সরকারের অগ্রাধিকার খাত নিয়ে সিপিডির সংলাপ
ব্যাংকিং খাতের জালিয়াতি কল্পনার বাইরে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৪, ০৪:৪৯ এএম
শিক্ষার্থীদের বিপ্লবের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে প্রাধান্য দিতে হবে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে-আন্দোলন চলাকালীন ঘটে যাওয়া অপরাধে দায়ীদের স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচার নিশ্চিত করা। অন্যটি-রাষ্ট্র এমনভাবে সংস্কার করতে হবে, যাতে কোনো স্বৈরাচার আর ফিরে আসতে না পারে। এক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য স্বাধীন কমিশন গঠন করা জরুরি। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে তিন মাসের মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নিতে হবে।
বুধবার রাজধানীর হোটেল লেকশোরে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন। সংলাপের বিষয় ছিল ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’। সিপিডি নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
বক্তারা বলেন, গত কয়েক বছরে দেশে তিন ধরনের অপরাধ হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-মানবতাবিরোধী, ফৌজদারি ও অর্থনৈতিক অপরাধ। মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে সাত শতাধিক মানুষ নিহত এবং হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। এই নিহতের ঘটনায় ফৌজদারি অপরাধ হয়েছে। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করেছিল। আর অর্থনৈতিক অপরাধ হলো দেশ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার হয়েছে।
সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, প্রশাসনকে বিগত সরকারের দোসরমুক্ত করতে হবে। তারা প্রশাসনে ঘাপটি মেরে আছে। প্রধানমন্ত্রীর পালানোর পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। কোটা আন্দোলনের সহিংসতায় প্রায় ৭০০ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচার করতে হবে। আর যাদের কারণে হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধে বিচার করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আর রাষ্ট্রীয় বাহিনী থাকেনি-দলীয় বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে গেছেন। অনেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হেফাজতে আছেন। তবে কারা হেফাজতে আছেন, তা জানা দরকার। কারণ, গ্রেফতার হয়ে থাকলে আদালতে হাজির করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যারা হেফাজতে, তাদের নাম প্রকাশ করা হোক। তারা যাতে বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারেন, বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’ তিনি আরও বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আশু করণীয় হলো মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ীদের বিচার করা। তার মতে, কতগুলো ফৌজদারি অপরাধ হয়েছে। এরও বিচার হওয়া দরকার। অর্থনৈতিক অপরাধ হয়েছে, এরও বিচার হওয়া দরকার। যেনতেন তদন্ত হলে চলবে না, নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের সঠিক বিচার করা দরকার।’
পুলিশবাহিনীকে দলীয় থেকে সরকারি বাহিনী করা দরকার উল্লেখ করে সুজনের সম্পাদক বলেন, ‘যারা প্রাথমিকভাবে নিপীড়নের দোসর ছিল, তাদের বাদ দিয়ে বঞ্চিতদের নিয়ে বাহিনীর সংস্কার করা জরুরি। আরেকটি বিষয় হলো প্রশাসন, সেখানেও সংস্কার জরুরি। পিএসসি পরীক্ষায় অনেকে উত্তীর্ণ হলেও পুলিশ ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে নিয়োগ আটকে দেওয়া হয়েছে। যে কোনো নিয়োগে পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। উপদেষ্টা পরিষদের সফল হতেই হবে। তারা ব্যর্থ হলে আমরাও ব্যর্থ হয়ে যাব।’ ড. বদিউল আলম বলেন, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ পদ্ধতিটা সঠিক হয়নি। হাইকোর্ট থেকে সরাসরি প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর এখন অনেকে প্রধান বিচারপতি হওয়ার জন্য ধরনা দেবেন। উচিত ছিল নতুন প্রধান বিচারপতিকে একদিনের জন্য হলেও পদোন্নতি দিয়ে আপিল বিভাগে নেওয়া যেত। এরপর আপিল বিভাগ থেকে প্রধান বিচারপতি করা যেত।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম বলেন, আন্দোলন শুরুর দাবিটা শিক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আমরা চেয়েছিলাম শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য দূর হলে পুরো সমাজে এর প্রভাব পড়বে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সব খাতের বৈষম্য নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়। তিনি বলেন, এখন আইনশৃঙ্খলা সবার আগে ঠিক করা দরকার। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্কার প্রয়োজন। সবচেয়ে বেশি গোয়েন্দা বিভাগের দিকে নজর দেওয়া উচিত। আমাদের যখন নেওয়া হয়, তখন গোয়েন্দা বিভাগের দুর্নীতি নজরে এসেছে। একটা আয়নাঘরের খবর জেনেছি। গোয়েন্দা বিভাগে আর কোনো আয়নাঘর আছে কি না, সেটা দেখতে হবে। তিনি বলেন, ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউট সবচেয়ে খারাপ হাতিয়ার। ওই সময়ে অনেক জঘন্যতম অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আইটি খাতে। আর রাজনীতিকদের কাছে অনুরোধ আপনারা ক্যাডার বাহিনী তৈরি করবেন না। আমাদের এমন সিস্টেম থাকা দরকার, কোনো সরকারই যেন ক্যাডার বাহিনী তৈরি না করতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা এমন সিস্টেম তৈরি করেন যাতে ক্যাডার বাহিনী তৈরি না হয়।
সাবেক সিএজি মুসলিম চৌধুরী বলেন, বর্তমান সংবিধানে স্বৈরাচারী হওয়ার অনেক উপাদান আছে। এগুলো বাদ দিতে হবে। কিন্তু তা রাজনৈতিক দলের হাতে ছেড়ে দিলে আমরা ব্ল্যাকহোলে পড়ে যাব। তিনি বলেন, একনায়কতান্ত্রিক উপাদান বাদ দিতে হবে। স্থানীয় সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে আলাদা করতে হবে। তার বক্তব্য চলাকালীন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম প্রশ্ন করেন, আপনি কি সংবিধানের সংশোধন চাচ্ছেন নাকি নতুন করে লিখতে বলছেন। এ প্রশ্নের জবাবে মুসলিম চৌধুরী বলেন, এ সংবিধান সংশোধন সম্ভব না, এটাকে আবার লিখতে হবে। এর ব্যাখ্যায় সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমরা তো এ রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নিয়েছি। এর মানে আমাদের সংবিধান এখনো আছে। এখন এটাকে বাদ দেবে নাকি সংস্কার করবে, এটার সিদ্ধান্ত নিতে হবে এ সরকারকে।
সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত সাফল্য ধরে রাখতে হলে তাদের লেখাপড়ায় ফিরে যেতে বলা যথেষ্ট নয়, একটি কাঠামোর মাধ্যমে অন্তঃপর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা জরুরি। তিনি বলেন, ১৯৯০ সালে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে একটি পথনকশা তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু পরে সেটা ধ্বংস করা হয়েছে। আকাক্সক্ষা পূরণ হয়নি। এবারের শিক্ষার্থী-গণআন্দোলনের মাধ্যমে যে আকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছে, যে সংস্কার কার্যক্রমের কথা বলা হয়েছে, এর মাধ্যমে একটি অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। এটা করতে হলে যে শিক্ষার্থীরা এ অভ্যুত্থান করল, তাদের উপস্থিতি জরুরি।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, সরকারের সবাই পদত্যাগ করেছে; কিন্তু সচিবদের কেউ পদত্যাগ করেননি। এটা দেখতে হবে। এতগুলো মন্ত্রণালয় ড. ইউনূসের নিয়ন্ত্রণে রাখার দরকার নেই। এসব সরকারের অনেকের ভিত্তি এনজিও। সরাসরি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মাত্র তিনজন। যারা ভালো রাজনীতি বোঝেন, যারা প্রশাসন বোঝেন, তাদের সরকারে রাখতে হবে। তা না হলে প্রশাসন বুঝতে বুঝতেই সময় চলে যাবে। সংবিধান কমিশন করার তাগিদ দিয়ে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ওই কমিশন একটি সংবিধান লিখবে, পরবর্তী সরকার সেই সংবিধান অনুমোদন দেবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, পাঠ্যপুস্তক এত বেশি দলীয় করা হয়েছে, তা অবশ্যই ভাঙতে হবে। শেখ রাসেল ডিজিটাল প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হওয়া উচিত। আর শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনায় অভিভাবকদের সম্পৃক্ত করতে হবে। তার মতে, বাংলাদেশে এক শিক্ষার্থীর পেছনে প্রতিমাসে ৩শ ডলারও খরচ হয় না। কিন্তু পাশের দেশ ভারতেও ৩ হাজার ডলারের বেশি খরচ হয়।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘রাজস্ব আহরণের অপর্যাপ্ততা, সরকারি ব্যয় সংকুলানে ব্যর্থতা, এডিপি বাস্তবায়নে শ্লথগতি, ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের উচ্চমাত্রায় ঋণ দেশের অর্থনীতিকে চেপে ধরেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ, ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট, রপ্তানি আয়ে ধীরগতি, রেমিট্যান্স প্রবাহে মন্থরতা, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে স্থবিরতার মতো সমস্যাগুলোর দ্রুত অবসান করতে হবে। অর্থনীতির গতি আনতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অবক্ষয়, আমদানিতে ক্রমহ্রাসমান প্রবণতা, টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়ন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সমস্যাগুলো সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে।’ সামাজিক খাত পুনর্গঠনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম স্বাভাবিক করা, শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, শ্রমবাজারের চাহিদা ও দক্ষতার অসামঞ্জস্যতা দূর করার তাগিদ দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষা খাতের পুনর্গঠনের সঙ্গে কর্মসংস্থান, বিশেষত যুব কর্মসংস্থানের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।’ সিপিডির একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে ড. ফাহমিদা বলেন, ‘যুব বেকারত্বের পেছনে অপ্রতুল চাকরির সুযোগ, শিক্ষার নিুমান ও দক্ষতার অমিল, উদ্যোক্তা হওয়ার সীমিত সুযোগ, নারী চাকরিপ্রার্থীদের সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট সুবিধার অভাবের মতো বিষয়গুলো রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়া ঘুস ও দুর্নীতির কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে আসা, অভিজ্ঞতার অযৌক্তিক প্রয়োজনীয়তা, সরকারি চাকরির জন্য অপেক্ষা ও আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে যুবকদের বড় একটা অংশ বেকার থাকছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য তিন মাসের ভেতর জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নিতে হবে।’
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ফাহিম মাসরুর বলেন, যে বৈষম্য শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ করে এবং আন্দোলনের মতো ঐক্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে, তা হলো ২০১৭ সালের বৈষম্যমূলক পে-কমিশন। ২০১৭ সালে এক ধাপে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়। এর ফলে বেসরকারি কর্মীদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি হয়। বৈষম্য তৈরি হয় অর্থনীতিতে। সরকারি খাতে এত বেতন বাড়ানো হলো; কিন্তু সেই বেতন দেওয়ার মতো ক্ষমতা বেসরকারি খাতের ছিল না। ফলে সেখানে একধরনের অস্বস্তিতে পড়ে। এর থেকে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবি প্রাধান্য পায়। দানা বাঁধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। এই বৈষম্য দূর করতে হলে প্রয়োজনে সরকারি কর্মীদের বেতন কমিয়ে সরকারি-বেসরকারিদের সমান করতে হবে। ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আরএফ হোসেন বলেন, আপনারা শুনেছেন ব্যাংকিং খাতের অবস্থা খারাপ। কয়েকজন ঋণখেলাপির নাম শুনে আসছেন। কিন্তু এ অবস্থা কত খারাপ, তা কল্পনাও করতে পারবেন না। ব্যাংকিং খাতের লোক হিসাবে আমি বলছি, এখানে মাত্র কয়েকটি নাম নয়, এ ধরনের নামের অভাব নেই। ১৫ বছরে এ খাতের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে।