভালোবাসা দিয়ে শান্ত পৃথিবী গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা, মানবিকবোধ জাগরণের মাধ্যমে পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে। আঠারো বছর বয়স কবিতায় আঠারো বছর বয়সের ইতিবাচক ও কল্যাণময় দিক এবং এ বয়সের ধ্বংসাত্মক দিকগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ কবিতায় কবি কেন আঠারো বছর বয়স কামনা করেছেন- তা জানতে হবে। আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতায় কিংবদন্তির প্রবাহ, কবির পূর্ব পুরুষের প্রতি সংঘটিত অন্যায় ও অত্যাচার, বর্তমানের বাঙালি জাতির জাতীয় জীবনে কবির পূর্ব পুরুষের অবদান, কবি ও কবিতা যে অর্থে এ কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে; নিজের অধিকার আদায়ের জন্য এ কবিতায় কবি ঐতিহ্যের শিকড় সন্ধানী
সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন, দেশাত্মবোধের পরিচয় দিয়েছেন তা বেশি করে পড়তে হবে।
লালসালু উপন্যাস থেকে মজিদ চরিত্রের ধূর্ত, দূরদর্শী ও ধর্মী ব্যবসায়ী মনোভাবের পরিচয়, জমিলা চরিত্রের হার না মানা দিক / প্রতিবাদী দিক, মাজারের প্রতি জমিলার অবজ্ঞা, মজিদের প্রতি রহিমার আনুগত্য আচরণ, খালেক ব্যাপারীর প্রভাবশালী অথচ মজিদের প্রতি ক্রম নির্ভর চরিত্র, আমেনা বিবির প্রতি মজিদের প্রতিশোধ প্রবণ মনোভাব, স্বামীহারা হাসুনির মায়ের কর্মঠ আচরণ, তাহেরের বাপের হারিয়ে যাওয়া, আক্কাসের স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ সচেতনভাবে নস্যাৎ করা, গ্রামের মানুষদের মাজারের প্রতি যুক্ত রাখার কৌশল, আওয়ালপুরের পীরের ভণ্ডামী ও তার আগমনে মজিদের ভীত হওয়া, কৃষি জমির প্রতি গ্রামবাসীর ভালোবাসা গুরুত্বপূর্ণ দিক। নাটকের ক্ষেত্রে সিরাজউদ্দৌলার চরিত্রের দেশপ্রেম, ষড়যন্ত্রের আছে অসহায় হয়ে নির্মম মৃত্যুর শিকার, মিরজাফর আলী খান, উঁমিচাঁদ, মোহাম্মাদি বেগ, ঘসেটি বেগম, রবার্ট ক্লাইভ, মোহনলাল, মীরমর্দান ও নারানসিং চরিত্র গুরুত্বপূর্ণ। নারী চরিত্রের ক্ষেত্রে নবাব পত্নীর চরিত্র সম্পর্কেও তোমরা জানবে। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ আক্রমণের বর্ণনা, বাংলাকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে মিরজাফরের হৃদয়ে জেগে উঠা সতর্কবার্তা থেকে প্রশ্ন হতে পারে।
বাংলা প্রথমপত্রের পরীক্ষায় এগারোটি প্রশ্ন থেকে তোমাদের সাতটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। প্রতিটি প্রশ্ন লেখার জন্য সর্বোচ্চ বিশ মিনিট সময় নেয়া যেতে পারে। প্রতিটি সৃজনশীল প্রশ্নে চারটি প্রশ্ন থাকবে। ক নম্বরে জ্ঞান স্তরের প্রশ্ন থাকবে। এটি সরাসরি বই থেকে থাকবে। এ প্রশ্নের উত্তর এক বাক্যে কিংবা এক শব্দে লেখা যেতে পারে। সর্বোচ্চ এক মিনিট সময় পাবে উত্তর লেখার জন্য। খ নম্বরে অনুধাবন স্তরের প্রশ্ন থাকবে। এ প্রশ্নের উত্তর দুটি অংশে লেখবে। প্রথমে জ্ঞান অংশ; যা ১-২ বাক্যে লিখতে হবে। দ্বিতীয় অংশে অনুধাবন; যা ৪-৫ বাক্যে লিখতে হবে। অনুধাবন স্তরের প্রশ্নের উত্তর লেখার জন্য চার মিনিট সময় বরাদ্দ থাকবে। গ নম্বরে প্রয়োগ স্তরের প্রশ্ন থাকবে। এ প্রশ্নের উত্তর তিনটি অংশে লিখবে। এখানে উত্তর লেখার জন্য উদ্দীপকের সঙ্গে পাঠ সংশ্লিষ্ট গদ্য কিংবা কবিতার অংশের মিল-অমিল দেখানো হয়। প্রশ্নের উত্তর লেখার সময় প্রথমে জ্ঞান অংশে মিল-অমিল তুলে ধরতে হয়। দ্বিতীয় প্যারায় জ্ঞান অংশ অনুসারে গদ্য/ কবিতার কথা এবং তৃতীয় প্যারায় জ্ঞান অংশ অনুসারে উদ্দীপকের কথা লিখতে হবে। সর্বোচ্চ ছয় মিনিট সময় বরাদ্দ এ প্রশ্নের উত্তর লেখার জন্য। ঘ নম্বরে উচ্চতর দক্ষতা স্তরের প্রশ্ন থাকবে এবং এটি চার প্যারায় লেখবে। প্রথম প্যারায় উদ্দীপক ও পাঠ্য সংশ্লিষ্ট গদ্য/কবিতার সঙ্গে তুলনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং সিদ্ধান্ত অনুসারে ২-৩ বাক্যে যুক্তি দিতে হবে। দ্বিতীয় প্যারায় সিদ্ধান্ত অনুসারে বইয়ের কথা অনুধাবন লিখতে হবে। তৃতীয় প্যারায় সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রয়োগ লিখতে হবে। এরপর চতুর্থ প্যারায় অনুধাবন ও প্রয়োগের বিষয়ের তুলনামূলক আলোচনা করে সিদ্ধান্ত পুনরায় প্রতিস্থাপন করতে হবে। সর্বোচ্চ নয় মিনিট সময় পাওয়া যাবে এ প্রশ্নের উত্তর লেখার জন্য। সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তরে অতিরিক্ত কোনো কথা লেখা যাবে না। প্রয়োজনীয় কথা বাদ দেওয়া যাবে না। সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর পৃষ্ঠা গণনা করে লেখার সুযোগ নেই।
যেহেতু তোমাদের সিলেবাস অর্ধেক করা হয়েছে। তাই সাতটি গদ্য ও সাতটি কবিতার উপর বহুনির্বাচনি প্রশ্নের উত্তর খুব বেশি গভীরে যাবে না। তোমাদের উচিত হবে- প্রতিটি গল্প-প্রবন্ধ ও কবিতা লাইন ধরে ধরে পড়বে। শব্দার্থ, পাঠ পরিচিতি ও লেখক পরিচিতি মনোযোগ সহকারে পড়বে। উপন্যাস ও নাটকের ব্যক্তির নাম, গ্রামের নাম, কে কোন কাজ করত, কার সম্পর্কে কী বলা হয়েছে, কোন সংলাপ কোন অংশে এবং কোন দৃশ্যে, কোন দৃশ্য কোন তারিখে এবং কোথায় হয়েছে, কোন দৃশ্যে কে কে রয়েছে ইত্যাদি গভীরভাবে জানতে হবে। প্রতিটি অনুধাবন প্রশ্নের কিংবা ব্যাখ্যামূলক লাইনের উত্তর জ্ঞান ও অনুধাবন অংশে বিভাজন করে উত্তর শিখবে। বহুপদী সমাপ্তিসূচক বহুনির্বাচনি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে সবগুলো অপশন পড়ে তারপর উত্তর বিবেচনায় আনতে চেষ্টা করবে। অভিন্ন তথ্যভিত্তিক বহুনির্বাচনি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় দুটি প্রশ্ন ভালো করে পড়বে। অনেক সময় প্রথম প্রশ্নের উত্তর দ্বিতীয় প্রশ্নে ধরা যায়। ত্রিশটি বহুনির্বাচনি প্রশ্নের ১৪-১৬টি জ্ঞান স্তরের, ১০-১২টি অনুধাবন স্তরের, ৪-৬টি প্রয়োগ স্তরের এবং ৩-৪টি উচ্চতর দক্ষতার স্তরের প্রশ্ন থাকবে। সেজন্য গল্প-প্রবন্ধ, কবিতা, উপন্যাস ও নাটকের জ্ঞান স্তরের তথ্য যাদের দখলে থাকবে তারা বহুনির্বাচনি প্রশ্নের উত্তরে ভালো করবে। তাড়াহুড়া না করে গভীরভাবে চিন্তা করে উত্তর চিহ্নিত করতে হবে। উপন্যাস ও নাটক শুরুর আগে বিষয় সংশ্লিষ্ট অংশ থেকে জ্ঞান অংশের প্রশ্ন থাকতে পারে। সংজ্ঞা ও শ্রেণিকরণ থেকে অনেক সময় বহুনির্বাচনি প্রশ্ন আসে। শিক্ষার্থীবৃন্দ, মানসিকভাবে শক্ত থাকবে। যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে স্থির রেখে সময় মেনে সঠিক তথ্যের আলোকে সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর লিখার চেষ্টা করবে। তোমার সর্বোচ্চ শ্রম ও শক্তি তোমাকে লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে নেবে। তোমাদের সকলের জন্য রইল শুভকামনা।
লেখক: ড. সনজিত পাল
সিনিয়র শিক্ষক, সেন্ট গ্রেগরী হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ, লক্ষ্মীবাজার, ঢাকা