Logo
Logo
×

শেষ পাতা

সড়ক, নৌ ও রেলে ৪১৯ দুর্ঘটনা

ঈদযাত্রায় ঝরল ৪৩৮ প্রাণ আহত দেড় হাজার

যাত্রীকল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঈদযাত্রায় ঝরল ৪৩৮ প্রাণ আহত দেড় হাজার

এবারের পবিত্র ঈদুল ফিতরে যাতায়াতে সড়ক, নৌ ও রেলপথে ৪১৯টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৪৩৮ জন নিহত এবং ১ হাজার ৪২৪ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে সড়ক-মহাসড়কে ৩৯৯টি দুর্ঘটনায় ৪০৭ জন নিহত এবং ১ হাজার ৩৯৮ জন আহত হয়েছেন।

আর রেলপথে ১৮টি দুর্ঘটনায় ২৪ জন নিহত, ২১ জন আহত; নৌপথে ২টি দুর্ঘটনায় ৭ জন নিহত এবং ৫ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া গত বছরের চেয়ে এবার সড়ক দুর্ঘটনা ৩১ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি হয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে শনিবার সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সাবেক সংসদ-সদস্য লুৎফুন্নেছা খান, গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞ আব্দুল হক, সংগঠনের সহসভাপতি তাওহীদুল হক লিটন, যুগ্মমহাসচিব মনিরুল হক, প্রচার সম্পাদক মাহমুদুল হাসান রাসেল, মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন প্রমুখ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবারের ঈদে লম্বা ছুটি থাকায় অন্যবারের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি মানুষ যাতায়াত করেছে।

বর্তমান সরকারের ১৫ বছরে ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে দেশের সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা আগের তুলনায় ভালো থাকায় যানবাহনে গতি বেড়েছে। দেশের সবকটি সড়ক-মহাসড়কের পাশাপাশি পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেলের অবাধ চলাচলের কারণে মোট যাত্রীর ৭ দশমিক ৫ শতাংশ মোটরসাইকেলে যাতায়াত করেছে।

সরকারের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঠে থাকলেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য এবং পথে পথে যাত্রী হয়রানি চরমে উঠেছিল। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্যের কারণে বাস-ট্রেনের ছাদ, খোলা ট্রাক, পণ্যবাহী পরিবহণে যাত্রী হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দরিদ্র মানুষকে ঈদে চলাচল করতে দেখা গেছে।

আরও বলা হয়েছে, ঈদযাত্রা শুরুর দিন ৪ এপ্রিল থেকে ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরা ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ১৫ দিনে ৩৯৯ সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০৭ জন নিহত এবং ১ হাজার ৩৯৮ জন আহত হয়েছেন। গত বছরে ঈদুল ফিতরে ৩০৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩২৮ জন নিহত এবং ৫৬৫ জন আহত হয়েছিলেন। গত বছরের সঙ্গে তুলনা করলে এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা ৩১ দশমিক ২৫ শতাংশ, প্রাণহানি ২৪ দশমিক ০৮ শতাংশ এবং আহত ১৪৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেড়েছে।

পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বরাবরের মতো এবারও দুর্ঘটনার শীর্ষে রয়েছে মোটরসাইকেল। এবারের ঈদে ১৯৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৬৫ জন নিহত, ২৪০ জন আহত হয়েছেন-যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৪৯ দশমিক ৬২ শতাংশ, নিহতের ৪০ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং আহতের ৩০ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এ সময়ে সড়কে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ৮৭ জন চালক, ৩১ জন পরিবহণ শ্রমিক, ৪০ পথচারী, ৭৫ নারী, ৪৭ শিশু, ২৭ শিক্ষার্থী, ৮ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ৪ শিক্ষক, ১ জন রাজনৈতিক দলের কর্মী, ১ জন মুক্তিযোদ্ধা, ২ জন চিকিৎসকের পরিচয় পাওয়া গেছে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে যাত্রীকল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়, সংগঠনের সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের সদস্যরা বহুল প্রচারিত ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় ও আঞ্চলিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের পাশাপাশি জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ৬৫৮ জনের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে ৬০৮ জন আহত রোগীর তথ্য পর্যালোচনা করে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে বলা হয়, সংঘটিত দুর্ঘটনা বিশ্লেষণে তারা দেখতে পেয়েছেন মোট যানবাহনের ৪০ দশমিক ৫০ শতাংশ মোটরসাইকেল, ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-লরি, ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ কার-মাইক্রো-জিপ, ৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ নছিমন-করিমন-ট্রাক্টর-লেগুনা-মাহিন্দ্রা, ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ অটোরিকশা, ১২ দশমিক ১১ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা-ইজিবাইক-ভ্যান-সাইকেল এবং ১৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ বাসে দুর্ঘটনা ঘটেছে।

আরও বলা হয়, দুর্ঘটনার ২৬ দশমিক ৩১ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৪৭ দশমিক ১১ শতাংশ পথচারীকে গাড়িচাপা দেওয়ার ঘটনা, ২২ দশমিক ৫৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে, ০.৫০ শতাংশ ট্রেন-যানবাহনে, ০.৫০ শতাংশ চাকায় ওড়না প্যাঁচিয়ে এবং ৩ শতাংশ অন্যান্য অজ্ঞাত কারণে দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এছাড়া দুর্ঘটনার ৩২ দশমিক ৫৮ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ১০ দশমিক ০২ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ৫০ দশমিক ৬২ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়। এছাড়াও সারা দেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৬ দশমিক ০১ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, ০.২৫ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে এবং ০.৫০ শতাংশ লেভেলক্রসিংয়ে সংঘটিত হয়েছে।

মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক, রেল ও নৌপথে ১৫ বছরে ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে অবকাঠামো ভালো হওয়ায় যানবাহনের গতি বেড়েছে। গতিকে নিরাপদ করার মতো আইনি কাঠামো, দক্ষ চালক, মানসম্মত যানবাহনের অভাব রয়েছে। আইন প্রয়োগে দুর্নীতির কারণে জাতীয় মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন যানবাহন, নিষিদ্ধ থ্রি-হুইলার, ইজিবাইকের মতো যানবাহন অবাধে চলছে। এছাড়া ছোট ছোট যানবাহন মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, ইজিবাইকের অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার কারণে সড়কে বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা।

এজন্য মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের আমদানি বন্ধ করে দেশব্যাপী উন্নতমানের আধুনিক বাস নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সরকারের কাছে দাবি জানাই। পাশাপাশি ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ করা, পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী পরিবহণ ঠেকানো, আইন প্রয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে ডিজিটাল পদ্ধতি প্রয়োগ, চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা সুনির্দিষ্ট করা, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধ করা, সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধে গণপরিবহণগুলোয় নগদ অর্থ বন্ধ করে ডিজিটাল লেনদেন চালুর দাবি জানাই।

দুর্ঘটনার কারণ ও সুপারিশ : ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনার ৬টি কারণ উঠে এসেছে যাত্রীকল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে। এগুলো হলো : ১. দেশের সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেলের অবাধ চলাচল; ২. জাতীয় মহাসড়কে রোড সাইন বা রোড মার্কিং, সড়কবাতি না থাকায় হঠাৎ ঈদে যাতায়াতকারী ব্যক্তিগত যানের চালকদের রাতে এসব জাতীয় সড়কে ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চালানো; ৩. জাতীয়, আঞ্চলিক ও ফিডার রোডে টার্নিং চিহ্ন না থাকায় নতুন চালক এসব সড়কে দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে; ৪. মহাসড়কের নির্মাণত্রুটি, যানবাহনের ত্রুটি ও ট্রাফিক আইন অমান্য করা; ৫. উলটোপথে যানবাহন চালানো, সড়কে চাঁদাবাজি, পণ্যবাহী যানে যাত্রী পরিবহণ এবং ৬. অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অতিরিক্ত যাত্রী বহন, বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানো এবং একজন চালক অতিরিক্ত সময় ধরে যানবাহন চালানো।

দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যাত্রীকল্যাণ সমিতি ১০ দফা সুপারিশ করেছে। সেগুলো হলো : ১. জরুরি ভিত্তিতে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক আমদানি ও নিবন্ধন বন্ধ করা; ২. জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে রাতে অবাধে চলাচলের জন্য আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা; ৩. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ, যানবাহনের ডিজিটাল পদ্ধতিতে ফিটনেস প্রদান; ৪. ধীরগতির যান ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা; ৫. সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ করা,

চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা সুনিশ্চিত করা; ৬. মহাসড়কে ফুটপাত ও পথচারী পারাপারের ব্যবস্থা রাখা, রোড সাইন, রোড মার্কিং স্থাপন করা; ৭. সড়ক পরিবহণ আইন যথাযথভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা; ৮. উন্নতমানের আধুনিক বাস নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ-এর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা; ৯. মানসম্মত সড়ক নির্মাণ ও মেরামত সুনিশ্চিত করা, নিয়মিত রোড সেফটি অডিট করা এবং ১০. মেয়াদোত্তীর্ণ গণপরিবহণ ও দীর্ঘদিন ফিটনেসহীন যানবাহন স্ক্যাপ করার উদ্যোগ নেওয়া।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম