Logo
Logo
×

শিক্ষাঙ্গন

সাক্ষাৎকারে ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি

‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পদোন্নতির মানদণ্ড হওয়া উচিত গবেষণা ও প্রকাশনা’ (ভিডিও)

আতাউর রহমান

আতাউর রহমান

প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১০:২৩ পিএম

‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পদোন্নতির মানদণ্ড হওয়া উচিত গবেষণা ও প্রকাশনা’ (ভিডিও)

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. আতাউল করিম। ছবি: যুগান্তর

খ্যাতনামা পদার্থবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আতাউল করিম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস ডার্টমাউথের এক্সিকিউটিভ ভাইস চ্যান্সেলর, প্রভোস্ট ও চিফ অপারেটিং অফিসার। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দ্রুততম ভাসমান (ম্যাগলেভ) ট্রেন চলাচল প্রযুক্তির বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তার জন্ম সিলেটের বড়লেখায়, ১৯৫৩ সালে। চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক করেন। পরে যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান এবং ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি করেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয়, নিউইয়র্কের সিটি ইউনিভার্সিটি, আরকানসাস ইউনিভার্সিটি, ডেটন ইউনিভার্সিটি, ওল্ড ডমিনিয়ন ইউনিভার্সিটিসহ দেশটির বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা, গবেষণা এবং প্রশাসনিক বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৩ সাল থেকে তিনি ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় পদটিতে রয়েছেন। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার মান, বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ এবং র্যাংচকিংয়ে পিছিয়ে পড়ার কারণ ও উত্তরণের উপায় নিয়ে সম্প্রতি কথা হয় তার সঙ্গে। 
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আতাউর রহমান

যুগান্তর : দেশসেরা দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) চলতি বছর বিশ্ব র্যাং কিংয়ে ৮০০ থেকে ১০০০-এর মধ্যে স্থান পেয়েছে। এত পেছনে কেন তাদের স্থান?


আতাউল করিম : বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নির্ণয়ের সুপরিচিত বৈশ্বিক র্যাং কিং কোয়াককোয়ারেলি সায়মণ্ডসের (কিউএস) র্যাং কিংয়ে ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ৩৬৫তম পজিশনে; ২০১০ সালে ঢাবি ও বুয়েট ৫৫০ থেকে ৬০০-এর মধ্যে ছিল; ২০১২ সালে ছিল ৬০১ থেকে ৭০০-এর মধ্যে; ২০১৪ সালে আরও পিছিয়ে গিয়ে ছিল ৭০১ থেকে ৮০০-এর মধ্যে। এ বছর র্যাং কিংয়ে তাদের স্থান হয়েছে ৮০১ থেকে ১০০০-এর মধ্যে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের ইতিহাসে বৈশ্বিক র্যাংেকিংয়ে প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে বাজে অবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে এবার, যা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য সম্মানের নয়। আমরা একটু লক্ষ করলেই দেখব- গত ১৭ বছরে আমরা র্যাং কিংয়ে প্রায় ৩৬৫ থেকে ৫০০ ধাপ পিছিয়ে গেছি। 

যুগান্তর : পিছিয়ে পড়ার কারণ কী?
আতাউল করিম : এর মূল কারণ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেরা আজও ঠিক করতে পারেনি তারা কী চায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের প্রকাশিত কোনো লক্ষ্য নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভাইস চ্যান্সেলর যখন বলেন, ১০ টাকায় চপ-সিঙ্গাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যায় না; অর্থাৎ এই যদি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য, তাহলে সেখানে র্যাং কিং নিয়ে ভাবনা আসার জায়গা কোথায়? 
বিশ্ববিদ্যালয় গণতন্ত্র দিয়ে পরিচালিত হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হবে মেধায়। সবচেয়ে মেধাবী, সম্মানজনক ব্যক্তিরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদে থাকবেন, বাকিরা তাকে অনুসরণ করবেন। অথচ বাংলাদেশে দলীয় লেজুড়বৃত্তির আঁতুড়ঘর হয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়। লাল দল, নীল দল, বিভিন্ন রঙা দলগুলো ঠিক করে কে বিভাগীয় প্রধান হবেন, কে ডিন হবেন, প্রভোস্ট হবেন, কে প্রোভিসি হবেন, ভিসি হবেন। 

যুগান্তর : পৃথিবীর ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে পরিচালিত হয়?
আতাউল করিম : পৃথিবীতে কোনো ভালো বিশ্ববিদ্যালয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হয় না। পরিচালিত হয় মেধার ভিত্তিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু থেকেই বেশিরভাগ মানুষকে সন্তুষ্ট রাখার নীতিতে পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় মেধার ভিত্তিতে পরিচালিত না হলে যেটি হয়; যেমন ধরুন আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হয়ে যদি একজন অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেন, তিনি কিন্তু চাকরির বয়স পর্যন্তই শিক্ষকতা করবেন। তিনি যখন বিভাগের দায়িত্ব পালন করবেন, তখন তিনি কিন্তু আরও অযোগ্য ব্যক্তিকে বাছাই করবেন। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এটাই হচ্ছে। যদি কোয়ালিটি পিপল এখানে পড়াতেন, তাহলে র্যাং কিংয়ে গত ১৭ বছরে ৫০০ পজিশন পেছাত না ঢাবি ও বুয়েট।
স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ১৯ জন ভিসি হয়েছেন, গবেষণায় তাদের ব্যক্তিগত অবদান যদি দেখেন, তাহলে হতাশ হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ব্যক্তির পারফরমেন্সই যদি এমন হয়, তাহলে অন্যদের অবস্থা কী হবে? আর সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক অগ্রগতি কীভাবে আশা করেন? 

 

যুগান্তর : আপনি বলতে চাচ্ছেন, লক্ষ্যহীন হওয়ায় আমাদের শিক্ষাটা এখনো বিশ্বমানে পৌঁছতে পারেনি?
আতাউল করিম : এর উত্তর অবশ্যই ‘হ্যাঁ’ হবে। আমরা কয়েক দশক আগেও যে স্ট্যান্ডার্ডে ছিলাম, সেটি এখন হারিয়ে ফেলেছি। আমি একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সাবজেক্ট নিয়ে পড়েছি, সেই পদার্থবিদ্যায় এখন যেসব বিষয় পড়ানো হচ্ছে, সেগুলো ৫০ বছর আগেকার। আপনি যদি বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে যান, সেখানে দেখবেন কোর্সগুলোর বড় একটি অংশ পাওয়ার সিস্টেমের ওপর। বাংলাদেশ সৃষ্টির আগে যখন বুয়েটের সিলেবাস প্রণয়ন করা হয়েছিল, তখন পাওয়ারের একটা ফিল্ড ছিল। আজ সেই ফিল্ড নেই। আজ পাওয়ার ছয় কোর্সে পড়াতে হবে না, একটা কোর্স হলেই যথেষ্ট। 
আমি বলতে চাচ্ছি, আমাদের দেশের দুটি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স কারিকুলাম আধুনিক নয়। ৪০-৫০ বছর আগের কোর্সগুলো এখনো সেখানে পড়ানো হচ্ছে। তাহলে শিক্ষার মান ভালো হবে কীভাবে? 

যুগান্তর : একটা সময় এদেশে বিদেশি শিক্ষক ও ছাত্ররা আসতেন, এখন আগ্রহ দেখান না কেন? 
আতাউল করিম : আমি যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে পড়াতে যাই, তারা বলবে আপনার তো ফিজিক্সে পিএইচডি নেই। আবার বুয়েটে যখন ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে চাইব, তারা বলবে আপনার øাতক তো ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে নয়। এ রকম বিষয়গুলো এখানে ফেস করা লাগে। আমি যুক্তরাষ্ট্রে ১২-১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছি, যেখানে কোথাও আমাকে এ রকম প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি। তারা আমাকে বলেনি, আপনি যে ঢাবির øাতক, সেই সার্টিফিকেট কোথায়? সুতরাং বিদেশি ফ্যাকাল্টিকে আকৃষ্ট করতে হলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এসব বাধা দূর করতে হবে। সেই সঙ্গে পরিবেশটাও তৈরি করতে হবে। 

