জাপানের যে সাবমেরিন চমকে দিয়েছিল মার্কিন বিজ্ঞানীদের

যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২৫, ১১:১৯ এএম

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বিমানবাহী সাবমেরিন তৈরি করে চমকে দিয়েছিল জাপান। তবে শেষ পর্যন্ত সেটি ধ্বংস করে দেন মার্কিন নৌ কমান্ডাররা।
জাপানের তৈরি বিমানবাহী সাবমেরিনটি পেটের মধ্যে লড়াকু জেট নিয়ে ডুব দেবে সমুদ্রের অতলে। তার পর চুপিসারে শত্রু দেশের সীমান্তে পৌঁছোতে পারলেই সেখান থেকে বেরিয়ে এসে হামলা চালাবে যুদ্ধবিমান। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ছারখার হবে উপকূলের শহর বা সেনাঘাঁটি।
এক সময় বিশ্বশক্তিকে বোকা বানাতে ‘ট্রয়ের ঘোড়া’র মতোই বিমানবাহী সাবমেরিন তৈরি করে জাপান। রণতরীটি দেখে মার্কিন নৌ কমান্ডারদেরও তাক লেগে গিয়েছিল। যদিও লড়াইয়ের ময়দানে কোনো দিনই সেটিকে ব্যবহার করতে পারেনি টোকিয়ো।
পানির নীচের বিমানবাহী জাহাজটির কোড নাম ‘আই ৪০১’ রেখেছিল প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রের নৌবাহিনী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। একবার ভরে নেওয়া জ্বালানিতে বিমানবাহী ডুবোজাহাজটির গোটা পৃথিবী চক্কর কাটার ক্ষমতা ছিল বলে আধুনিক গবেষণায় উঠে এসেছে।
সাবমেরিন প্রযুক্তিতে অবশ্য প্রথম দিকে জাপানের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল জার্মানি। মূলত ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে আক্রমণের জন্য সমুদ্রের গভীরে থাকা সাবমেরিনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন বার্লিনের সেনাকর্তারা। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এ ব্যাপারে মরিয়া হয়ে ওঠেন তারা।
জার্মানি-যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রযুক্তিতে সাবমেরিন নির্মাণে মনোনিবেশ করেছিলেন টোকিওর প্রতিরক্ষা গবেষকরা। কারণ, গোটা এশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার লোভ তত দিনে সেখানকার রাজনৈতিক নেতাদের মাথায় চেপে বসেছিল।
৩০-এর দশকের মধ্য ভাগে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকার প্রভাব বাড়ছিল। প্রথম থেকেই এই বিষয়টিকে মানতে পারেনি জাপান। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সুযোগের খোঁজে ছিল টোকিও। লড়াই চলাকালীন অতর্কিত হামলা চালিয়ে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মার্কিন নৌসেনাঘাঁটি পার্ল হারবারকে উড়িয়ে দেয় জাপান।
পার্ল হারবারে জাপানি হামলার সঙ্গে সঙ্গেই টোকিওর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ওয়াশিংটন। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রটি বুঝেছিল সুযোগ পেলেই বদলা নেবে যুক্তরাষ্ট্র। আর তাই আমেরিকার কোমর ভাঙতে পাল্টা ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেন তৎকালীন জাপানি নৌ সেনাপ্রধান অ্যাডমিরাল ইসোরকু ইয়ামামোতো। অতি দ্রুত অন্তত ১৮টি বিমানবাহী সাবমেরিন নির্মাণের নির্দেশ দেন তিনি।
ইয়ামামোতোর আদেশ মিলতেই কোমর বেঁধে কাজে লেগে পড়েন জাপানি ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রতিরক্ষা গবেষকরা। মাত্র তিন বছরে এই ধরনের একটি ডুবোজাহাজের নির্মাণ শেষ করে সেটিকে সমুদ্রে নামিয়েও দিয়েছিলেন তারা। জার্মানি এবং আমেরিকার ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে জলযানটির নকশায় একাধিক বদলও করেছিল টোকিও।
জাপানি বিমানবাহী ডুবোজাহাজটির উপরের দিকে ছিল সিলিন্ডার আকারের একটি হ্যাঙ্গার। সেখানেই তিনটি আইচি এম৬এআই বোমারু বিমান রাখা হয়েছিল। লড়াকু জেটগুলোকে আকাশে ওড়াতে বাষ্পশক্তিকে ব্যবহার করেন টোকিওর বিজ্ঞানীরা। হামলার পর যুদ্ধবিমানগুলোকে ফেরানোর প্রযুক্তিও জানা ছিল তাদের।
কিন্তু, বিমানবাহী ডুবোজাহাজটি থেকে আক্রমণের আগেই পর পর দু’টি ধাক্কা খায় জাপান। ১৯৪২ সালে মিডওয়ে দ্বীপের যুদ্ধে টোকিওকে পর্যুদস্ত করে মার্কিন নৌবাহিনী। পরের বছর দ্বীপরাষ্ট্রটিতে হামলা বাড়ায় ওয়াশিংটন। আর তাতে প্রাণ হারান জলযানের ‘মাস্টারমাইন্ড’ অ্যাডমিরাল ইয়ামামোতো।
১৯৪৩ সালের এপ্রিল মাসে লড়াইয়ের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ধুরন্ধর নৌসেনা অফিসারকে হারিয়ে বেকায়দায় পড়ে প্রশান্ত মহাসাগরের ‘উদীয়মান সূর্যের দেশ’। ফলে গতি হারায় ১৮টি বিমানবাহী ডুবোজাহাজ প্রকল্প। শেষ পর্যন্ত এই ধরনের মাত্র দু’টি জলযান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল টোকিও।
১৯৪৫ সালের ২৫ জুলাই দু’টি বিমানবাহী সাবমেরিন নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে ডুব দেয় জাপানি নৌসেনার দল। উলিঠি দ্বীপের মার্কিন নৌঘাঁটি উড়িয়ে দিতে দৃঢ়সংকল্প ছিলেন তারা। কিন্তু পরের মাসেই দ্বীপরাষ্ট্রের হিরোসিমা এবং নাগাসাকিতে পরমাণু হামলা চালায় আমেরিকা। সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে টোকিও। আর সেই খবর মিলতেই ফেরার রাস্তা ধরে ওই দুই বিমানবাহী ডুবোজাহাজ।
জাপানি নৌঘাঁটিতে ফেরার পথে অবশ্য একটি জলযানকে চিহ্নিত করেছিল আমেরিকার ডুবোজাহাজ। সেটির ক্যাপ্টেন ছিলেন জাপানি নৌসেনা অফিসার তাতসুনোসুকে অ্যারিজমি।
একবার মার্কিন ডুবোজাহাজে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েও ফেলেছিলেন তিনি। কিন্তু তখন সদর দফতর থেকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ পান তিনি। এর পর টোকিওর ওই অত্যাধুনিক সাবমেরিন চলে যায় ওয়াশিংটনের কব্জায়।
জাপানি বিমানবাহী ডুবোজাহাজের নকশা দেখে আমেরিকার প্রতিরক্ষা প্রকৌশলীরা চমকে গিয়েছিলেন। ওই প্রযুক্তি হাতে পেতে ওয়াশিংটনের উপর প্রবল চাপ তৈরি করেছিল মস্কো। কিন্তু সবাইকে চমক দিয়ে ডুবোজাহাজটিকে ধ্বংস করে দেয় মার্কিন নৌসেনা। তাদের যুক্তি ছিল, ওই প্রযুক্তি অন্য কারও হাতে গেলে অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।