সাক্ষাৎকারে রিজভী: সংস্কার ও নির্বাচন যেন প্রলম্বিত না হয়
তারিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ পিএম
ফাইল ছবি
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এ সরকারের এক মাস পূর্ণ হয়েছে। অল্পদিনের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে নানা মহলে চলছে আলোচনা।
দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী জানিয়েছেন, নতুন সরকারের অঙ্গীকার এবং বাস্তবায়নের মধ্যে মিল রয়েছে। তার বিশ্বাস, খুব দ্রুত পরিস্থিতির আরও উন্নতি ঘটবে। তবে রাষ্ট্রীয় সংস্কার ও জাতীয় নির্বাচন যেন প্রলম্বিত না হয়, তা মাথায় রেখে সরকারকে একটি যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে যে সংস্কার কার্যক্রম করা দরকার, তা করতে হবে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দিয়েছে, যা বাংলাদেশের মানুষ ভালোভাবে নিচ্ছেন না। বাংলাদেশ সরকারের কাছে দ্রুত তাকে হস্তান্তর করা উচিত। খালেদা জিয়া জনগণের কাছে দেওয়া অঙ্গীকার থেকে কখনো সরে যাননি। যে কারণে তিনি আপসহীন নেত্রী উল্লেখ করে বলেন, নিরন্তর নিপীড়নের মধ্য দিয়েও ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছে বিএনপি। আন্তর্জাতিক বিশ্বসহ সব মহলে এখন বিএনপির গুরুত্ব বাড়ছে।
তারেক রহমান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিছু অপকর্ম যারা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুতগতিতে যে পদক্ষেপগুলো নিচ্ছেন তাতে দেশের মানুষ ও আন্তর্জাতিভাবে প্রশংসা পাচ্ছেন। তারেক রহমান নেতৃত্বের গুণাবলি দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে বিএনপি একটি বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। রাজনীতির বাইরেও নীরবে-নিভৃতে তারেক রহমানের কাজগুলোও অভাবনীয়।
ছাত্রদের দল গঠন প্রসঙ্গে রিজভী বলেন, স্বতন্ত্র ছাত্রশক্তি হিসাবে থাকলে ‘হুইপিংয়ের’ কাজটা ভালো হতো। তাতে রাজনৈতিক দলগুলো সবসময় সচেতন থাকত। এই শক্তির কারণে দলগুলো ভাবত, বাড়াবাড়ি করা যাবে না।
রোববার বিকালে রাজধানীর আদাবরের বাসায় যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে রুহুল কবির রিজভী এসব কথা বলেন।
দেশের চলমান পরিস্থিতি, রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচন, ছাত্রদের দল গঠন, তারেক রহমানের নীরব জনসেবা ও মানবিকতার অজানা কথা, ভারতে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রসঙ্গসহ নানা বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন তিনি।
যুগান্তর : অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক মাস পূর্ণ হলো। সরকারের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন।
রিজভী : এক মাসের মধ্যে আসলে মূল্যায়ন করাটা খুব কঠিন। তবে তাদের অঙ্গীকার এবং বাস্তবায়নের মধ্যে মিল রয়েছে। আমার বিশ্বাস, খুব দ্রুত পরিস্থিতির আরও উন্নতি ঘটবে। চারদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সবকিছুর উন্নতি হচ্ছে। মানুষ আশাবাদী হয়ে উঠছে। এতে মনে হয়, সত্যিকার অর্থেই একটা রাষ্ট্র বা সমাজ যেমন হয়, সেদিকেই আমরা যেতে পারব।
যুগান্তর : উচ্চকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা, রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য, পরপর দুই মেয়াদের অতিরিক্ত কেউ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে নয়সহ রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের প্রতিশ্রুতির ৩১ দফা বিএনপি আগেই দিয়েছে। এসব দফা সরকারের কাছে দেবেন কি না বা দফাগুলো সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের চিন্তার সঙ্গে মিল দেখছেন কি না?
রিজভী : আমরা এখনো জানি না সংস্কারের ক্ষেত্রে সরকারের অন্তর্নিহিত ইচ্ছাগুলো কী। তবে আমাদের ২০৩০ ভিশনে যে কথাগুলো উল্লেখ আছে, সে ব্যাপারে আমরা খুব আশাবাদী। এ অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা সবসময় সক্রিয় থাকব এবং দাবিটা অব্যাহতভাবে থাকবে। সরকার চাইলে বা স্বেচ্ছায়-সবদিক থেকেই এটা উপস্থাপন করা যেতে পারে।
যুগান্তর : রাষ্ট্র সংস্কারের মধ্য দিয়ে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি রাজনৈতিক দলগুলোর। বিএনপি বলছে এজন্য যৌক্তিক সময় দেবে। সেই যৌক্তিক সময় কতদিন হতে পারে?
রিজভী : আসলে দিন-তারিখটা এ মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। তবে বেশি দিন যেন প্রলম্বিত না হয়, সেটা মাথায় রেখে একটি যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে যে সংস্কার কার্যক্রম করা দরকার, তা করতে পারে। নির্বাচন কমিশনসহ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যা রয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে একটা কংক্রিট আইন প্রণয়নের জায়গায় আসতে হবে। তাহলে যাতে ভবিষ্যতে কেউ ইসিকে হাতের মুঠোর মধ্য নিয়ে তাদের দলীয় কাজে ব্যবহার করার সাহস না পায়। তখন রাজনৈতিক দলগুলোর তো আর কোনো দাবি থাকবে না। সেক্ষেত্রে কিছুটা আশা জাগিয়েছিল নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায়। যে প্রক্রিয়াই হোক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব বড়। সেই দায়িত্ব যাতে যথাযথভাবে পালন করতে পারে, এর নিশ্চয়তা একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে রাখতে হবে। সেটাই এ মুহূর্তের প্রধান কাজ বলে আমি মনে করি।
যুগান্তর : সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেছেন। প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ফেরত না চাওয়া পর্যন্ত ভারত যদি তাকে (শেখ হাসিনা) রাখতে চায়, তাহলে শর্ত হতে পারে যে তাকে চুপ থাকতে হবে। ভারতে বসে তিনি কথাবার্তা বলছেন এবং দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। কেউ এটা পছন্দ করছেন না। এটা আমাদের বা ভারতের জন্য ভালো নয়।’ আপনি কী মনে করছেন।
রিজভী : আমি মনে করি, তিনি (ড. ইউনূস) যেটা বলেছেন, যথার্থই বলেছেন। অবৈধ ক্ষমতা দখলে রেখে শেখ হাসিনা এমন অপরাধ করেছেন, বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ রাখার জন্য গুম-খুনের যে কর্মসূচি চালিয়েছেন, সর্বশেষ জুলাই-আগস্ট গণহত্যা। ওনার বিচার করতে হবে, এটা যৌক্তিক দাবি। পৃথিবীর যেসব দেশে মানবতাবিরোধী-গণহত্যাকারী শাসক ছিল, তাদের যেভাবে বিচার হয়েছে, তেমনই শেখ হাসিনারও বিচার হওয়া দরকার। ভারত আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। আমরা মনে করি, সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক নিয়েই থাকব। বাংলাদেশের একজন অপরাধীকে এভাবে আশ্রয় দেবেন, সেটা বাংলাদেশের মানুষ ভালোভাবে নিচ্ছেন না। বাংলাদেশ সরকারের কাছে তাকে হস্তান্তর করা উচিত।
যুগান্তর : ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। আপনি কি মনে করেন বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘ ত্যাগের পটভূমিতেই ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থান।
রিজভী : অবশ্যই। এ আন্দোলন বিগত ১৫-১৬ বছরের যে নিরন্তর সংগ্রাম, গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা-এ ভয়কে মাথার মধ্যে রেখেই নেতাকর্মীরা ক্রমাগতভাবে লড়ে গেছেন। সাধারণ জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট-স্বৈরাচার। যে কারণে আগে থেকে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। তার ওপর শেষ আঘাত দিয়েছে ছাত্র-জনতা। অগ্রভাগে থেকে তারা নেতৃত্ব দিয়ে, বিজয় অর্জন করেছেন। সেটা ওই আন্দোলনের পটভূমির ওপরই রচিত হয়েছে।
যুগান্তর : ২০১৮ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যান। নেতারা অনেক সভায় বলেছেন, তাকে সাজা দিয়ে কারাগারে নেওয়া হবে তা আগেই চেয়ারপারসন জেনেছিলেন। সমঝোতা করে বিদেশে যেতে পারতেন; কিন্তু দেশ ছেড়ে যাননি। আপনার মন্তব্য কী?
রিজভী : হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তার অধীনে যারা নির্বাচনে যাবেন, তারা জাতীয় বেইমান হবে। পরে তিনি নিজেই জাতীয় বেইমান হলেন। কারণ, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঘোষণা দিলেন যে নির্বাচনে যাচ্ছেন। তখন থেকেই আমরা দেখেছি, খালেদা জিয়া জনগণের কাছে দেওয়া অঙ্গীকার থেকে কখনো সরে আসেননি। এটা হচ্ছে তার কিংবদন্তিতুল্য ভূমিকা, আপসহীন নেত্রী। এ কারণেই তখন থেকে তরুণ-ছাত্র-জনতা, বিশেষ করে তরুণরা তার নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল এবং আকৃষ্ট হয়েছে। যখনই তিনি যে নির্দেশ দিয়েছেন, তখনই সেই নির্দেশ পালন করতে তারা দ্বিধাবোধ করেননি। জনগণের মধ্যেও একটা দৃঢ়বিশ্বাস খালেদা জিয়া যা বলেন, সেখান থেকে তিনি সরে আসেন না। এটা হচ্ছে তার বৈশিষ্ট্য। সুতরাং এ কারণেই খালেদা জিয়া মানুষের কাছে সর্বাধিক জনপ্রিয়।
যুগান্তর : রাজনীতির বাইরে ‘মানবহিতৈষী’ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তিনি হাজারো অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, দায়িত্ব নিয়েছেন হাজারো পরিবারের। একেবারে নীরবে তার এই মানবসেবার কাজ করে যাচ্ছেন। নীরব জনসেবা, মানবিকতার অদেখা দৃষ্টান্ত সম্পর্কে বিস্তারিত জানাবেন?
রিজভী : তারেক রহমান নীরবে-নিভৃতে যে কাজগুলো করতেন, সেগুলো হয়তো কিছু জানছি, আরও কিছু কাজ আছে, যেগুলো আমরা এখনো জানি না। একটি পরিবারে, বাবা-মা মারা গিয়েছে, এরকম একটা ঘটনা-সে পরিবারের একটি মেয়েকে আজ দীর্ঘদিন তার লেখাপড়া, খরচ তিনি দিচ্ছেন। এই একটা দৃষ্টান্তের কথা বললাম। এরকম হাজারো পরিবারের খরচ তিনি চালাচ্ছেন। তারেক রহমানের অনেক মানবসেবামূলক কাজের কথা শুনে আমাদেরও চোখে পানি এসেছে। অথচ তিনি বহু বছর ধরে তাদের সহযোগিতা করে আসছেন। অনেকে আন্দোলন করতে গিয়ে গুলি খেয়ে হাত-পা হারিয়েছেন, তাদের কৃত্রিম হাত ও পা লাগানোর ব্যবস্থা করেছেন। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু লোককে অনেক আগে থেকেই উদ্বুদ্ধ করে এ কাজগুলো করতেন। গুম-খুনের শিকার পরিবারগুলোকে নিজের পরিবারের মতো আগলে রেখেছেন তিনি। এ তো বড় ধরনের মানবিক কাজ। মানবহিতৈষী এ কারণেই তাকে বলা যায়, লোকদেখানো কাজের চেয়ে নীরবে-নিভৃতে তারেক রহমান যে কাজগুলো করেছেন, তা অভাবনীয়। দৃশ্যমান যে ঘটনাগুলো দেখছি, গ্রেফতার হলে তার পরিবারের পাশে দাঁড়ানো, গুলিবিদ্ধ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় সেবা, ওষুধ-সবকিছু তিনি লক্ষ রাখছেন বাইরে থেকে। মিডিয়ায় দেখেই তিনি দায়িত্ব নেন। এটা অসাধারণ কাজ, যেটা উনি পারেন। এখন ‘আমরা বিএনপি পরিবার’ নামের একটি সংগঠনের মাধ্যমে মানবসেবার কাজগুলো করছেন।
যুগান্তর : দেশে-বিদেশে কূটনৈতিকসহ সব মহলে বিএনপির গুরুত্ব বাড়ছে বলে মনে হয়।
রিজভী : নিঃসন্দেহে। ম্যাডাম মুক্তি পাওয়ার পর বিভিন্ন দেশের হাইকমিশনার বা রাষ্ট্রদূতরা দেখা করছেন। দেশনায়ক তারেক রহমান প্রতিনিয়ত যে বক্তব্যগুলো দিচ্ছেন, তা অত্যন্ত মানবিক আপিল। নেতাকর্মীদের সবসময় বলছেন, তোমরা কেউ বেপরোয়া আচরণ কর না, তোমাদের দ্বারা মানুষের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। তোমাদের কাজকর্মে কেউ যেন ব্যথিত না হয়-এসব দিক দেখতে হবে। কিছু অপকর্ম যারা করেছে, তাদের কিন্তু তিনি শক্ত হাতে দমন করেছেন। এ কাজগুলোর কারণে আজ আন্তর্জাতিক দৃষ্টিটা বিএনপির ওপর বেশি নিবদ্ধ হচ্ছে। বিএনপিকে যেভাবে চিত্রিত করেছিল গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনা, কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে ভিন্নচিত্র। তারেক রহমান নেতৃত্বের গুণাবলি দিয়ে প্রমাণ করেছেন বিএনপি একটি বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। আন্তর্জাতিক দৃষ্টি এখন তার দিকেই বেশি।
যুগান্তর : নিরন্তর নিপীড়নের মধ্য দিয়ে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছে বিএনপি। এর নেপথ্যে কার ভূমিকা?
রিজভী : নেপথ্যে হচ্ছে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া। তার যে অদম্য সাহস এবং কোনো চাপের মুখে নতি স্বীকার না করার সহজাত বৈশিষ্ট্য, গোটা জাতি ও নেতাকর্মীদের উব্ধুব্ধ করার তার যে একটা বিশাল ক্ষমতা-এসবের প্রভাব পড়েছে। আবার উনি যখন কারাগারে যান, তখন একই কাজটা করলেন দেশনায়ক তারেক রহমান। তিনি দিনরাত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে এই দলকে আজকে একটা ধ্বংস্তূপের মধ্য থেকে জাগিয়ে তুলেছেন। দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীকে স্কাইপের মাধ্যমে তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত কেউ তার দৃষ্টির বাইরে যেতে পারেনি। এসব মিলিয়ে এই দুজনের নেতৃত্বে এই দল আবারও পুনর্গঠিত হয়েছে, এ দল পুনরুজ্জীবিত।
যুগান্তর : ছাত্র-জনতা গণহত্যার সঙ্গে জড়িতরা বেশির ভাগই এখনো অধরা। আপনার মন্তব্য কী?
রিজভী : জড়িতদের ধরার কাজ, বিচারের মুখোমুখি করার কাজ সরকারের। তারাই তা করবে। যারা নিষ্ঠুর-নিপীড়ন চালিয়েছে, তাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। খুব দ্রুত তাদের বিচারের আওয়ায় আনতে হবে। শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
যুগান্তর : ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র বাংলাদেশে নানা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?
রিজভী : ভারতকে প্রথমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে। যদি শ্রদ্ধা না দেখায়, তাহলে মনে হবে যে বাংলাদেশের ওপর তারা আধিপত্য কায়েম করছে। ভারতের পলিসি মেকার যারা আছেন, তাদের এ বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী যে কথাটা বলেছেন, তা অত্যন্ত ইঙ্গিতপূর্ণ। কারণ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ হচ্ছে, হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে তো কারও সঙ্গে যুদ্ধ হচ্ছে না। একজন স্বৈরাচার ছিল, তাদের ছাত্র-জনতা তুমুল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরাজিত করেছে। এটা তো অভ্যন্তরীণ বিষয়। পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলন হচ্ছে, এটা কি যুদ্ধ? তা তো ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশ তো একটি শান্তিপূর্ণ দেশ, এখন সবাই স্বস্তিতে আছে। বাংলাদেশের সঙ্গে কাদের কী? ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যকে মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে একধরনের আধিপত্যের সুর বেজে ওঠে। এটা থেকে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।
যুগান্তর : বিএনপির নেতাকর্মীরা নানা অপকর্ম করছেন বলে আভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে দলের অবস্থান কী?
রিজভী : এটা অনেকটাই অপপ্রচার। মূল বিষয়টা হচ্ছে আমার সন্তান যদি অপরাধ করে, তাকে যদি শাস্তি দিই, তাহলে পিতা হিসাবে একটা মেসেজ যাবে সবার কাছে যে পিতা খুব কড়া, তার সন্তান অপরাধ করেছে ছাড়েনি। সেখানে কেউ কেউ অপকর্মে লিপ্ত। নিরন্তরভাবে আমরা কাজ করছি। তারপরও বিভিন্ন জায়গায় যে ঘটনাগুলো ঘটছে, সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বহিষ্কার, পদ স্থগিত, শোকজ ক্রমাগতভাবে চলছে। মনে হয়েছে, এ পদক্ষেপগুলো নেওয়া না হলে মাত্রা আরও বাড়ত। ১৫-১৬ বছরে আমাদের অনেক নেতাকর্মীর বাড়িঘর দখল করেছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠার দখল করেছে, দোকানপাট দখল করেছে। ক্ষোভ থাকাটা তো স্বাভাবিক। অনেকে ঢাকায় এসে সিএনজি ও রিকশা চালিয়েছে, নাইটগার্ডের চাকরি করেছে। ৫ আগস্টের পর তারা সবাই বাসায় ফিরেছে। তাদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ থাকতেই পারে, এটা অমূলক নয়। কিন্তু তারপরও শক্ত হাতে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করছি। এই যে পদক্ষেপের কথাগুলো দু-একটা মিডিয়া ছাড়া অন্যগুলো প্রচার করছে না। শুধু কে কী করেছে, তাই লিখছে। সত্য সংবাদ ছাপাবেন, কে কী করছে দলের নাম দিয়ে যেটাও বলবেন এবং এ ব্যাপারে দলের পক্ষ থেকে দ্রুত যে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তাও দিবেন। এটাও থাকা উচিত। হতে পারে আওয়ামী লীগ একটা দল ছিল সেটা তো বিদায় নিয়েছে, এখন বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে তাকে জনগণের চেখে একটা নেগেটিভ অবস্থান তৈরি করা যায় কি না, কেউ কেউ চেষ্টা করছে বলে মনে হয়। এটাতে আর লাভ নেই। দ্রুতগতিতে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হচ্ছে তাতে মানুষ প্রশংসা করছে।
যুগান্তর : গুঞ্জন রয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি নতুন দল গঠনের। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন।
রিজভী : একটি দল যে কেউ করতে পারে, বানাতে পারে। তবে আমার যেটা মনে হয়, সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তারা যে কৃতিত্বটা অর্জন করেছে, সেটা যদি দলনিরপেক্ষ তাদের একটা শক্তিশালী অবস্থান থাকত, তাহলে তারা হুইপিংয়ের কাজটা ভালো করত। তাতে রাজনৈতিক দলগুলো সবসময় সচেতন থাকত যে, না একটি শক্তি আছে, যে শক্তির কারণে কিন্তু বাড়াবাড়ি করা যাবে না। রাষ্ট্রের ভালো কিছু করব-এই ভাবনা থেকে রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারে। সেই স্বাধীনতা তো গণতন্ত্রে আছেই। কিন্তু আমার অভিমত ছিল, তারা যদি একটা স্বতন্ত্র ছাত্রশক্তি হিসাবে থাকত, তাহলে হুইপিংয়ের কাজটা তাদের দিয়ে ভালো হতো।
যুগান্তর : এ মুহূর্তে বিএনপির প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী?
রিজভী : এ মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ঘটে যাওয়া আন্দোলনের যে বিজয়, তা সংহত করে সংগঠনকে গুছিয়ে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে যাওয়া। যে পরিবেশের কারণে জনগণ ভোট দিতে যায়নি, সেই পরিবেশটা থাকবে না, সেই নিশ্চয়তা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে পেতে চাই। সেই কাজটি করবে বলে আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস।
যুগান্তর : বর্তমান পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীদের প্রতি দলের কোনো নির্দেশনা আছে কি না?
রিজভী : সবাই সংযত আচরণ করুন। কেউ বাড়াবাড়ি করবেন না কোনো ক্ষেত্রেই। কারণ, পরিস্থিতি সবসময় একরকম থাকে না। পরিস্থিতি নানা সময়ে নানাদিক হতে পারে। আমাদের বড় শক্তি হচ্ছে জনগণ। সে কারণে জনগণ যাতে বিরক্তবোধ না করে, সেজন্য সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সচেতন থেকে কাজ করতে হবে। নিয়মমাফিক যে সাংগঠনিক তৎপরতা-কার্যক্রম ও রাজনৈতিক যে বিষয়গুলো বলা দরকার, সেগুলো বিএনপি নেতৃবৃন্দ ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা বলবেন। শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক উপায়ে সংগঠন করে যাব।
যুগান্তর : সময় দেওয়ার জন্য যুগান্তরের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ।
রিজভী : আপনাকে এবং যুগান্তরের সব পাঠককে আমার পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ।