প্রতীকী ছবি
চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা এখন তুঙ্গে। মন্দার মধ্যেও এ পণ্যের দাম বাড়ছে। অথচ কয়েক বছর ধরে কুরবানির চামড়া কেনার জন্য দেওয়া ঋণের সিংহভাগই বছর শেষে ফেরত আসছে না। খেলাপি হচ্ছে। এ খাতের খেলাপি ঋণ নবায়নে বিশেষ সুযোগও দেওয়া হয়েছে একাধিকবার। তারপরও ঋণ নবায়ন হচ্ছে না। এভাবে চামড়া খাতের খেলাপি ঋণ স্ফীত হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, ব্যাংকগুলো এখন হাতে গোনা কয়েকজন ভালো উদ্যোক্তা ছাড়া অন্য কাউকে ঋণ দিতে চাচ্ছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চামড়া খাতে বর্তমানে ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৫১২২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ৪১৪৫ কোটি টাকা। মোট ঋণের প্রায় ৯১ শতাংশই খেলাপি। বাকি ৯ শতাংশ ঋণ নিয়মিত রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলোয় বিতরণ করা ঋণের ৯২ শতাংশই খেলাপি। খেলাপি ঋণের ৯৬ শতাংশ অনেক পুরোনো। এগুলোর মধ্যে ২৬০০ কোটি টাকা আদায় করতে না পেরে ব্যাংক অবলোপন করেছে।
চামড়া খাতের রপ্তানিতে ঋণ দেওয়া হয়েছে ২২০০ কোটি টাকা, চামড়াজাত পণ্যে দেওয়া হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। বাকি টাকা দেওয়া হয়েছে শিল্পঋণ ও চলতি মূলধন হিসাবে।
আশির দশকে এ খাতে যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর প্রায় সবই এখন খেলাপি। নব্বইয়ের দশকে কিছু ভালো উদ্যোক্তা এসেছেন, তারা এখন এ খাতের সফল ব্যবসায়ী। মূলত তাদের ঋণই নিয়মিত রয়েছে।
রপ্তানি খাতে সরকারি ব্যাংকগুলো দিয়েছে ১৮২০ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো দিয়েছে ৩৪ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংক ৪০০ কোটি এবং ইসলামী ব্যাংকগুলো দিয়েছে ২৯০ কোটি টাকা।
চামড়াজাত পণ্যে সরকারি ব্যাংক ৮৩০ কোটি, বিশেষায়িত ব্যাংক ২০ কোটি, বেসরকরি ব্যাংক ৫১০ কোটি এবং ইসলামী ব্যাংক ৭৫ কোটি টাকা দিয়েছে। বিদেশি ব্যাংকগুলো এ খাতে শুধু চলতি মূলধন ও ট্রেডিং খাতে কিছু ঋণ দিয়েছে।
চামড়া খাত ব্যাপক সম্ভাবনাময়। বিদেশে এ খাতটি বেশ প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে দুর্বল হচ্ছে। বিদেশে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে দাম। কিন্তু দেশের বাজারে কাঁচা চামড়ার দাম কমছে। ৫ বছরে দেশের বাজারে কাঁচা চামড়ার দাম কমেছে ২০ শতাংশ। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রক্রিয়াজত করা ভালো মানের চামড়ার দাম বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। ফলে চামড়াজাত পণ্যের দামও বেড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখা যায়, দেশে কাপড় ও জুতা খাতে খরচ গত দুই বছরের ব্যবধানে ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে সাড়ে ৯ শতাংশ হয়েছে।
বিভিন্ন সময়ে চামড়া খাতের ওপর তৈরি জরিপ প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, এ খাতে ঋণ নিয়ে উদ্যোক্তারা অন্য খাতে সরিয়ে নেন। তারা এ টাকায় অন্য ব্যবসা করছেন। সেসব ব্যবসা ভালো চললেও ঋণের টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। ব্যাংকও খেলাপি ঋণের বিপরীতে একটি মামলা করেই দায়িত্ব শেষ করেছে। যে কারণে এ খাতের খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না।
আগের চেয়ে এ খাতে জালজালিয়াতি কমলেও এখন কাঁচা চামড়া কেনার জন্য যেসব ঋণ দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর বড় অংশই ফেরত আসছে না। যে কারণে এবার ব্যাংকগুলো ঋণ দিচ্ছে কম। গত বছর এ খাতে ২৫৯ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়ছিল। ঋণ বিতরণের নয় মাসের মধ্যে এগুলো ফেরত দেওয়ার কথা। কিন্তু ফেরত এসেছে মাত্র ৯২ কোটি টাকা। বাকি টাকা ফেরত আসেনি। এগুলো এখন খেলাপি হওয়ার অপেক্ষায়। ২০২২ সালে ৪৪৩ কোটি টাকা বিতরণের বিপরীতে ফেরত এসেছে ১২৮ কোটি টাকা, ২০২১ সালে ৬১০ কোটি টাকার বিপরীতে ফেরত এসেছে মাত্র ২১৮ কোটি টাকা। ওই তিন বছরে ব্যাংকগুলো চামড়া খাতে ঋণ দিয়ছে ১৩১২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ফেরত এসেছে মাত্র ৪৩৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের মাত্র ৩৩ শতাংশ। বাকি ৭৭ শতাংশ অর্থই ফেরত আসেনি। উদ্যোক্তা ঋণের টাকা ফেরত না দিয়ে ঋণসীমা বাড়িয়ে নতুন ঋণ নিচ্ছেন। ফলে আগের টাকা আর ফরত আসছে না। আর ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক চাপে পড়ে ঋণসীমা বাড়িয়েই যাচ্ছে।
একটি সরকারি ব্যাংকে একজন ট্যানারি মালিকের ২০১২ সালে ঋণ সীমা ছিল ৩০ লাখ টাকা। সেই সীমা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ কোটি টাকায়। অর্থাৎ তিনি ১১ কোটি টাকা লেনদেন করতে পারবেন। ফলে তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। তা থেকে আগের কিস্তি পরিশোধ করেছেন। এভাবে নতুন ঋণ নিয়ে যাচ্ছেন। এবার তিনি নতুন ঋণের জন্য আবেদন করেননি। তিনি ঋণসীমা বাড়িয়ে ১২ কোটি টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এটি অনুমোদিত হলে তিনি ব্যাংক থেকে আরও ২ কোটি টাকা নতুন ঋণ নিতে পারবেন। এ কারণে ব্যাংকগুলো এ খাতে ঋণ দিতে চাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেছেন, চমড়া খাতে ঋণ দেওয়ার জন্য এবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো সমন্বয় করছে না। এবার ব্যাংক গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে এ খাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নিজ উদ্যোগেই ঋণ দিচ্ছে। ফলে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, চামড়া খাতে খেলাপি ঋণ নবায়ন করতে একাধিকবার ছাড় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু খেলাপি ঋণ নবায়ন হয়নি। উলটো আরও বেড়েছে খেলাপি ঋণ। ২০২১ সালে চামড়া খাতের জন্য মাত্র ২ শতাংশ এককালীন পরিশোধের মাধ্যমে ঋণ পুনঃতফশিল করে ১০ বছরের জন্য ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়।
চামড়া খাতে জালিয়াতি শুরু মিলন ট্যানারির মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানটি ঋণের টাকা দিতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে গেছে। ফলে ব্যাংক তাদের ২২৩ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করেছে। বেঙ্গল লেদারের ৪০ কোটি টাকা অবলোপন করেছে আরও একটি ব্যাংক। আরও একটি কোম্পানির ৬২ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করেছে। একটি সরকারি ব্যাংকে দুটি বড় প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে একটি কোম্পানির ১১০০ কোটি এবং অপর কোম্পানিটির খেলাপি ঋণ ১৮১০ কোটি টাকা।