হাছান মাহমুদ ঘনিষ্ঠ হওয়ায় প্রশাসন চলত কমলের ইশারায়
রামু (কক্সবাজার) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:০০ পিএম
হাছান মাহমুদ ঘনিষ্ট হওয়ায় প্রশাসন চলত কমলের ইশারায়
সাইমুম সরওয়ার কমল কক্সবাজার-৩ আসনের সাবেক প্রতাপশালী সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ সাইমুম সরওয়ার কমল। ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে একে একে তিনবার এমপি নির্বাচিত হন তিনি। এমপি হওয়ার পর তিনি আর থেমে থাকেননি। জড়িয়ে পড়েন অনিয়ম-দুর্নীতিতে। ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বেচ্ছাচারিতায় এলাকার মানুষের কাছে তিনি হয়ে উঠেন মূর্তিমান আতঙ্ক।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপির ঘনিষ্ট হওয়ায় স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ তার অঙ্গুলের ইশারায় চলত। এলাকায় তার কথাই যেন আইন। রামু মন্ডলপাড়াস্থ নিজের বাস ভবনের ২য় তলায় তৈরি করেন টর্চার সেল। সেই সেলে কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের দিয়ে প্রতিপক্ষ লোকজনকে শায়েস্তা করা হত। মতের বাইরে গেলেই ধরে নিয়ে গিয়ে কমলের টর্চার সেলে করা হত অমানুষিক নির্যাতন। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলে বিরোধীদলের লোকজনের পাশাপাশি নিজ দলের নেতাকর্মীদেরকেও অত্যাচার, নিপীড়ন করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। মৃদু প্রতিবাদেও ধ্বংস হয়ে যেত অনেকের ভবিষ্যৎ।
নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলে এলাকায় নৈরাজ্য, জমি দখল, বিচারের নামে চাঁদাবাজি, শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে মারধর-হুমকি প্রদর্শন, সীমান্তের গরু-মাদক পাচার ও কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণসহ নানা অপরাধের বিষয়েও সমানভাবে সমালোচিত এই জনপ্রতিনিধি।
কমলের দাপটে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারাও কোনঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। শত শত নিরীহ মানুষকে বছরের পর বছর মামলার গ্লানি টানতে টানতে সর্বশান্ত হতে হয়েছে। রামুর প্রবীন শিক্ষক সুনীল শর্মাকে জনসম্মুখে মারধর করে সংবাদের শিরোনামও হয়েছেন হুইপ কমল।
টর্চারসেলের পাশাপাশি বিরোধী মতকে দমন করতে গঠন করেছেন ২০ থেকে ৩০ জনের বেতনভূক্ত একটি সাইবার টিম। কোনো ব্যক্তি যদি এমপি কমলের অন্যায়-অসঙ্গতির বিষয়ে আপত্তি ও প্রতিবাদ জানাতো তখন সাইবার টিম দিয়ে ওইসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে নেতিবাচক পোস্ট দিয়ে সম্মানহানী ও চরিত্রহনন করা হত।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সাংসদ কমল আত্মগোপনে চলে গেলে মুখ খুলতে সাহস করেন নির্যাতনের শিকার অসংখ্য ভুক্তভোগী। দীর্ঘদিনের ভয় কাটিয়ে তারা তুলে ধরেন তাদের কার্যত জিম্মিদশার কথা।
রামু উপজেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক আবুল কাসেম বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় তার ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন হুইপ কমল। তার সন্ত্রাসীরা দাগী আসামির ন্যায় দুই হাত রশিতে বেঁধে পশুর ন্যায় টানতে টানতে আবুল কাসেমকে কমলের টর্চারসেলে নিয়ে যায়। সেখানে কমল ও তার সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে তার ওপর অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়।
