নোবেল বিতর্ক
রবীন্দ্রনাথ, ড. ইউনূস ও সার্ত্রে
এ পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর মোটামুটি সবই বিতর্কময়। চাঁদ সুন্দর, চাঁদ কলঙ্কময়, কণ্টকাকীর্ণ শ্রেষ্ঠ পুষ্পগোলাপ। অপার্থিব সুন্দরী ক্লিওপেট্রা, ট্রয়ের হেলেন কিংবা প্রিন্সেস ডায়ানা, কিন্তু বিতর্ক তাদের পিছু ছাড়েনি। বিতর্ক দ্বারা আবর্তিত আমাদের রাষ্ট্র-সমাজ, বিতর্কের মধ্যেই আমাদের বসবাস।
বিতর্কিত বিষয়ে এরকম হয়তো আরও শত-সহস্র উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ঠিক তেমনি বিশ্ববিখ্যাত নোবেল পুরস্কারটিও যে বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে লেখার মূল পর্বে যাওয়ার আগে তার কিছু দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। এতে বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ নেই যে, পৃথিবীর জ্ঞাণীগুণীরাই নোবেল পুরস্কারটি পেয়ে থাকেন। কিন্তু এর মধ্যেও কিছু বিতর্কের ইতিহাস রয়েছে। যেমন-১৯৩৯ সালে সুইডেনের ই.জি.সি ব্র্যানড নামে একজন সংসদ সদস্য, যিনি তখন নোবেল প্রদানকারী কমিটির সদস্য হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
তিনি জার্মানির কুখ্যাত এডলফ হিটলারকে নোবেল দেওয়ার জন্য মনোনয়ন দিয়েছিলেন। বিষয়টি সে সময় পৃথিবীতে ব্যাপক সমালোচিত হয়। তবে সত্তর দশকে যে নোবেল পুরস্কারটি সবচেয়ে বেশি সমালোচনা ও বিতর্কের ঝড় তুলেছিল, সেটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ও ভিয়েতনামের রাজনীতিবিদ লি ডুক থোউ; এ দুজনকে নোবেল প্রদানের মধ্য দিয়ে।
এরা দুজন শান্তিতে নোবেল পান ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনামের মধ্যকার যুদ্ধ অবসানের স্বীকৃতি হিসাবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, যে মুহূর্তে এ নোবেল পুরস্কারটি ঘোষণা করা হয়, তখনো ওই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ অব্যাহত ছিল। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিই তাদের মতামত এভাবে ব্যক্ত করেন, হেনরি কিসিঞ্জার কিছুতেই একজন শান্তি স্থাপনকারী হতে পারেন না। বরং তাকে একজন উঁচুমানের যুদ্ধাপরাধী হিসাবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে।
বিষয়টি তখন পৃথিবীতে বিতর্কের ঝড় তোলে। কিসিঞ্জারকে নোবেল দেওয়ায় ভিয়েতনামের অবিসংবাদিত নেতা লি ডুক থোউ নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটিকে সাফ জানিয়ে দেন, তিনি এ পুরস্কারটি সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং তিনি এটি কিছুতেই গ্রহণ করবেন না। বিষয়টি তখন বিশ্বে এতটাই নিন্দিত ও সমালোচিত হয়, নোবেল কমিটির দুজন সদস্য পদত্যাগ করেন। প্রসঙ্গক্রমেই বলতে হয়, নোবেল ইতিহাসে মাত্র দুই ব্যক্তি স্বেচ্ছায় নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
তাদের মধ্যে একজন ছিলেন লি ডুক থোউ এবং অপরজন হলেন বিশ্ববিখ্যাত অস্তিত্ববাদী ফরাসি লেখক ও দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রে। সার্ত্রেকে নোবেল প্রদান করা হয় ১৯৬৪ সালে। কিন্তু সার্ত্রে নোবেলটি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, একজন লেখকের এ অধিকারটুকু অবশ্যই থাকা উচিত, তিনি চাইলে যে কোনো পুরস্কার নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করতেই পারেন আর সেটি যত সম্মানিতই হোক না কেন। আসলে ঘটনাটি ছিল একটু অন্যরকম। যদিও বিষয়টি ঈষৎ অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হতে পারে, তারপরও পাঠকদের ঘটনার পেছনের ঘটনাটি জানতে চাচ্ছি। সার্ত্রের বন্ধুপ্রতিম ছিলেন আরেক কালজয়ী লেখক আলবেয়ার কামু। কামু তার লেখালেখিতে প্রায়ই সার্ত্রের শরণাপন্ন হতেন এবং সার্ত্রের পরামর্শ ও মূল্যায়ন প্রত্যাশা করতেন। সেই বিচারের সার্ত্রে নিজেকে সবসময় সুপিরিয়র ভাবতেন।
আর তার এ নিজের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ কোনো অংশেই অমূলক ছিল না। সেটা আমরা যারা কামু ও সার্ত্রে পাঠ করেছি, সবাই মোটামুটি জ্ঞাত। সেই কামুই যখন নোবেল পুরস্কারটি সার্ত্রের আগে হস্তগত করে ফেললেন, তখন সার্ত্রেরইবা মান বাঁচে কিসে? কামু নোবেল পান ১৯৫৭ সালে আর সার্ত্রে নোবেলটি পেলেন ১৯৬৪ তে, তখন তিনি ক্রোধ ও অভিমানে তার প্রাপ্ত নোবেলটি গ্রহণে তিনি অস্বীকৃতি জানান। নোবেল বিতর্ক শুধু এর প্রাপ্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। নোবেল কমিটি অনেক বিখ্যাত বরেণ্য ব্যক্তিকে এ পুরস্কারটি থেকে বঞ্চিত করেও অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। সে হিসাবে প্রথমেই আসে মহাত্মা গান্ধীর নাম। অহিংসা ও শান্তিবাদী দর্শনের প্রবাদপুরুষ হিসাবে খ্যাত মহাত্মা গান্ধীর ভাগ্যেই জুটেনি শান্তিতে নোবেল। বিষয়টি যেন সত্যিই অবিশ্বাস্য। শুনে হয়তো অনেকেই অবাক হবেন, মহাত্মা গান্ধী শান্তিতে নোবেলের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন পাঁচবার। ১৯৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪৭ এবং আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার ঠিক কয়েকদিন আগে অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে। এ পৃথিবীতে যিনি এভারেস্ট পর্বতসম কীর্তি রেখে গেছেন, সেই মহাত্মা গান্ধী পাননি নোবেল। আর সেজন্যই হয়তো নোবেল কমিটির এক সদস্য আক্ষেপ করে বলেছিলেন, গান্ধীর হয়তো নোবেল ছাড়া চলবে, কিন্তু নোবেল পুরস্কারটি কি গান্ধীকে ছাড়া চলতে পারবে? ১৯৪৮ সালে নোবেল কমিটি কোনো যোগ্য লোক খুঁজে পাননি। আর সেজন্য ওই বছর কাউকে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হয়নি।
এখন আমার প্রশ্ন, নোবেল কমিটি কি মহাত্মা গান্ধীকে মরণোত্তর নোবেল দিতে পারতেন না? পাঠক, বিষয়টি শুনে হয়তো খানিকটা আশ্চর্যান্বিত হলেন! মরণোত্তর নোবেল, সেটাও কি সম্ভব? কেন সম্ভব নয়! ইতিহাসে দুই-দুইবার মরণোত্তর নোবেল দেওয়া হয়েছিল। প্রথমটি ১৯৩১ সালে সাহিত্যে এরিক এক্সেল কার্লফেল্টকে এবং দ্বিতীয়টি ১৯৬১ সালের শান্তিতে ডাগ হ্যামারশোল্ডকে, যিনি ছিলেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব। যদিও ১৯৭৪ সালে নোবেল কমিটি আইন করে মরণোত্তর নোবেল প্রদান রদ করে দেন।
কিন্তু আমার প্রশ্ন, ১৯৪৭-এর আগে কি গান্ধীকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া যেত না? বহুবার মনোনয়ন পেয়েও নোবেল পাননি লিও তলস্তয়, জেমস জয়েস, আন্তন চেকভ, এমিলি জোলা, এজরা পাউন্ড, মার্ক টোয়েনসহ আরও অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তি। নোবেল বিতর্ক নিয়ে চাইলে হয়তো আরও শত পৃষ্ঠা লেখা যেতে পারে, কিন্তু পাঠকসহ সবাইকে একটি বিষয় উপলব্ধি করতে হবে, নোবেল নিয়ে যত বিতর্ক আলোচনা-সমালোচনা থাকুক না কেন, বর্তমান বিশ্বে এটাই সবচেয়ে সম্মানিত ও শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। আর তাই এ পুরস্কারটি নিয়ে হাসি-তামাশা করলে ক্ষতি আমাদেরই।
এখন মূল প্রসঙ্গে আসি। প্রখ্যাত ভারতীয় লেখক নীরদচন্দ্র চৌধুরী তার একটি লেখায় রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে যা বলেছিলেন, সেটি অনেকটা এরকম- ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখিয়া বহুপাঠকের মন হরণ করিয়া তাদের হৃদয়ে স্থান করিয়া লইয়াছিলেন। কিন্তু বিপত্তি ঘটিল তখনই, যখন তাহার ভাগ্যে নোবেল পুরস্কারটি জুটিল। তিনি যেন সমাজে আত্মঘাতীরূপে আবির্ভূত হইলেন।’ আমারও মনে হয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসেরও সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল, কিন্তু বিপত্তি ঘটল তখনই, যখন তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলেন। তার প্রতি বিভিন্ন মহলের, বিশেষ করে একটি মহলের কেন এ বিদ্বেষ! আমি এর জন্য মূলত তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছি। পরশ্রীকাতরতা, হীনমন্যতা ও ব্যক্তিবিশেষের অস্তিত্ব সংকটের আশঙ্কা।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পেছনে যারা উঠে পড়ে লেগেছিলেন, তারা হয়তো ভেবেছিলেন ইউনূসের নোবেল অর্জনে তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। এ ধরনের হীনমন্য মানসিকতা পোষণ করা সত্যি হাস্যকর ও দুঃখজনক। রাষ্ট্রের একজন ব্যক্তি বড় হয়ে গেলেই আরেকজন ছোট হয়ে যান না। এ পরম সত্যটি উপলব্ধি করার মানষপট অবশ্যই প্রতিটি মানুষের মধ্যে থাকা উচিত। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনটি ছিল আমাদের সবচেয়ে গৌরব ও সম্মানের। আর স্বাধীনতা-উত্তর সবচেয়ে গৌরবের ও শ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে বাংলাদেশের নোবেল বিজয়। এ সত্যটি বেশি করে বোঝা যায় দেশের বাইরে গেলে। ২০০৭-এর প্রথম দিকে আমি গিয়েছিলাম সিঙ্গাপুরে, কয়েক দিনের জন্য।
এয়ারপোর্টে যখন ইমিগ্রেশন পার হচ্ছিলাম, আমাকে ইমিগ্রেশন অফিসারটি বললেন, হাউ ইস ইউনূস? বিষয়টি বুঝতে আমার একটু সময় লেগেছিল। কারণ আমি প্রফেসর ইউনূসের আত্মীয় কিংবা পরিচিত কেউ নই। তাকে সামনাসামনি দেখার সৌভাগ্যও আমার এ পর্যন্ত হয়নি। বড়জোর তার ভাই মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরকে দেখেছি আজিজ বই মার্কেটের বইয়ের দোকান, পাঠক সমাবেশে একাগ্রচিত্তে বইয়ের পাতা উলটাতে; যা হোক, সেদিন ইমিগ্রেশন অফিসারটির সঙ্গে অনেক আলাপ হয়েছিল। ইউনূসের কারণে বাংলাদেশের অনেক প্রশংসা করেছিলেন। ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামে যে প্রতিষ্ঠানটি তিনি শুরু করেছিলেন, সেই কিশলয়টি তিলে তিলে বটবৃক্ষে পরিণত করেছেন তিনি নিজেই।
জনপ্রিয়তার বিচারে সবচেয়ে জনপ্রিয় নোবেল হচ্ছে শান্তি ও সাহিত্যে। আর সেজন্যই অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশে যতটা নন্দিত ও নিন্দিত হয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তার চেয়ে কোনো অংশে কম নন্দিত ও নিন্দিত ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির সংবাদ শান্তিনিকেতনে পৌঁছায় ১৯১৩ সালের ১৩ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টায়। এ নোবেল পুরস্কারটি ১৯১৩ সাল থেকে তার মৃত্যু পর্যন্ত তাকে প্রেতের মতো অনুসরণ করেছে। রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির সংবাদে পুরো বাঙালি জাতি আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে। যেমনটি আমরা দেখেছি অধ্যাপক ইউনূসের ক্ষেত্রে। এ আনন্দ-উল্লাসের যথেষ্ট কারণও ছিল। রবীন্দ্রনাথের আগে এ অর্ঘ্যটি জুটেছিল যার কপালে, তিনি ছিলেন সে সময়ের একমাত্র ইংরেজ কবি হেনরি জেমস কিপলিং। কিপলিং তার লেখায় বাঙালিদের নিয়ে নিষ্ঠুর কটূক্তি ও উপহাস করেছিলেন। আর সেজন্য বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল পেলেন, তখন বাঙালি সমাজ ভাবল, এবার কিপলিং ও তাদের অনুসারীদের মুখে চুনকালি পড়ল। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, কিপলিংয়ের নোবেল প্রাপ্তিও যে ইংল্যান্ডে সমাদৃত হয়েছিল, তেমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। কোনো ইংরেজ লেখকই তাকে শ্রেষ্ঠ কবি হিসাবে স্বীকৃতি দেননি।
উপরন্তু অস্কার ওয়াইল্ড, সাংবাদিক গার্ডিনার, লেখক ম্যাক্স বীরবমসহ আরও অনেকে তার নোবেল প্রাপ্তির কঠোর সমালোচক হয়ে ওঠেন। ঠিক তেমনি সে সময় কলকাতায় রবীন্দ্রনাথেরও অনেক সমালোচক ও নিন্দুকের আর্বিভাব ঘটে। তার নিন্দুকরা বলতে শুরু করলেন, গীতাঞ্জলির ইংরেজি আসলে ইংরেজ লেখক পিয়ারসনের, রবীন্দ্রনাথের নয়।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে পর্দার আড়ালের কিছু কথা পাঠকদের জানানো প্রয়োজন। যে সালে রবীন্দ্রনাথ নোবেল লাভ করেন অর্থাৎ ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর যে দুজন এ পুরস্কারের হকদার ছিলেন, তারা হলেন-বিখ্যাত লেখক থমাস হার্ডি ও ফরাসি লেখক এমিল ফাগে। নোবেল কমিটি ভেতরে ভেতরে ফাগকে যখন নোবেল দেবে বলে এক ধরনের সিদ্ধান্তটি চূড়ান্ত করে ফেলেছেন, ঠিক সে সময়ে ইংরেজ লেখক স্টাজ মুয়র, যিনি কবি ইয়েটসের সঙ্গে গীতাঞ্জলি প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তিনি সুইডিশ কবি ও নোবেল কমিটির সদস্য ভার্নার ভন হাইডেনস্টামকে অনুরোধ করেন, নোবেলটি যেন রবীন্দ্রনাথকে দেওয়া হয়। স্টাজ মুয়র হাইডেনস্টামকে পরামর্শ দেন এই বলে-রবীন্দ্রনাথ ও আপনি উভয়ই লিরিক কবি। আর যদি রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তি ঘটে, তবে হয়তো এর ধারাবাহিকতায় আপনিও একসময় নোবেল লাভ করতে সক্ষম হবেন। হাইডেনস্টামের সুপারিশের ওপর নির্ভর করেই নোবেল কমিটি রবীন্দ্রনাথকে পুরস্কারটি দিতে মনস্থির করেন। এর তিন বছর পর অর্থাৎ ১৯১৬ সালে সুইডিশ কবি হাইডেনস্টামও নোবেল লাভ করেছিলেন। এত কিছুর পরও ইতিহাস আজ এটাই সাক্ষ্য দেয়, নোবেল পুরস্কারটি পাওয়ার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথই ছিলেন থমাস হার্ডি কিংবা এমিলি ফাগের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও যোগ্যতম সাহিত্যিক। সে সময়ের রবীন্দ্রনাথের আরও কয়েকজন সমালোচকের নাম না বললেই নয়। যেমন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, কালীপ্রসন্ন সিংহ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও সুরেশচন্দ্র সমাজপতি। প্রথমেই জগদীশচন্দ্র বসুর বিরোধিতার কথা বলি।
২৩ নভেম্বর ১৯১৩ রবিবার বিকাল ৩টায় রবীন্দ্রনাথকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে বসু একটি ছোট্ট বক্তৃতা দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে একটি লজ্জাবতী লতা উপহার দেন। লজ্জাবতী লতা প্রদানের মাহাত্ম্য হচ্ছে আপনি নোবেল প্রাপ্তিতে অহংকারে উঁচু না করে লজ্জাবতী লতার মতো লজ্জায় অবনতমুখী হবেন। জগদীশচন্দ্র বসু ব্যক্তিগত ঈর্ষার কারণেই এমন নিুশ্রেণির মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। মিস্টার বসু এ ধরনের কাজ না করলেও পারতেন। কারণ আমরা সবাই জানি, রবীন্দ্রনাথ এমনিতেই একজন অন্তর্মুখী ও বিনয়ী মানুষ ছিলেন।
রবীন্দ্র নিন্দুকদের মধ্যে সবচেয়ে নিচু ও নিষ্ঠুর ছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি একটি কবিতা রচনা করলেন। যার কয়েকটি লাইন হলো এরকম-‘উড়িস নে রে পায়রা কবি/খোপের ভিতর থাক ঢাকা/তোর বকবকম আর ফোঁসফোঁসানি/তাও কবিত্বের ভাব মাখা/তাও ছাপালি গ্রন্থ হল/নগদ মূল্য এক টাকা!!’। ধনধান্য পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা, গানটি হয়তো সবাই শুনেছেন। গানটির রচয়িতা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। আর এ বিখ্যাত সাহিত্যিকই ছিলেন কঠোর রবীন্দ্রবিদ্বেষীদের একজন। আর তার এ বিদ্বেষের কারণও কারও অজানা ছিল না।
রবীন্দ্রনাথ দ্বিজেন্দ্রলালের নাটকের প্রশংসা করতে পারেননি বলে দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য ঘটে। এবার আসি সুরেশচন্দ্রের বিরোধিতা প্রসঙ্গে। তিনি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দৌহিত্র। আর সেজন্য তিনি মনে করতেন, বাংলা সাহিত্যের অভিভাবক হওয়ার একমাত্র হকদার তিনিই। কিন্তু সুরেশচন্দ্রের না ছিল মেধা, না ছিল যোগ্যতা। নিতান্ত ব্যক্তিগত ঈর্ষাপরায়ণতার কারণেই তিনি রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারটির বিরোধিতা করতেন। আর আমি যখন দেখি বাংলাদেশের কেউ কেউ বলেন বিদেশিদের সঙ্গে বসে ওয়াইন ও চিজ খেলেই নোবেল পাওয়া যায়, তখন আমি তাদের চেহারায়ও সুরেশচন্দ্র গংয়ের প্রতিচ্ছবিই দেখতে পাই।