যৌন নিপীড়ন: এবার ঢাবি অধ্যাপক নাদিরের বিরুদ্ধে মুখ খুললেন আরেক ছাত্রী
ঢাবি প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:৩৮ পিএম
এবার আরেক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি ও মানসিক নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে। রাজধানীর আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক ছাত্রী এই অভিযোগ করেছেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি শিক্ষক হিসাবে ক্লাস নিতেন তিনি। বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. মাকসুদুর রহমান বরাবর অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে অধ্যাপক মাকসুদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের একজনের কাছ থেকে ড. নাদির জুনায়েদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ এসেছে। এ সংক্রান্ত অভিযোগগুলো মূলত উপাচার্য বরাবর দেওয়া হয় এবং প্রক্টরের কাছেও অনুলিপি পাঠানো হয়। আমি সেই অনুলিপিটা পেয়েছি।’
অভিযোগপত্রে ওই শিক্ষার্থী উল্লেখ করেন, ‘আমি যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছি, সেখানে অধ্যাপক নাদির জুনাইদ একটি কোর্স পড়াতে গেস্ট ফ্যাকাল্টি হিসাবে এসেছিলেন। আমি ক্লাসের সিআর হওয়ার সুবাদে আমাকে তার সঙ্গে এক ধরনের যোগাযোগ রাখতে হতো। প্রথমত উনি নিয়মিত আমাকে ফোন দিতেন। বাসায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিতেন। কিন্তু সমস্যা হলো, উনি ব্যক্তিগত অনেক তথ্য জিজ্ঞেস করতেন। আমাকে এমনও জিজ্ঞেস করেছেন, আমার বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা-এ রকম। ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল, উনার পড়াশোনার কাজের থেকে বেশি আগ্রহ ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। এসব নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে চাইতেন। সাধারণত উনি রাত ১০টা বা ১২টার দিকে ফোন দিতেন। উনি আমাকে যখন এইভাবে ফোন বা ভিডিও কল দিতেন, আমি খুবই বিব্রত হতাম। আমি প্রায় উনার ফোন না ধরার চেষ্টা করতাম, কিন্তু সেটার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পরবর্তী ক্লাসে দেখা যেত। ফোন না ধরায় আমাকে ক্লাসে নানাভাবে হেনস্তা করতে চাইতেন। ক্লাসে এভাবে হেনস্তার শিকার হওয়ার পরও উনি আবারও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন।’
শিক্ষার্থী আরও বলেন, ক্লাসে ও ক্লাসের বাইরে উনার মুখ ও মুখোশ ছিল আলাদা। উনি ক্লাসে হেনস্তা করার পরে আবার দুঃখপ্রকাশ করে আমাকে মেসেজ দিতেন, ফোন দিতেন। পরে অনেকটা বাধ্য হয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে উনার ফোন এবং ভিডিও কল রিসিভ করতাম। তখন ভিডিও কলে বলতেন, একটু তোমার চেহারাটা দেখি, তোমার চুলটা একটু দেখি, তোমার জুম পিক দেখি। আমার কয়েকবার মনে হয়েছে তখন উনি হস্তমৈথুন করেন। উনি সব সময় চাইতেন, তাকে সব আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখি। ‘উনি অনেক হ্যান্ডসাম’-এটা উনি বারবার শুনতে চাইতেন। উনি এত সুদর্শন, এত তরুণ, উনাকে দেখে আমরা আকর্ষিত বোধ কেন করছি না-এরকম বিষয় নিয়ে প্রায়ই খোঁচা দিতেন। প্রায়ই মেসেঞ্জার/হোয়াটসঅ্যাপে উনার ভিডিও বা ছবি পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, ‘আমি দেখতে কেমন’। পরে বুঝেছি, এর সবই ছিল উনার ফাঁদ পাতার কৌশল।
অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে অশ্লীল কথোপকথন চালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টার অভিযোগ তুলে ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘উনি আমাকে শারীরিক স্পর্শ বা সেরকম কিছু করেননি। কিন্তু বিয়ের কথা বলে আমার সঙ্গে দীর্ঘদিন কথোপকথন চালিয়ে গেছেন। উনি প্রায় অশ্লীল কথাবার্তা বলতেন। নানা রকম যৌন উত্তেজনামূলক কথা আমার সঙ্গে বলতে চাইতেন। সব সময় অন্তরঙ্গ কথা বলার প্রতি উনার বিশেষ আগ্রহ থাকত। আমার শরীরের স্পর্শকাতর জায়গা নিয়ে তিনি আমাকে প্রশ্ন করতেন।’
অধ্যাপক নাদির জুনাইদ অন্য নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে এমন কাজ করেছেন উল্লেখ করে অভিযোগকারী বলেন, ‘আমার ক্লাসের আরেকটা মেয়ের সঙ্গেও এমন করেছেন উনি। ওই মেয়েকেও উনি বিয়ের প্রলোভন দেখিয়েছেন। ৬ মাসের জন্য পড়াতে গিয়ে একই ক্লাসের দুজন মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন, এটাকে স্বাভাবিক মনে করার কোনো কারণ নেই।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদকে একাধিকবার কল দিয়েও পাওয়া যায়নি।
৭ ফেব্রুয়ারি নম্বর কম দেওয়া নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তরের ১২তম ব্যাচের কিছু শিক্ষার্থীর অভিযোগের পর ১০ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ এনে প্রক্টরের কাছে লিখিত দেন বিভাগের এক ছাত্রী। যদিও তিনি (নাদির জুনাইদ) এসব অভিযোগ অস্বীকার করে এর পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে বলে দাবি করেন।
অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হয়রানির এই অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচারের দাবিতে ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে ক্লাস বর্জন করে বিক্ষোভ করেন বিভাগের সব ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। তার বিভাগীয় অফিস কক্ষে তালা দেওয়ার পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষের তালা সিলগালা করে দেন। দরজায় ‘যৌন নিপীড়ক অধ্যাপক নাদির জুনাইদ ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত’ সংবলিত পোস্টার ঝুলিয়ে দেন। এছাড়া আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপিও দেন।
পরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে অধ্যাপক নাদির জুনাইদকে ৩ মাসের বাধ্যতামূলক ছুটি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ছুটির চিঠিতে বলা হয়, অভিযোগের যথাযথ অনুসন্ধান ও তদন্ত করার জন্য বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরবর্তী সিন্ডিকেট সভায় উপস্থাপন করা হবে এবং সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সর্বশেষ রাজধানীর আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী যৌন নিপীড়ন ও হয়রানির অভিযোগ করলেন।