হুইপ সাইমুম সরওয়ার কমলের টর্চার সেলে নির্যাতনের শিকার রামু উপজেলা তাঁতী লীগ নেতা মো. শাহাজালাল কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, বিগত উপজেলা নির্বাচনে সাবেক সংসদ সদস্য কমলের সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে ভোট না করায় ফোন করে কমলের বাসায় ডেকে নিয়ে গিয়ে প্রায় ১৫ মিনিট বিরতিহীনভাবে শাহজালালকে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করে কমল ও তার গুণ্ডাবাহিনী।
এমপি কমলের নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থী ও ক্রীড়া সংগঠক নয়ন শর্মা রামু ক্রিকেট স্কুল নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালাতেন। ঐ প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব নিতে এমপি কমলের লালিত সাঙ্গ পাঙ্গরা প্রতিনিয়ত চাপ প্রয়োগ ও হুমকি প্রদর্শন করতেন নয়নকে। এরই সূত্র ধরে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ত্রাসী বাহিনী সহকারে কমল নিজেই রামু হাইস্কুল মাঠে শত শত খেলোয়াড় ও দর্শকের সম্মুখে নয়ন শর্মাকে বেধড়ক মারধর ও পরিবার নিয়ে কুরুচিপূর্ণ গালাগাল করেন। যার অডিও পরবর্তীতে রেকর্ড ফেইসবুকে ভাইরাল হয়।
জোয়ারিয়ানালা ইউপি চেয়ারম্যান কামাল শামশুদ্দিন প্রিন্স জানান, বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি কমলের প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় আক্রোশের বশীভূত হয়ে সশস্ত্র গুণ্ডাবাহিনী নিয়ে এমপি কমল নিজেই জনসম্মুখে তার ওপর হামলা করেন। হামলায় তিনি গুরত্বর জখম হন। তিনি সাবেক সাংসদ ও হুইপ কমলের শাস্তি দাবি করেন।
রামুর গর্জনিয়া বাজারের ইজারা হস্তান্তরে অনিহা প্রকাশ করায় একইভাবে হুইফ সাইমুম সরওয়ার কমলের টর্চার সেলে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন খরুলিয়ার ব্যবসায়ী আবদুর রহিমও।
রামু উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সানাউল্লাহ সেলিম ও সদস্য সচিব নুরুল আবছার জানান, ছাত্রদলের রাজনীতি করার কারণে তাদেরকে কমলের সন্ত্রাসীরা ইসলামী ব্যাংকের সামনে প্রকাশ্যে লোহার রড় দিয়ে হামলা চালিয়ে তাদের হাত ও পায়ের হাঁড় ভেঙে দেন। ভঙ্গুর শরীর নিয়ে বর্তমানে কঠিন সময় পার করছেন বলে জানান এ দুই ছাত্রদল নেতা।
সাবেক হুইপ কমলের রক্তচক্ষু থেকে রেহাই পায়নি কক্সবাজারের প্রবীণ সাংবাদিকগণও। তার বিপক্ষে গেলে অন্যায় অপদস্ত ও লাঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। একটি নিউজের সূত্র ধরে কালের কণ্ঠের নিজস্ব প্রতিবেদক তোফায়েল আহমদ ও প্রথম আলো কক্সবাজার অফিস প্রধান আব্দুল কুদ্দুস রানাকে হুমকি ও অপদস্ত করতে পিছপা হননি কমল। তার লালিত সাইবার টিমকে দিয়ে ফেসবুকে নেতিবাচক পোস্ট করিয়ে সাংবাদিকদের মানহানি ও চরিত্রহনন করা হয়। এছাড়াও যুগান্তরের জেলা প্রতিনিধি জসিম উদ্দিনকে সরাসরি মামলা ও প্রাণনাশের হুমকি দেন। এমনকি সাংবাদিক হাসান তারেক মুকিমকে যুগান্তর রামু উপজেলা প্রতিনিধি থেকে অব্যাহতি প্রদানে একে একে দুই বার যুগান্তর অফিসে গিয়ে প্রকাশক ও সম্পাদক বরাবর মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগও করেন। আত্মগোপনে থাকায় সাবেক হুইপ সাইমুম সরওয়ার কমলের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।