প্রতীকী ছবি
এখন থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো গ্রাহক ঋণ জালিয়াতি করলে তিনি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হবেন। ঋণের টাকা অন্য খাতে স্থানান্তর, বন্ধকী জামানত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন ছাড়া স্থানান্তর বা সামর্থ্য সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ না করলে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হবেন। এভাবেই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ইচ্ছাকৃত খেলাপি হলে বিমানে চড়া যাবে না। ট্রেড লাইসেন্স, কোনো কোম্পানির নিবন্ধন, শেয়ার ছাড়ার অনুমোদন মিলবে না। একই সঙ্গে বাড়ি, গাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট কিনে নিবন্ধন করা যাবে না। অর্থাৎ কোনো কোম্পানি করে নতুন ব্যবসাও করা যাবে না। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হওয়া যাবে না। অন্যদিকে ব্যাংকবিধি ভঙ্গ করে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের ছাড় দিলে মোটা অঙ্কের জরিমানাসহ কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। গত মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করতে ও তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে যে নীতিমালা জারি করেছে তাতে এসব বিষয় রয়েছে।
নীতিমালাটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অনিয়ম বা জাল জালিয়াতি করে ঋণ নিয়ে খেলাপি হওয়ার পরও ইচ্ছাকৃত খেলাপির তালিকা থেকে বাদ যেতে কিছু সুযোগ রাখা হয়েছে। সংজ্ঞা অনুযায়ী কোনো ঋণ গ্রহীতা ইচ্ছাকৃত খেলাপির পর্যায়ে গেলে তাকে বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য ১৪ কর্মদিবস সময় দেওয়া হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ঋণ গ্রহীতা বক্তব্য প্রদানে ব্যর্থ হলে অথবা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণ গ্রহীতার দেওয়া বক্তব্য গ্রহণযোগ্য বিবেচিত না হলে তাকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা যাবে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অনুমোদন লাগবে। কোনো গ্রাহককে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে চূড়ান্ত করার পর সংশ্লিষ্ট ঋণ গ্রহীতাকে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে লিখিতভাবে অবহিত করতে হবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা হিসাবে চূড়ান্তকরণের বিষয়টি গ্রাহক কর্তৃক অবহিত হওয়ার পর এ বিষয়ে তিনি (গ্রাহক) সংক্ষুব্ধ হলে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আপিল করতে পারবেন। সংশ্লিষ্ট ঋণ গ্রহীতা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আপিল না করলে বা আপিল বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে আগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিদর্শনে গিয়ে জাল জালিয়াতি বা প্রতারণার প্রমাণ পেলে ওই ঋণকে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করতে পারে। জালিয়াতি করে ঋণ নিলে এর বিপরীতে যেমন যথাযথ জামানত থাকে না; তেমনি ওই ঋণ স্বল্প সময়ের মধ্যে পরিশোধের সুযোগও কম। ফলে গ্রাহক ঋণ পরিশোধের নোটিশ পেলেও তা করতে পারবেন না। যে কারণে নীতিমালা যথাযথভাবে প্রয়োগ হলে জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া ঋণ গ্রহীতা ইচ্ছাকৃত খেলাপির তালিকায় পড়ে যাবেন।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি ও এনসিসি ব্যাংকের সাবেক এমডি এম. নূরুল আমিন বলেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপি শনাক্ত করতে শুধু সংজ্ঞাই যথেষ্ট নয়। এ বিষয়ে ব্যাংকের ইউনিটকেও ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ফলে তারা ইচ্ছাকৃত খেলাপির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার দোহাই দিয়ে ঋণ আদায় করে নিতে পারে। তখন ওই গ্রাহক আর ইচ্ছাকৃত খেলাপি হবেন না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ব্যাংকের মূল দায়িত্ব হচ্ছে ঋণ আদায় করা। যে কোনো প্রক্রিয়ায় ঋণ আদায় হলে ব্যাংকের দায় শেষ। ঋণ বিতরণে ব্যাংকের কেউ অনিয়ম করলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। এখন টাকা আদায় হয়ে গেলে গ্রাহককে শাস্তি দেওয়ার বিষয়টি ব্যাংকের কাছে প্রাধান্য নয়। এ বিষয়টি সরকারের অন্যান্য সংস্থা দেখবে- যারা দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করে।’
নীতিমালা অনুযায়ী, সম্পদ বা আর্থিক সামর্থ্য থাকার পরও খেলাপি ঋণ পরিশোধ না করলে তিনি ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হবেন। এ কারণে সব বড় ঋণখেলাপিই ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। কারণ, বড় ঋণখেলাপিদের অঢেল সম্পদ রয়েছে। সম্পদশালীরাই সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপি হয়।
নীতিমালা অনুযায়ী ঋণের টাকা অন্য খাতে স্থানান্তর করলে তিনিও ইচ্ছাকৃত খেলাপি হবেন। বিশেষ করে দুর্নীতি করে যারা ঋণ নেন তারা এ কাজটি বেশি করেন। এক খাতের জন্য ঋণ নিয়ে ওই খাতে বিনিয়োগ না করে অন্য খাতে সরিয়ে ফেলেন। অনেকে পাচার করে দেন। ঋণের টাকা অন্য খাতে সরিয়ে সংশ্লিষ্ট খাতের জন্য গ্রাহক খেলাপি হয়ে পড়েন। আর ওই টাকা অন্য খাতে স্থানান্তর করে তিনি ব্যবসায় ফুলে ফেঁপে ওঠেন। বিলাসবহুল দামি বাড়ি গাড়ি কেনেন। ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণ করেন। পাঁচতারকা হোটেলে খাওয়া দাওয়া ও বিনোদন করেন। অথচ তিনি অন্য কোম্পানিতে খেলাপি।
ব্যাংকাররা বলেন, এ ধরনের সংস্কৃতি বন্ধ করতে হলে খেলাপি গ্রাহককে কোনো ক্রমেই নতুন ঋণ দেওয়া যাবে না। এটি বাস্তবায়ন করা খুব সহজ। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) এখন বেশ শক্তিশালী। বোতাম টিপেই ঋণখেলাপিদের তথ্য পাওয়া যায়। জাতীয় পরিচয়পত্র ও ঋণ গ্রহীতা শনাক্তকরণ নাম্বার (বরোয়ার আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার) বাধ্যতামূলক করায় বেনামে ঋণ নেওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়েছে। তার পরও কেউ বেনামে ঋণ নিলে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তা ছাড়া সম্ভব নয়। নতুন নীতিমালার আওতায় এসব অনিয়ম বন্ধ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে নীতিমালার কঠোর প্রয়োগ হলে ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাচার যেমন কমবে, তেমনি পাচার করা টাকা ফিরিয়ে এনে ঋণ সমন্বয় করা যাবে।
নীতিমালা অনুযায়ী, ঋণের বিপরীতে জামানত অনুমতি ছাড়া স্থানান্তর করলেও তিনি ইচ্ছাকৃত খেলাপি হবেন। এটি অনেক দুর্নীতিবাজ করে থাকেন। একই জামানত একাধিক ব্যাংকে বন্ধক রেখে ঋণ নেন। অনেক ক্ষেত্রে জামানত সরিয়ে ফেলেন বা ভুয়া জামানত দেন। এতে ঋণখেলাপি হলে ব্যাংক জামানত বিক্রি করে ঋণ আদায় করতে পারে না। এ কারণেও অনেক ঋণ খেলাপি হয়ে আছে।
ব্যাংকাররা মনে করেন, এর সঙ্গে নীতিমালায় আরও কিছু বিষয় যুক্ত করার দরকার। জামানতের অভিহিত মূল্যের চেয়ে কম জামানত পাওয়া গেলে, নিজের মালিকানা ছাড়া অন্য কারও জামানত তার সম্মতি ছাড়া দেওয়া যাবে না- এসব বিষয় যুক্ত করার দরকার ছিল। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা জানান, বিষয়টি প্রতারণার আওতায় পড়ে। প্রতারণা করলে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হবেন।