যুগান্তর : যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মানদণ্ড কী?
আতাউল করিম : সবচেয়ে যোগ্য লোকটিকে বেছে নেয় তারা। দ্বিতীয়ত, যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাকে রাখার জন্য যা যা দরকার সেই চাহিদা পূরণ করে। তার জন্য যদি ল্যাব তৈরি করে দিতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয় সেটি দেয়; গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট দেওয়া দরকার হলে দেবে। 
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের অবসরের কোনো বয়স নেই। আমাদের এখানে নির্দিষ্ট বয়সের পর শিক্ষকতা করা যায় না। আমি যতদিন বাঁচব, ততদিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষকতা করতে পারব। এ কারণে সবচেয়ে জ্ঞানী ও অভিজ্ঞদের সাহচর্যে ছাত্রদের বিশ্বমানের শিক্ষাটাও নিশ্চিত হয়। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের পদোন্নতির মানদণ্ড হচ্ছে- আপনি ওই র্যাং কে কত বছর ছিলেন! এটি কোনো মানদণ্ড হতে পারে না। আপনি কী কী গবেষণা করেছেন, কী প্রকাশনা আছে সেসবই বিবেচ্য হওয়া উচিত। 

যুগান্তর : আমাদের দেশের ভালো ভালো গ্র্যাজুয়েটরা বিদেশে গিয়ে স্থায়ী হচ্ছে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে দেশের প্রতি তাদের কমিটমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন ওঠা কি স্বাভাবিক নয়?
আতাউল করিম : আসলে যে যেখানে কাজ করতে সুবিধা পাবে, সেখানেই করতে চাইবে। আপনি কমিটমেন্টের কথা বলছেন তো? বাংলাদেশে কাজ করার ক্ষেত্রে বহু বাধা। অবকাঠামোগত বাধা, বাজেট সংকট, আবার নিজস্ব চিন্তার প্রতিফলন ঘটানোয় সমস্যা। 
দেখুন, জওহরলাল নেহেরু ভারতবর্ষে আইআইটিগুলো প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যিনি লন্ডনের হেয়ার স্কুলে পড়েছেন। নেহেরু জেনেছিলেন, ভারতীয় বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা নোবেল পদক পেয়েছেন। তিনি সেখান থেকে এক্সপার্ট হায়ার করলেন। তাদের চড়া বেতন ও সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। তাদের হাত ধরে আইআইটিগুলো বেড়েছে। এখন আর ভারতকে বিদেশ থেকে এক্সপার্ট হায়ার করতে হয় না। আমাদের দেশে কি এমন উদ্যোগ কখনো নেওয়া হয়েছে? 

যুগান্তর : সরকার তো উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে হেকেপসহ বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছে... 
আতাউল করিম : দেখতে হবে প্রকল্পগুলো রান করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কাকে? যোগ্য ও সৎ ব্যক্তির হাতে দায়িত্ব অর্পিত না হলে ফল আসবে কোত্থেকে। কোয়ালিটি বাড়াতে হলে তো কোয়ালিটি ফ্যাকাল্টি লাগবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কতজন কোয়ালিটি ফ্যাকাল্টি আছেন। 

যুগান্তর : বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষপদ নিতে বরেণ্য শিক্ষাবিদরা অনাগ্রহী। তাহলে পরিবর্তনটা আসবে কীভাবে?
আতাউল করিম : এ বিষয়ে আমি প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি উদ্ধৃতি দেব। তিনি বলেছেন, ‘আমরা যখন শিক্ষকতা করতাম কখনোই প্রমোশনের কথা ভাবিনি। এখনকার শিক্ষকরা প্রমোশনের কথা চিন্তা করে নকল করতেও আগ্রহী।’ তিনি বলেছেন, এদেশে একজন ভিসি স্বাধীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, যেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে প্রভাব ফেলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব লেকচারার নিয়োগ হচ্ছে, তাদের বেশিরভাগকেই মেধার ভিত্তিতে নয়, রাজনৈতিক মতাদর্শ বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেছেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালগুলো শিক্ষিত লোকদের একটা বস্তিতে পরিণত হয়েছে।
আমিও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারের সঙ্গে একমত। এদেশে ভিসি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নন। এ ব্যক্তিটাকে ক্ষমতা না দিলে পরিবর্তনটা আসবে কোত্থেকে? যুক্তরাষ্ট্রে কিন্তু এমনটি নেই। সেখানে ভিসিরা চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার, তাদের সব ধরনের ক্ষমতা দেওয়া হয়।

যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।

আতাউল করিম : ধন্যবাদ।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম