
প্রিন্ট: ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৩৮ পিএম
এখন কাজ করতে হয় এক ধরনের বেপরোয়া অভ্যন্তরীণ তাগিদ থেকে: কলম ম্যাকক্যান

মেজবাহ উদ্দিন
প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
এ যুগের রাস্তার প্রতিটি বাঁকে ডিজিটাল সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে ‘মানবতা’ শব্দটির ইউ-টার্ন। তবু মানুষ হওয়ার দাবি মেটাতে কেউ কেউ ছোটেন তার পেছনে। আইরিশ কথাসাহিত্যিক কলম ম্যাকক্যানের বেশিরভাগ কাজই যেন সেই ছুটে চলার গল্প বলে। তার মধ্যে ‘অ্যাপেইরোগন’, ‘ট্রান্সআটলান্টিক’, এবং ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড জয়ী ‘লেট দ্য গ্রেট ওয়ার্ল্ড স্পিন’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মার্কিন জাতীয় বই পুরস্কার এবং আন্তর্জাতিক ডাবলিন সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরষ্কার জয়ী ম্যাকক্যানের সর্বশেষ উপন্যাস ‘টুইস্ট’ এ মাসেই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে, যেখানে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে একটি কেবল মেরামতকারী জাহাজে থাকা এক আইরিশ সাংবাদিক পরিবেশগত ধ্বংস, তথ্যের আধিক্য এবং ঔপনিবেশিকতার প্রশ্নের মুখোমুখি হন। নিজের নতুন বই এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে গার্ডিয়ানের সঙ্গে ম্যাকক্যানের কথোপকথন অনুবাদ করেছেন মেজবাহ উদ্দিন
সাগরতলের যোগাযোগ কেবল সম্পর্কে খুব বেশি সাহিত্য লেখা হয়নি। এটি নিয়ে লেখার জন্য কী আপনাকে অনুপ্রাণিত করল?
: মহামারির শুরুর দিকে, আমি মেরামতের ধারণা নিয়ে অনেক ভাবছিলাম, কারণ আমাদের চারপাশের অনেক কিছুই বারবার ভেঙে পড়ছিল। একসময় আমি দক্ষিণ আফ্রিকার ‘লিয়ন থেভেনিন’ নামের একটি কেবল মেরামতকারী জাহাজের গল্প খুঁজে পাই। আমার মতো অনেকেই ভাবতেন যে, (ডিজিটাল) তথ্য আমাদের ফোন থেকে স্যাটেলাইটে গিয়ে আবার ফিরে আসে। কিন্তু আমি অবাক হয়ে গেলাম যখন জানলাম যে সবকিছু গভীর সমুদ্রের তলদেশে ঘটে অদ্ভুতভাবে, যখন থেকে আমি এটি লেখা শুরু করি, তখন থেকেই বিশ্বজুড়ে সাগরতলের কেবলগুলো কাটা পড়তে শুরু করে- রেড সাগরে হুথিরা, বাল্টিকে রাশিয়া ও চীন।
এটি ভাবতেই অবাক লাগে যে, সমুদ্রের তলদেশে ছড়িয়ে থাকা এই কেবলগুলো আক্রান্ত হওয়াটা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ-যখন আমাদের সব আধুনিক যোগাযোগ এসব সরু নল দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে
: হ্যাঁ। উপকূলের কাছাকাছি ক্ষতিগ্রস্ত কেবল আপনি একটি রিমোটলি অপারেটেড ভেহিকল (ROV) পাঠিয়ে মেরামত করতে পারেন, কিন্তু তার বাইরে, আমরা একেবারে ১৯শ শতকের মতো কাজ করে যাচ্ছি। সেখানে আপনাকে শুধু একটি দড়ি ফেলে, তার শেষে একটি গ্র্যাপলিং হুক লাগিয়ে ভাগ্যের ওপর নির্ভর করতে হবে!
‘টুইস্ট’র বর্ণনাকারী বেশ কয়েকবার জোসেফ কনরাডের হার্ট অব ডার্কনেস-এর উল্লেখ করেছেন। আপনার কাছে এর কী গুরুত্ব রয়েছে?
: খুব স্পষ্টভাবে বললে, টুইস্ট হলো একজন ব্যক্তি, যে নৌকায় করে একটি অনুসন্ধানে বেরিয়েছে। কেবলটি ছিঁড়ে যায় কঙ্গো নদীতে বন্যার পর, যখন নদী তার সব আবর্জনা সাগরে ভাসিয়ে দেয়। এটি বেশ আকর্ষণীয় যে, আমরা যে কেবল রেখেছি, তা প্রায় পুরানো ঔপনিবেশিক জাহাজ চলাচলের পথ অনুসরণ করে। তাই এ সব ছোট ছোট অনুভূতিগুলো একসময় বিশেষ অর্থ বহন করে।
আপনি বড় বড় বিষয় নিয়ে কাজ করেন, আপনি কি মনে করেন উপন্যাস কোনো পরিবর্তন আনতে পারে?
: আমি মনে করি না যে, একটি উপন্যাসের ক্ষমতা রয়েছে এসব বিষয় পরিবর্তন করার। কিন্তু এটি দেওয়ালে একটি ছোট ফাটল অবশ্যই তৈরি করতে পারে, তারপর অন্যরা সে ফাটল বড় করে, এবং একসময় হয়তো পুরো দেওয়ালটাই ভেঙে পড়ে। আমি উপন্যাসিকদের প্রতি আহ্বান জানাই না যে তারা অবশ্যই প্রতিবাদী হবেন অথবা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে লিখবেন। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় আমাকে তা করতেই হবে। আমার উপন্যাস ‘অ্যাপেইরোগন’-এ ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি তুলে ধরা ছিল একটি বড় বিষয়। এবং এটি করার মধ্যে অবশ্যই ঝুঁকি রয়েছে, তবে আশা থাকে যে, কোনো না কোনোভাবে প্রচলিত চিন্তাধারায় সামান্য হলেও নাড়া দেওয়া যাবে। যদিও উপন্যাসিকরা ৫০ বছর আগের মতো গুরুত্বপূর্ণ নন। এখন আপনাকে কাজ করতে হয় একধরনের বেপরোয়া অভ্যন্তরীণ তাগিদ থেকে। এটি আমাকে উত্তেজিত করে, এবং আমি এটি পছন্দ করি। আমি দেওয়ালের সঙ্গে পিঠ লেগে থাকার অনুভূতিটা ভালোবাসি।
অ্যাপেইরোগন বইটি বাস্তব জীবনের দুই বন্ধু, ইসরায়েলি রামি এলহানান ও ফিলিস্তিনি বাসসাম আরামিনের গল্প বলে, যারা একসঙ্গে শান্তির জন্য কাজ করেন। আপনি কি এখনো তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন?
: আমি রামি ও বাসসামের সঙ্গে সপ্তাহে অন্তত একবার কথা বলি, এবং আমি বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার অনুভূতিগুলো অনেকটাই তাদের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে বুঝতে চেষ্টা করি, কারণ আমি নিউইয়র্কে বসে আছি, পশ্চিম তীর বা জেরুজালেমে না। তারা বলে যে, তারা বিষাদগ্রস্ত, খুব রাগান্বিত এবং অত্যন্ত আতঙ্কিত। পশ্চিম তীরে যা ঘটছে, বাসসাম আমাকে যে ঘটনাগুলো বলেন, সেগুলো আমার রক্ত শীতল করে দেয়। আমিও গভীরভাবে ব্যথিত, রাগান্বিত এবং বিভ্রান্ত। কখনো কখনো আমি ভাবি অ্যাপেইরোগন-এর দ্বিতীয় বই লেখা যায় কি না। কিন্তু কল্পনা করুন, এখনই সেই বিষয়ে লেখা শুরু করলে, এটি হবে অত্যন্ত কাঁচা ও জটিল একটি বিষয়। তবে হয়তো সেখানেই আমার যাওয়া উচিত।
আপনি দীর্ঘদিন ধরে সৃজনশীল লেখালেখি শিখিয়েছেন এবং লেখালেখি নিয়ে পরামর্শমূলক একটি বই প্রকাশ করেছেন। যদি সবকিছুর মধ্য থেকে একটি মূল বিষয় বের করতে বলা হয়, আপনি কী বলবেন?
: আমি কথাসাহিত্যিক আলেকজান্ডার হেমনের একটি বাক্য খুব পছন্দ করি : ‘সবকিছুই আবর্জনা, যতক্ষণ না তা অন্যকিছু হয়ে ওঠে।’ এটি সত্যিই গভীর অর্থবহ, কারণ এটি মূলত লেখা নিয়ে বসা, কঠোর পরিশ্রম করা এবং বারবার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপার। এটা হাল না ছাড়ার মানসিকতা, গল্পকে কখনোই আপনাকে হারিয়ে দিতে না দেওয়া। আমি যে বইগুলো লিখেছি, প্রায় প্রতিটিতেই একটা সময় এসেছে যখন আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি। যেন এটি লেখার প্রক্রিয়ারই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ- নিজেকে কষ্ট না দিলে বোঝা যায় না যে সে গল্পটি আপনার জন্য সত্যিই কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
সম্প্রতি কোনো ভালো বই পড়েছেন?
: সম্প্রতি আমি প্রথমবারের মত ফ্রাঙ্কেনস্টাইন পড়লাম এবং এটি আমাকে মুগ্ধ করেছে। এটি আমাদের বর্তমান সময়ের এক নিখুঁত রূপক-আমরা যে দানব সৃষ্টি করছি এবং তার সঙ্গে জড়িত অপরাধবোধ। আমি এখন পড়ছি ওমর এল আক্কাদের ‘ওয়ান ডে, এভরিওয়ান উইল হ্যাভ অলোয়েজ বিন এগিনেষ্ট দিস’, যেখানে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের বর্তমার পরিস্থিতি নিয়ে লেখা হয়েছে-এটা খুব সুন্দর, অনেক প্রয়োজনীয়। এ ছাড়া বেয়াটা উমুবিয়েয়ি মাইরেসের ‘দ্যা কনভয়’ দারুণ লেগেছে, যেখানে ১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডা গণহত্যা থেকে তার পালানর কাহিনি বলা হয়েছে।
আমি দেখছি আপনার শেলফে এডনা ও’ব্রায়েনের একটি ছবি আছে। তিনি একবার বলেছিলেন, যদি কেউ তার জীবনকাহিনি লেখার সুযোগ পান, তবে তিনি আপনাকেই চাইবেন।
: হ্যাঁ, সেটা খুবই সুন্দর এক মুহূর্ত ছিল। আমি তার সঙ্গে অনেক ভ্রমণ করেছি। আসলে, আমার প্রথম বই প্রকাশিত হওয়ার সময়, ৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে লন্ডনে আমার প্রথম পাঠের সুযোগ তিনিই করে দিয়েছিলেন। এরপর তিনি আমার ভালো বন্ধু হয়ে যান। তার প্রভাব আমার মধ্যে বহু উপায়ে প্রবেশ করেছে। তরুণ লেখকরা, বিশেষ করে আয়ারল্যান্ডের তরুণী লেখিকারা, আগামী দিনে কীভাবে তার উত্তরাধিকার বহন করেন, তা দেখাটা দারুণ হবে।
লেখার জন্য আপনার কী দরকার হয়?
: লেখার জন্য আমার দরকার একটি আদর্শ দিন। আর একটি আদর্শ দিন হবে যদি আমি ভোর ৪টায় উঠে, ফুটবলের স্কোর বা ইমেইল না দেখে সরাসরি লেখায় বসতে পারি। তারপর কুকুরকে হাঁটাতে বের হয়ে কিছু ঘরোয়া কাজ সেরে আবার দুপুর পর্যন্ত লিখি। বিকালে কিছু সম্পাদনার কাজ করব, আর হয়তো বিকেল ৪টার দিকে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করব। রাতে আবার কিছু সম্পাদনার কাজ করব। এটাই আমার জন্য আদর্শ দিন।
সূত্র : দি গার্ডিয়ান