৬ দিনের রিমান্ডে এনামুর
কমিশন বাণিজ্যের কারিগর এপিএস শামীম অধরা
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান গ্রেফতার হলেও অধরা আছেন তার কমিশন বাণিজ্যের কারিগর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ডা. শামীম আহমেদ। নিজেকে ক্লিন ইমেজের মন্ত্রী হিসাবে জাহির করলেও আড়ালে ছিল তার ঘুস বাণিজ্যের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। প্রতিমন্ত্রী তার চার স্ত্রীর নামেও গড়ে তুলেছেন বিপুল সম্পদ। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে নেমেছে।
এদিকে রোববার রাতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে এনামুর রহমানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মিরপুরের হকার সাগর হত্যা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে তাকে সোমবার আদালতে পাঠানো হয়। শুনানি শেষে আদালত ছয়দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। অন্যদিকে এনামুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির এন্তার অভিযোগ সামনে আসছে। এ নিয়ে তার নির্বাচনি এলাকা সাভার-আশুলিয়ায় নানা গুঞ্জন চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এনামুর রহমান ছিলেন খুবই কৌশলী। তিনি সরাসরি কারও কাছ থেকে ঘুস না নিলেও এপিএস ডা. শামীম আহমেদের মাধ্যমে ঘুস বাণিজ্যের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। তখন বিশেষ বরাদ্দের নামে হরিলুট করা হয় রিলিফের অর্থ ও খাদ্যশস্য। গরিবের ঘর নির্মাণের জন্য কেনা ডেউটিন, শীতবস্ত্র (কম্বল), বন্যার সময় গোখাদ্য ও শিশুখাদ্য কেনার কাজেও তাকে কমিশন দিতে হতো। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) এবং জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ কর্মকর্তা (ডিআরও) বদলি বাণিজ্য করে হাতিয়ে নিয়েছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। এছাড়া অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান, মুজিবকেল্লা নির্মাণ, বজ পাত রোধে তালগাছ লাগানোসহ বিভিন্ন প্রকল্প থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকার কমিশন। এসব অপকর্ম, দুর্নীতি এনামুর রহমানের জ্ঞাতসারেই করতেন এপিএস ডা. শামীম আহমেদ।
আরও জানা যায়, কমিশনের মাধ্যমে কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা), কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) এবং গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন খাতের নিয়মিত বরাদ্দের পাপাপাশি বিশেষ বরাদ্দের ব্যবস্থা করতেন শামীম। বিশেষ বরাদ্দের বিপরীতে তিনি টনপ্রতি ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা আদায় করতেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রথম শ্রেণির উপজেলায় একজন পিআইও বদলিতে ১২ লাখ টাকা নেওয়া হতো। দ্বিতীয় শ্রেণির উপজেলায় বদলিতে নেওয়া হতো ৬ থেকে ৮ লাখ টাকা। এছাড়া প্রথম শ্রেণির জেলার ডিআরও বদলিতে নেওয়া হতো ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। দ্বিতীয় শ্রেণির জেলায় ডিআরও পোস্টিংয়ে নেওয়া হতো ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা। বদলি বাণিজ্যের মাধ্যমে শামীমের হাত হয়ে মন্ত্রীর পকেটে ঢুকেছে কোটি কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, এপিএস পদে নিয়োগের আগে টিউশন করে জীবন চলত শামীমের। তিনি এখন প্রায় ২০০ কোটি টাকার মালিক। তার নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হয়েছে। রাজধানীতে রয়েছে বাড়ি, ব্যবহার করেন দামি গাড়ি। তার মালিকানায় রয়েছে অ্যাগ্রো পার্ক এবং আরও সাতটি প্রতিষ্ঠান। নিজ এলাকা ময়মনসিংহের ত্রিশালের রানীগঞ্জ-পোড়াবাড়ী এলাকায় একাধিক গরু ও মাছের খামার গড়ে তুলেছেন। রানীগঞ্জে শত বিঘার ওপর করেছেন মাছের খামার। পোড়াবাড়ী এলাকায় প্রায় শত বিঘা জমির ওপর গড়ে তুলেছেন বেলা নামে একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট। ত্রিশালের বিভিন্ন ইউনিয়নে শামীম ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে ১২০ বিঘা জমি রয়েছে। সাভারের থানা রোড এলাকার একটি ভবনে রয়েছে দুটি ফ্ল্যাট। রাজধানীর গুলশানে নাভানা টাওয়ারে রয়েছে অফিস। এনামুর ধরা পড়লেও তার অপকর্মের কারিগর শামীম এখনো অধরা।
জানা যায়, দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদে ঢাকা-১৯ আসন থেকে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন এনামুর রহমান। তিনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ১১টি হত্যাসহ বহু মামলা রয়েছে। পুলিশকে ম্যানেজ করে তিনি ইতোমধ্যে দুটি হত্যা মামলা থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন বলে জানা গেছে। ৫ আগস্টের পর তৃতীয় স্ত্রী ডা. ফরিদা ইয়াসমিন প্রচার চালান ভারতের কাশ্মীরে ছোট ছেলের শ্বশুরবাড়িতে অবস্থান করছেন এনামুর। কিন্তু তিনি পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ঢাকাতেই গা-ঢাকা দিয়েছিলেন।
দুদক সূত্র জানায়, ২৩ সেপ্টেম্বর ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে এনামুর রহমানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। সংস্থাটির গোয়েন্দা ইউনিটের গোপন অনুসন্ধানে তার নিজ নামে নগদ জমা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৬ কোটি টাকার বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া এনাম মেডিকেল হসপিটাল প্রাইভেট লিমিটেড, এনাম এডুকেশন অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভিলেজ (প্রাইভেট) লিমিটেড এবং এনাম ক্যানসার হসপিটাল লিমিটেডে কয়েকশ কোটি টাকা বিনিয়োগের তথ্য আছে। তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের তালিকায় স্থাবর সম্পদ রয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার। সাভার, ধামরাই ও ময়মনসিংহ এলাকায় তার বিপুল সম্পদ রয়েছে বলে জানা গেছে। বিগত নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, ১০ বছরে তার সম্পদ বেড়েছে অন্তত ৫০০ গুণ। চার স্ত্রীর নামে বিপুল সম্পদ গড়ে তুললেও হলফনামায় তা উল্লেখ করা হয়নি।
হলফনামায় দেখা যায়, ২০২৩ সালে এনামুর রহমানের বার্ষিক আয়ের উৎস ছিল শেয়ার, সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংক আমানত (এফডিআর ও ব্যাংক থেকে সুদ) এবং চাকরি (প্রতিমন্ত্রীর সম্মানি ভাতা)। এক দশকের ব্যবধানে তার আয় বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ২০২৩ সালের হলফনামার তথ্যানুযায়ী, তার ১৫৮ কোটি টাকার অস্থাবর-স্থাবর সম্পদ রয়েছে। জানা যায়, চার স্ত্রীর নামে দেড়শ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাজ্যে তাদের রয়েছে বিপুল সম্পদ। রানা প্লাজা ধসের পর এনাম হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার ঘটনায় প্রথম আলোচিত ও প্রশংসিত হন এনামুর রহমান। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাজনীতির ময়দানে হাজির হয়ে ভাগ্য বদলান তিনি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসাবে প্রথমবার সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন।