আলোচনা সভায় বক্তারা
সড়ক দুর্ঘটনা ‘আল্লাহর মাল আল্লায়’ নিয়ে যাওয়ার ব্যাপার না
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:২৪ পিএম
‘দেশের সড়কগুলোতে সংঘটিত ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলা যায় না, এগুলো হত্যার আয়োজন চলছে। সড়ক দুর্ঘটনা কোনো আল্লাহর মাল আল্লায় নিয়ে যাওয়ার ব্যাপার না।এটা আমাদের মানবসৃষ্ট এবং ব্যবস্থাপনার সংকট।আগের সরকারের সড়ক পরিবহণ মন্ত্রীরা কারো সঙ্গে কোনো পরামর্শ করতেন না। এককভাবে তারা সিদ্ধান্ত নিতেন। তারা শুধু লুটপাটে সিদ্ধহস্ত ছিল। ফলে সড়ক পরিবহণ খাতে ব্যাপক নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে।’
শুক্রবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে যাত্রী অধিকার দিবস উপলক্ষে ‘বিগত সরকারের প্রণীত সড়ক আইনে যাত্রী স্বার্থ উপেক্ষিত’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
সভায় বক্তব্য দেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, নাগরিক সংহতির সাধারণ সম্পাদক শরিফুজ্জামান শরিফ, সাংবাদিক মনজুরুল আলম পান্না, যাত্রী অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক কেফায়েত সাকিল ও বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রমুখ।
সভায় অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘বিগত সরকারের সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কারো কোনো পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন না। তিনি একক সিদ্ধান্তে সব কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। সড়কের সব দুর্ঘটনা মানবসৃষ্ট। যদি আমাদের চালকদের লাইসেন্স ঠিক থাকে, গাড়ির ফিটনেস ঠিক থাকে এবং সড়ক ঠিক থাকে, আমরা যদি রোড সংকেত মেনে চলি, যাত্রীরা যদি আচরণবিধি মেনে চলে, এরপরও যদি দুই-একটি ঘটনা ঘটে, তার নাম দুর্ঘটনা। কিন্তু আপনার গাড়ির ফিটনেস ঠিক নেই, টাকা দিয়ে লাইসেন্স পাওয়া যায়, সড়ক ঠিক নেই। তাহলে এখানে তো প্রতি মুহূর্তে হত্যার আয়োজন হচ্ছে।’
সড়ক দুর্ঘটনায় বিশিষ্ট সাংবাদিক তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তখন আমরা তৎকালীন সড়ক পরিবহণ মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে বলেছিলাম- এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি হত্যার আয়োজন। এখানের মতো ছাল-বাকল তোলা বাস সারা পৃথিবীর কোথাও নেই। এখানকার দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হলো চুক্তিভিত্তিক ড্রাইভার নিয়োগ দেওয়া। তারা প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত মানুষ মারছে। সড়কের সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ থাকতো এবং এখানে সীমাহীন লুণ্ঠন, লুটতরাজ এবং ন্যূনতম সুশাসনের ব্যবস্থা না রেখেই সড়কগুলো ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে।’
এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘আমরা যদি চালকদের লাইসেন্স ও গাড়ির ফিটনেস ঠিক করি, ড্রাইভারদের চাকরির মর্যাদা দেই, সিগন্যালগুলো মেনে চলি, তাহলে এই দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব। এটি কোনো নিয়তি না। সড়ক দুর্ঘটনা কোনো আল্লাহর মাল আল্লায় নিয়ে যাওয়ার ব্যাপার না। এটা আমাদের মানবসৃষ্ট এবং ব্যবস্থাপনার সংকট। সড়কের ব্যবস্থাপনা ঠিক করে মানুষ হত্যার আয়োজন অনেকখানি কমানো সম্ভব।’
আলোচনা সভায় মূল বক্তব্য তুলে ধরে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজ্জাম্মেল হক বলেন, ‘দীর্ঘদিন যাবৎ পরিবহণে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য কিছুতেই থামছে না। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশের ইতিহাসে সাড়া জাগানো সর্ববৃহৎ ছাত্র আন্দোলনের পরে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার সড়ক পরিবহণের নতুন আইন করল। আইন বাস্তবায়নও হলো। কিন্তু পরিবহণে বিশৃঙ্খলা কেবল বাড়ছেই। পরিবহণ খাতসহ দেশের সব ক্ষেত্রে বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার শত সহস্র তাজা প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের সড়ক পরিবহণ সেক্টরেও দীর্ঘদিন যাবৎ যাত্রী সাধারণ ছিল বঞ্চিত। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের টেবিলে তাদের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। পরিবহণের প্রধানতম স্টেকহোল্ডার দেশের জনগণ তথা যাত্রী সাধারণ হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত ১৬ বছর পরিবহণ পরিচালনার সব ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান স্টেকহোল্ডার যাত্রী সাধারণের প্রতিনিধিত্ব বাদ দিয়ে সরকারের অনুগত লেজুড়ভিত্তিক একটি বাস মালিক সমিতি ও একটি পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের নেতৃত্বে পরিবহণ সেক্টর পরিচালনা করতে গিয়ে সবকিছু যেন লেজেগোবরে অবস্থার সৃষ্টি করেছে তৎকালীন সরকার। ফলে পরিবহণে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা, ভাড়া নৈরাজ্য, যাত্রী হয়রানি অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যাত্রী সাধারণের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগের কোনো উপায় ছিল না। পরিবহণ সেক্টরে যাত্রী স্বার্থের সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হতো বাস মালিক সমিতি ও শ্রমিক ফেডারেশনের গুটিকয়েক নেতাদের প্রেসক্রিপশনে। ফলে রাজধানীর কোনো বাসে একজন ভদ্রলোকের সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে যাতায়াতের পরিবেশ নেই। সিটি সার্ভিসগুলোর কোনো বাসের আসনে বসা যায় না। পরিষ্কার-পরিচ্ছনতার বালাই নেই। সিট ভাঙা, দরজা-জানালা ভাঙা, বাসের ছাল উঠে গেছে বহুযুগ আগে। এসব মেয়াদোত্তীর্ণ লক্কড়-ঝক্কড় বাস উচ্ছেদের নামে নানান টালবাহানা, নানান আশ্বাস, নানান কমিটি করে মিডিয়ার সামনে আইওয়াশ করতেন তৎকালীন সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ফলে তিনি ধারাবাহিকভাবে চার মেয়াদে ১৫ বছর সড়কমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেও দেশের মানুষকে যাতায়াতের ক্ষেত্রে স্বস্তি দিতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছেন।’
মোজ্জাম্মেল হক আরও বলেন, ‘যাতায়াতের ক্ষেত্রে মানুষের সংকটকে পুঁজি করে বিগত ১৫ বছরে দেশের সড়ক যোগাযোগে উন্নয়নের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য নেওয়া হয়েছে একের পর এক মেগা প্রকল্প, উদ্দেশ্য ছিল মেগা লুটপাট। পরিবহণে মালিক-শ্রমিক নেতাদের তোষামোদী করার মাধ্যমে যাত্রীদের পকেট কাটার নৈরাজ্য চলেছে। চাঁদাবাজির নামে শতশত কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা চাঁদাবাজির অংশীদার থাকায় কোনো প্রতিবাদ করা যায়নি। এই বৈষম্য দূর করতে হলে পরিবহণ আইন সংশোধন করে যাত্রী ও নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি।’