Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের টাইমলাইন

ড. ইউনূসের কথা বিশ্বাস করতে হবে

সাক্ষাৎকার: অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল

Icon

কাজী জেবেল

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ড. ইউনূসের কথা বিশ্বাস করতে হবে

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের যে টাইমলাইন দিয়েছেন, এর কোনোরকম ব্যত্যয় হবে না। তার কথা সবার বিশ্বাস করতে হবে। আর সব দল যদি ঐকমত্যভাবে প্রস্তাব করে আ.লীগকে নিষিদ্ধ করা হোক অথবা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দেওয়া হোক বা কোনো আদালতের রায়ের পর্যবেক্ষণে যদি এ বিষয়টি আসে, তখন অবশ্যই সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে সরকার। যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন আইন, বিচার ও সংসদ এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। সম্প্রতি রাজধানীর হেয়ার রোডে তার সরকারি বাসভবনে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে ফেরত আনা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া হাসিনার নানা বক্তব্য, ছাত্রদের নতুন দল এনসিপি, ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান ও পরবর্তী সময়, উপদেষ্টা পরিষদে ছাত্র প্রতিনিধি থাকা, অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা, বিভিন্ন খাত সংক্রান্ত সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফ্যাসিস্টদের দোসর, শীর্ষ সন্ত্রাসী, চিহ্নিত দাগি আসামি ও ধর্ষণ মামলার অভিযুক্তদের জামিন, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্বাচনের অংশগ্রহণ এবং গত ১৫ বছরের রাজনৈতিক মামলাসহ সমসাময়িক বিভিন্ন ইস্যুতে খোলামেলা কথা বলেন সরকারের এই উপদেষ্টা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন উপসম্পাদক এহসানুল হক বাবু ও বিশেষ প্রতিনিধি কাজী জেবেল।

যুগান্তর : অন্তর্বর্তী সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় আপনার বিশেষ ভূমিকা ছিল। ওই সময়ে আপনার সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ ছিল?

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : আমি এটা নিয়ে এখনই বিস্তারিত বলতে চাই না। কারণ, আমি তো গোপনীয়তার শপথ নিয়েছি। ব্যক্তিগত ভূমিকার চেয়ে সরকারের প্রতি আমার যে দায়িত্বশীলতা, সেটার দিকে বেশি লক্ষ রাখা উচিত। ফলে আমি বিস্তারিত বলব না। শুধু এটুকু বলব, আমার প্রচেষ্টা ছিল অভ্যুত্থানের পক্ষে যত শক্তি আছে, তাদের মধ্যে যেন ঐক্য থাকে এবং গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের ভয়েসটা যেন যথেষ্ট সম্মান ও গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়, সেই প্রচেষ্টা ছিল। ওই সময় আমি সবার মধ্যে একধরনের কঠিন ঐক্য, সমঝোতা, পরস্পরকে বোঝার প্রচেষ্টা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেখেছিলাম। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরবর্তীকালে কোনো কোনো সময়ে যেটার অভাব দেখেছি এবং তা দেখামাত্র আমার মনেই আশঙ্কা তৈরি হয় যে, গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষশক্তির মধ্যে মতভেদ থাকবে, মতভিন্নতা থাকবে; কিন্তু বড় ধরনের কোনো বিরোধ যেন না থাকে। ওই সময়ে মতবিরোধ থাকলে আমরা কঠিন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারতাম না।

যুগান্তর : গণ-অভ্যুত্থানের পর বিপ্লবী সরকার গঠন না হয়ে কেন অন্তর্বর্তী সরকার হলো?

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন অনেকটা আকস্মিক ছিল। নতুন সরকার গঠন নিয়ে খুব একটা প্রস্তুতি ছিল না। শেখ হাসিনার পতনের পর কী ধরনের সরকার গঠন হবে, সেটা নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা-কথাবার্তা হয়নি। তখন আমরা শেখ হাসিনাকে কীভাবে সরাব, সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম। ফলে দ্রুত এতকিছু পরিকল্পনা করে সরকার গঠন করা সম্ভব হয়নি। আমি মনে করি, ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান ছিল। সেখানে বিপ্লবের উপাদান ছিল; কিন্তু বিপ্লব ছিল না। বিপ্লব সেটা, যেখানে বিপ্লবের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ থাকে, প্রস্তুতি থাকে, বিপ্লবের পক্ষে বাহিনী থাকে। কিন্তু সেখানে এগুলো কিছু ছিল না। তবে শেখ হাসিনা যদি আরও বেশিদিন ক্ষমতায় থাকত, আরও গণহত্যা চালাত, তাহলে এটা বিপ্লবে রূপ নিতে পারত। শেখ হাসিনা এত দ্রুত লেজ গুটিয়ে পালাবে, তা ভাবতে পারিনি। তাই সরকার গঠনে এত চিন্তা বা পরিকল্পনা করার সময় ও সুযোগ ছিল না।

যুগান্তর : শেখ হাসিনাকে ফেরত না দিলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েনের কি আশঙ্কা আছে?

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : নিয়ম অনুযায়ী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চেয়েছি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রসঙ্গটি তুলেছেন। তাকে ফেরত পাওয়া আমাদের অধিকার। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্রক্রিয়ায় যদি ভারত তাকে প্রত্যর্পণ না করে এবং ট্রাইব্যুনালের রায়ে যদি প্রমাণিত হন উনি দোষী, তারপরও তাকে ফেরত না পাঠায়, তাহলে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবশ্যই এটি একটি বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আমরা মনে করি, ভারত যদি বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চায়, বাংলাদেশের জনমানুষের আবেগ-চেতনাকে সম্মান করতে চায়, তাহলে শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করা উচিত।

যুগান্তর : ভারতে অবস্থান করে শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনাসহ নানা বিষয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন; বিষয়টি সরকার কীভাবে মূল্যায়ন করছে?

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : এটা খুবই আপত্তিকর। ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যেভাবে জনরোষের ঘটনা ঘটেছে, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ভাঙচুরের যে ঘটনা ঘটেছে-এসবকিছুর জন্য সম্পূর্ণভাবে শেখ হাসিনা দায়ী। তিনি উসকানিমূলক, উত্তেজনাকর, আক্রমণাত্মক ও অসত্য বিষোদ্গারমূলক বক্তব্য দিনের পর দিন দিয়ে চলেছেন, সেটা গণ-অভ্যুত্থানে হতাহতের মনে যে ক্ষত রয়েছে, তা পদাঘাত করার সমতুল্য মনে হয়েছে। আমাদের কষ্ট-বেদনাকে মশকরা করা হচ্ছে, পরিহাস করা হচ্ছে। তার মধ্যে ন্যূনতম অনুশোচনাবোধ নেই। আমি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বলব, আপনারা গণমানুষের রোষ, ক্ষোভ, ক্রোধ যদি অনুধাবন করতে পারেন, তাহলে আপনাদের নেত্রীর মুখ বন্ধ করতে বলেন। বরং আপনারা ওনাকে (শেখ হাসিনাকে) জিজ্ঞাসা করেন, আওয়ামী লীগের সব নেতাকর্মীকে ফেলে উনি ওনার সব আত্মীয়স্বজনসহ বৃহত্তর পরিবারকে আগেভাগে কীভাবে দেশ থেকে সরিয়ে নিলেন? কীভাবে নেতাকর্মীদের ঝুঁকিতে ফেলে নিজে পালিয়ে গেলেন। ওনার এই দলে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যোগ্যতা আছে কি না? নেতাকর্মীদের প্রতি ওনার সহমর্মিতা আছে কি না-তার কাছে এই প্রশ্ন করেন।

যুগান্তর : নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা সরকারের আছে কি না?

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : একটা দল নিষিদ্ধ করা বা নিবন্ধন বাতিল করা সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন দেশে রয়েছে, নজির রয়েছে, আদালতের রায়ও রয়েছে। দল নিষিদ্ধকরণের ব্যাপারটা আদালতের রায়ে হতে পারে, এটা নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে অথবা পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশনের মাধ্যমেও হতে পারে। এ মুহূর্তেই এটা নিয়ে কিছু বলতে চাই না, বিচারিক প্রক্রিয়ার ওপর ছেড়ে দিয়েছি, বাংলাদেশের মানুষের মতামতের ওপর ছেড়ে দিয়েছি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলাপে যদি সব দল মিলে প্রস্তাব করে যে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হোক বা আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে যেন অংশগ্রহণ করতে না দেওয়া হয় অথবা কোনো আদালতের রায়ের অবজারভেশনে যদি নিষিদ্ধ করার বিষয়টি আসে, তখন অবশ্যই সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে

যুগান্তর : আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে চাইলে তাদের সেই সুযোগ দেওয়া হবে কি না?

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : আগামী ডিসেম্বরের আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হচ্ছে না। এখনো অনেক সময় বাকি আছে। এ সময়ের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া এবং জনমতের আরও সুস্পষ্ট প্রকাশ আমরা দেখতে পারব। এটার মধ্য দিয়েই ব্যাপারটা নির্ধারিত হবে। নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক এজেন্ডায় আসেনি, ওইভাবে আলোচনা হয়নি। বিচারিক প্রক্রিয়া আছে, জনমত আছে, সেগুলোর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ভাগ্য নির্ধারিত হবে।

যুগান্তর : বিএনপি ও সমমনা দলগুলো দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায়। সরকার নির্বাচনের বিষয়ে কী ভাবছে?

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নির্বাচনের তারিখের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি নির্বাচনের যে টাইমলাইন দিয়েছেন, এর কোনোরকম ব্যত্যয় হবে না-এটা বলতে পারি। ড. ইউনূসের কথা সবার বিশ্বাস করতে হবে। আমরা যারা সরকারে এসেছি, আমাদের সংস্কারের কিছু প্রত্যাশা আছে, গণহত্যার বিচারের প্রত্যাশা আছে, সরকারের পক্ষে বিনিয়োগ আনা এবং আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রত্যাশা আছে-সেগুলো প্রত্যাশিত জায়গায় যাওয়া প্রয়োজন। তবে এটা সত্য, নির্বাচন আগামী ডিসেম্বরের আগে এবং ২০২৬ সালের জুনের পরে হবে না। ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে।

যুগান্তর : ৫ আগস্ট সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানের ভূমিকা কেমন ছিল?

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমার কাছে মনে হয়েছে, তখন সেনাবাহিনী দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে। সেনাপ্রধানের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হওয়ামাত্র তিনি সবকিছুতে রাজি হয়ে যাবেন-এমন প্রত্যাশা করা স্বাভাবিক না। আমি ওনার (সেনাপ্রধান) মধ্যে ভিন্নমতকে সমন্বয় করা, সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া, দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করা, গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে অনুধাবনের চেষ্টা করা, ছাত্রনেতাদের যথাযথ গুরুত্ব দেওয়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার যে ভূমিকা দেখেছি, সেটা অবশ্যই প্রশংসনীয় ও ইতিবাচক।

যুগান্তর : রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারে ধীরগতির অভিযোগ রয়েছে। আইন উপদেষ্টা হিসাবে আপনার বক্তব্য।

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : সরকারপ্রধান পালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় চার হাজার সরকারি আইনজীবী পালিয়ে গেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। গণ-অভ্যুত্থানের তীব্রতা দেখে তাদের মধ্যে এত ভীতি তৈরি হয়েছে যে, তারা পালিয়েছেন। আমাদের সাড়ে চার হাজারের মতো আইনজীবী নিয়োগ দিতে হয়েছে। ওই নিয়োগযজ্ঞ শেষ হয়েছে মাত্র তিন মাস আগে। ওই নিয়োগ দেওয়ার পর সাত হাজারের মতো মামলা প্রত্যাহার করেছি। সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের অধীনে প্রায় ৫০০ মামলা প্রত্যাহার করেছি। এ সময়ের মধ্যে এর চেয়ে দ্রুতগতিতে মামলা প্রত্যাহার কেউ করতে পারবে কি না, তা চ্যালেঞ্জ দিয়ে রাখি। আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দিনরাত যেভাবে কাজ করছেন, তাদের প্রতি রাজনৈতিক নেতারা শ্রদ্ধা রাখলে আমি খুশি হব। অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট বা অন্য কারও বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা এখনো থেকে থাকলে এবং তা আমাদের নজরে এলে ব্যবস্থা নেব।

যুগান্তর : অন্তর্বর্তী সরকারে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি দুজন উপদেষ্টা রয়েছেন। আগামী নির্বাচনে তারা স্বপদে থাকলে সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হবে কি না?

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : আমি উলটোভাবে বললে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। আমাদের (উপদেষ্টা) সরকারের আসার কথা নয়, স্বাধীন মুক্ত পরিবেশে থাকার কথা নয়। তারা জীবনের মায়া উপেক্ষা করে চরম আত্মত্যাগের প্রতিজ্ঞা করে রাস্তায় নেমেছিল বলেই আজকের এই মুক্ত পরিবেশ পেয়েছি। এ সময়ে যে সরকার গঠিত হয়েছে, সেটা তাদেরসহ রাজনৈতিক দলগুলোর আত্মত্যাগের ফসল। বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো গত ১৫ বছর ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম জারি রেখেছিল বলেই ছাত্রদের মধ্যে গণ-অভ্যুত্থানের তাগিদ বা উপলব্ধি তৈরি হয়েছিল। গত পনেরো বছর আন্দোলনের ধারাবাহিকতা আবার শেষ প্রান্তে এসে ছাত্ররা যে আত্মত্যাগ, যে সাহস দেখিয়েছে, সেটা কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনীয় না। আমাদের তো অন্যভাবেও দেখার আছে যে, এই ছাত্ররা গণ-অভ্যুত্থানে বিজয়ী শক্তি হিসাবে সরকার গঠনের কথা বলতে পারত। কিন্তু তারা করেনি। তারা অন্তর্বর্তী সরকারে তাদের দু-তিনজন প্রতিনিধি রেখেছে। আমি বলতে পারি, আমাদের ছাত্র প্রতিনিধিরা নির্বাচন করলে অবশ্যই সরকার থেকে পদত্যাগ করবে। এখন প্রশ্ন তুলেতে পারেন-ছাত্র প্রতিনিধি সরকারে রেখে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হবে কি না। তাহলে একটা কথা বলি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের আগে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় পাঁচ বছর থাকে। তখন কি আমরা বলি, পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনি সুযোগ পেয়েছে। ওরা সরকারে থাকায় নির্বাচনকালীন কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। আরেকটা বিষয়ে আমাদের প্রশংসা করতেই হবে, নাহিদ ইসলাম উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দিয়ে রাজনীতিতে গেছে। এটা একটা জেসচার। সে সরকার ও রাজনীতিকে একীভূত করতে চায়নি। এজন্য তাকে ধন্যবাদ দিতেই হবে।

যুগান্তর : প্রশাসনের বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিস্তর দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। দুর্নীতি বন্ধে স্থায়ী পদক্ষেপ বা সুপারিশ থাকবে কি না?

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : অন্তর্বর্তী সরকার সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রথম যে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, এর মধ্যে দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন একটি। এ কমিশন যেসব সুপারিশ দিয়েছে, সেটা আশু বাস্তবায়নযোগ্য হিসাবে দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে সব আইনি পদক্ষেপ নেব। তবে মনে রাখতে হবে, আইনি সংশোধন হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া শুরুর প্রথম ধাপ। আমি মনে করি, আইন সংশোধন বা প্রণয়ন করা সবচেয়ে সহজ কাজ। কিন্তু কঠিন কাজ হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও সক্ষমতা তৈরি করা। আমাদের দেশের সঙ্গে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে পার্থক্যটা হচ্ছে-তাদের আইনের চেয়ে আমাদের আইন খারাপ না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও ভালো আইন আছে। অনেক দেশের চেয়ে আমাদের দেশের দুদক আইন বা পরিবেশ আইন ভালো। কিন্তু বাস্তবায়ন অবস্থা এত খারাপ যে, ওই ভালো আইন থাকার পরও কোনো লাভ হয়নি। এই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে মোটামুটি দুর্নীতির একটা ধারা ছিল। আওয়ামী লীগ আমলে গিয়ে ওটা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এত বছরের দুর্নীতির সংস্কৃতিকে কার্যকরভাবে দুর্নীতি রোধ করার জন্য একটি সরকারের কমপক্ষে ১০ বছরের প্রচেষ্টা দরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা পুরোপুরি সম্ভব না। তবে আমরা কিছু ভালো লোক নিয়োগ দিয়ে যাচ্ছি, ভালো আইন করব, ভালো কিছু পলিসি করব, মানুষকে সচেতন করব। সত্যিকার অর্থে একটি দেশ থেকে দুর্নীতি দমন করা শুধু রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে সম্ভব।

যুগান্তর : অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার টেকসই করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতি নেওয়ার পরিকল্পনা আছে কি না?

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : আমাদের পরিকল্পনা আছে। সংস্কার প্রস্তাবগুলো দুইভাগে ভাগ করেছি। একটি হচ্ছে, আশু বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার প্রস্তাব। এর আওতায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিমত্তা, জবাবদিহি বৃদ্ধি ও সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রশ্ন জড়িত। এসব সংস্কারের বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত। এ ধরনের সংস্কারগুলোর তালিকা তৈরি করে, কোন মন্ত্রণালয় কী কী কাজ করবে, তা সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠানো হয়েছে। আশু বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার প্রস্তুাবগুলোর বেশির ভাগই করবে আইন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কোনো সংস্কারকাজ শেষ করতে কত মাস লাগবে, এর সঙ্গে আর্থিক সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, অন্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সংশ্লেষ আছে কি না-তা তালিকা করেছি। কিছু কিছু কাজ বাস্তবায়ন শুরু করেছি। এক থেকে দুই মাসে ব্যাপক আইনি সংস্কার দেশবাসী দেখতে পাবেন। আর যেসব সংস্কারের সঙ্গে সংবিধান জড়িত, সেগুলো বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং। সেখানে রাজনৈতিক ঐকমত্য লাগবে। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কতটুকু কমাবেন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ক্ষমতা কতটুকু বাড়াবেন, সংসদের উচ্চকক্ষ-নিম্নকক্ষ করবেন কি না, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংশোধন হবে কি না, রাষ্ট্রের মূলনীতি কী হবে-এ ধরনের প্রস্তাবে রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া সংস্কার করা আমাদের একার পক্ষে ঠিক হবে না, আমরা করবও না। এগুলো দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার। বিএনপি, জামায়াত, ধর্মীয় রাজনৈতিক দল, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বাম দল-সবাই মিলে জুলাই চার্টারে সই করলে তখন বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব। আমরা যদি সবাই মিলে সংস্কার বিষয়ে একমত হই, তাহলে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া কোনো সমস্যা নয়। এমনকি আগামী নির্বাচনের আগে সংবিধান সংশোধন না করেই সংস্কার করা সম্ভব। রাজনৈতিক ঐকমত্য হলে সাংবিধানিক সংশোধনও সম্ভব। রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকলে নির্বাচনের পরও সংস্কার সম্ভব।

যুগান্তর : সরকার ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দেশ এবং পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ কী?

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : যে যার মতো বলতে থাক। বাংলাদেশের মানুষ ক্রমান্বয়ে সচেতন হবে। একপর্যায়ে মানুষ বুঝতে পারবে, যত ধরনের অপপ্রচার ও গুজব ছড়ানো হোক না কেন, তা টিকবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গত ১৫ বছর আওয়ামী ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠী যত অপপ্রচার করেছে, তা কি মানুষকে বিশ্বাস করাতে পেরেছে? ওই সময়ে প্রচার করা হয়েছে যে বাংলাদেশের যত ভালো কিছু আছে, সবাই তার বাবা (শেখ মুজিবুর রহমান) করেছেন, সেই প্রচার কি টিকেছে? কাজেই এসব অপপ্রচার নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন নই। কারণ, এর প্রভাব খুবই ক্ষণস্থায়ী।

যুগান্তর : প্রশাসনে অনেক ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তা রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না?

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : টানা ১৫ বছর কোনো সরকার ক্ষমতায় থাকলে তার অনুগ্রহভাজন কর্মকর্তা-কর্মচারী কত থাকতে পারে, তা চিন্তা করে দেখেন। মাঝেমধ্যে মনে হয়, ‘ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়’ হওয়ার অবস্থা। যারা খুবই নোংরা ভূমিকা রেখেছিল, গত সরকারের সঙ্গে নৈকট্য বজায় রেখে অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছিল, ভুয়া নির্বাচন করেছিল, গুমের সঙ্গে জড়িত ছিল, বড় ধরনের আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, একদল আরেক দলকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার জন্য অসত্য তথ্য দিচ্ছে। এমনও হয়েছে, গত সরকারের সুবিধাপ্রাপ্ত ছিল; কিন্তু আমাদের কাছে এসেছে বঞ্চিত হিসাবে। আবার কাউকে বঞ্চিত মনে করা হচ্ছে, তখন দেখা যাচ্ছে সে-ই বড় সুবিধাপ্রাপ্ত লোক। এভাবে সবাই সবার বিরুদ্ধে লেগে আছে। সবাই নিজেকে বঞ্চিত দাবি করছে আবার সবাই সবাইকে ফ্যাসিবাদের দালাল হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে। এই ডামাডোলের মধ্যে সঠিকভাবে কাজ করা কঠিন হয়ে যায়। তবুও সত্য খুঁজে বের করে কাজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যখনই কোনো অভিযোগ আসছে, সেগুলো আমলে নেওয়া হচ্ছে।

যুগান্তর : অনেকেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। উনি কি নিজে রাষ্ট্রপতি হতে চান?

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : স্যার প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে চাননি। তিনি যথেষ্ট সম্মানিত, আনন্দময় ও মূল্যবান জীবনযাপন করতেন। ব্যক্তিগত প্রাপ্তি ওনার বিবেচ্য বিষয় নয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেয়ে অনেক বড় অর্জন তার জীবনে অলরেডি ছিল। কাজেই এসব বিষয় স্যারকে তাড়িত করে না। তার নিজস্ব জীবনবোধ আছে, সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবেন।

যুগান্তর : আদালতগুলোয় মামলাজট কমাতে আইন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ কী?

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : আদালতগুলোয় বিশাল মামলাজট রয়েছে। এটা কমাতে আমাদের কিছু উদ্যোগ আছে। মামলাজট কমাতে আমরা লিগ্যাল এইড সংস্থাকে ক্ষমতায়িত করতে চাই, জনবল বাড়াতে চাই। এটা করতে পারলে মামলার সংখ্যা কমে আসবে। এছাড়া আইনগত সংস্কারের চিন্তা আছে। দেওয়ানি কার্যবিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংশোধন করছি। মামলা কমিয়ে আনতে আরও কিছু পদক্ষেপ আছে। এজন্য আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নিরলসভাবে কাজ করছেন। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা নেওয়া হচ্ছে। এ সময়ে এসে আমরা যদি সংস্কার করতে না পারি, তাহলে নিজেই নিজের ওপর হতাশ ও ক্ষুব্ধ হব।

যুগান্তর : পৃথক বিচার বিভাগ সচিবালয় প্রতিষ্ঠার অগ্রগতি সম্পর্কে বলুন?

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয় আমরা করব। এটা নিয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে। আমরা বুঝেশুনে এই সরকারের সময়ে করে ফেলব ইনশাল্লাহ।

যুগান্তর : সরকার থেকে বিদায় নেওয়ার পর রাজনীতিতে যোগ দেবেন কি না?

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমি আমার অধ্যাপনায় ফিরে যেতে চাই। আগে যেমন বিভিন্ন ধরনের সমালোচনা করতাম। এখন বুঝি সমালোচনা করা কত সহজ এবং বাস্তবায়ন কত কঠিন কাজ। আগে সমালোচনা করতাম মানুষ মাথায় তুলে রাখত, এখন সারা দিন কাজ করি আর সমালোচনা শুনি। এখন অপেক্ষা করছি কত দ্রুত অধ্যাপনার জীবনে ফিরে যাব, কত দ্রুত নাগরিক সমাজে ফিরে যাব। এখন আমি যা করছি, তা আমার দায়িত্ব। ওই দায়িত্ব আমার পালন করতেই হবে। ভালো কিছু করতে পারলে সেটা আমার জন্য আনন্দদায়ক হবে।

যুগান্তর: উপদেষ্টা হওয়াটা কি উপভোগ করছেন?

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল: না, করছি না। মানুষ কেন মন্ত্রী হন-এটাই আমার মাথায় ঢুকছে না। এত কাজ, এত দায়িত্ব। সৎ ও দায়িত্ববান ব্যক্তি মন্ত্রী হলে তার তো আত্মজিজ্ঞাসায় মরে যাওয়ার কথা। এই দেশে কত সমস্যা আর আমি কী করলাম-এই আত্মজিজ্ঞাসায় দগ্ধ হওয়ার কথা। আর যদি অসৎ, বদ মতলবের মানুষ মন্ত্রী হন, তার জন্য মন্ত্রিত্ব আনন্দ ও উপভোগ করার জায়গা। তবে শেষ পর্যন্ত যদি ভালো কিছু করতে পারি, সেটাই একমাত্র প্রাপ্তি ও উপভোগের বিষয় হবে।

যুগান্তর : দেশে মব জাস্টিস হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের ভূমিকা নমনীয় কি না?

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : আমরা মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছি। প্রথমদিকে হয়তো শৈথিল্য ছিল। এখন অনেকটা কমে আসছে। মনে রাখতে হবে, বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে মানুষের আচার-আচরণ খুব দ্রুত ডিসিপ্লিন হয়ে যায় না। আমাদের দেশেও স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ডিসিপ্লিন হয়ে যায়নি। পৃথিবীর যেসব দেশে বিপ্লব হয়েছে, সেসব দেশে মানুষ খুব দ্রুত ঘরে ফিরে শান্তশিষ্ট হয়ে যায় না। সেটা আমরা মনে রেখে কিছুদিন ধৈর্য ধরেছি। এখন আমরা মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছি। সাম্প্রতিক ভাঙচুরের ঘটনায় ৫০ জনের বেশি মানুষ গ্রেফতার করা হয়েছে। সামনের দিনেও যে কোনো ঘটনায় সরকার কঠোর অবস্থানে থাকবে।

যুগান্তর : আদালত থেকে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা জামিন পেয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের অপরাধে যুক্ত হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতারা জামিন পেয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য।

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : ফ্যাসিস্টদের দোসর, শীর্ষ সন্ত্রাসী, চিহ্নিত দাগি আসামি এবং ধর্ষণ মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিরা জামিন পেয়ে যাচ্ছেন। এসব জামিনের প্রায় ৯০ ভাগ পাচ্ছেন উচ্চ আদালত থেকে। হাইকোর্ট প্রধান বিচারপতির এখতিয়ারাধীন প্রতিষ্ঠান। হাইকোর্ট এভাবে জামিন দিয়ে দিলে আমাদের করণীয় হচ্ছে-অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে আপিল বিভাগে আবেদন করে থাকি। গত কয়েক সপ্তাহে এতসংখ্যক লোক হাইকোর্টে জামিন পেয়েছেন যে প্রতিটি মামলা মোকাবিলা করার জন্য লোকবল পাচ্ছি না। অন্যদিকে নিম্ন আদালতে জামিন দেওয়ার সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম। ফ্যাসিস্টদের দোসরদের জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ যে এজাহারটা দিয়েছে, সেই এজাহারে ওই লোকের নাম নেই। পুলিশ যে ফরোয়ার্ডিং দিয়েছে আদালতে, সেই ফরোয়ার্ডিংয়ের মধ্যে ওই ব্যক্তির পরিচয় উল্লেখ করা নেই। তিনি আওয়ামী লীগের কোন পর্যায়ের নেতা বা ইনভলমেন্ট কী ধরনের-সেই তথ্য নেই? ফলে নিম্ন আদালতের বিচারকের তার জামিন না দেওয়ার বিষয়ে কোনো যুক্তি থাকে না। এটা নিয়ে আমরা পুলিশের সঙ্গে আলাপ করেছি। আমরা এটা সমন্বয় করে ব্যবস্থা নিচ্ছি। যাদের বিরুদ্ধে অপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে এবং যাদের জামিন দিলে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা-স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে, তাদের ক্ষেত্রে জামিন দেওয়ার ব্যাপারে সবার সচেতন হওয়া উচিত। অন্যথায় দেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা কঠিন হয়ে যাবে।

যুগান্তর : জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কাছে সাধারণ মানুষের অনেক প্রত্যাশা। কিন্তু এ দলের কয়েক নেতার বিভিন্ন আচরণে প্রচলিত রাজনৈতিক প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব।

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : সম্পূর্ণ একটি ধাঁচে সবকিছু পরিবর্তন করে দিয়ে একটা রাজনৈতিক দল করা কি বাংলাদেশে বাস্তবোচিত? আপনি আমাকে বলেন, বিএনপি বাংলাদেশে এ মুহূর্তে সবচেয়ে শক্তিশালী। বিএনপির নেতা তারেক রহমানকে ওনার দলের নেতাকর্মীরা প্রচুর ভালোবাসেন। ধরে নিন, উনি দেশে চলে এলেন এবং নির্বাচনি প্রচারে অংশ নিলেন। সেখানে বিএনপির নেতাকর্মীরা বিপুল পরিমাণে টাকা খরচ করলেন। এর বিপরীতে একজন ছাত্রনেতা যে জীবনে হয়তো তিন-চারবার এলাকায় গেছে, যে একটা টাকাও খরচ করতে পারবে না, কর্মীদের রিকশা ভাড়াও দিতে পারবে না, একটা মিছিলও করতে পারবে না, ওই প্রার্থী কি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার চান্স পাবে? কোনো উন্মাদ কি বিশ্বাস করবে যে, ওই ছাত্রনেতার নির্বাচনে জেতার কোনো চান্স থাকবে? সম্পূর্ণ খোলনলচে বদলে একদম সম্পূর্ণ নতুনভাবে একটি দল আসবে, এটাই যদি হতো তাহলে সিপিবি ও বাসদ বাংলাদেশে অনেক বড় দল হয়ে যেত। সিপিবির লোক আর যাই হোক সৎ। কিন্তু সিপিবি বা বাসদ বড় দল হয়নি। এজন্যই বলি, আমাদের প্রত্যাশার ক্ষেত্রেও কিছুটা বাস্তববাদী হতে হবে। ছাত্রদের কিছু ভুল আছে, তাদেরও সতর্ক হতে হবে। তবে এনসিপির কিছু ভালো দিক আছে। দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন এখনো ৮ হাজার টাকার ভাড়া বাসায় থাকে, আগেও এই টাকার ভাড়ার বাসায় থাকত। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম পাবলিক বাসে যাতায়াত করেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্য এবং উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমের একটি কাজের ঘটনায় ওই দলের নেতাকর্মীরা সমালোচনা করেছে। এটা একটি পজিটিভ দিক। নতুন দলের কাছে আমাদের প্রত্যাশা বাস্তবভিত্তিক হতে হবে। আমি অসম্ভব কিছু প্রত্যাশা করি না। আমি তাদের বলেছি, তোমরা একটি স্বচ্ছ আর্থিক নীতিমালা কর। তোমরা যাদের কাছ থেকে দল পরিচালনার জন্য টাকা নেবে, সেটা যেন নিয়মতান্ত্রিক হয়। তারা ইতোমধ্যে একটি খসড়া নীতিমালা করে আমাকে দিয়েছে। আমি ইনপুট দেব। যে কোনো দল এ ধরনের নীতিমালা করে আমার মতামত চাইলে আমি দেব।

যুগান্তর : বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্বাচনে অংশ নিতে আইনগত বাধা আছে কি না?

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : আমি তো কোনো বাধা দেখি না। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, তখন খালেদা জিয়া রাজপথের নেত্রী ছিলেন। ওনার প্রতি বাংলাদেশের মানুষের যে সম্মান, তা প্রশ্নাতীত। তিনি কখনো নির্বাচনে হারেননি। তিনি কোনো নির্বাচনে না থাকলে সেই নির্বাচনের সৌন্দর্য নষ্ট হবে। তারেক রহমান খালেদা জিয়ার পর সবচেয়ে বড় নেতা। ওনার বিষয়ে অনেক অপপ্রচার চালানোর চেষ্টা হয়েছে। ওইসব অপপ্রচার সত্ত্বেও ওনার দলের নেতাকর্মীরা যেভাবে ওনাকে ভালোবাসেন, তা অতুলনীয়। তার মতো একজন নেতা যদি নির্বাচনে না থাকেন, সেই নির্বাচন অর্থবহ হবে না। আরেকটি দিক হচ্ছে, ওনাদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা ছিল, সেগুলো কীভাবে হয়েছে, তা কে না জানে? খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যেসব বিচারক অন্যায়ভাবে রায় দিয়েছেন, তাদেরকে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের বিচারপতি করার মাধ্যমে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এসব ট্রেন্ড দেখলে বোঝা যায়, তাদের বিচারের নামে কী হয়েছে। আমরা তাদের বাড়তি সুবিধা দিচ্ছি না। তারা আইনি লড়াই করে মিথ্যা মামলা থেকে মুক্ত হচ্ছেন। ফলে ওনাদের নির্বাচনে অংশ নিতে বাধা থাকার কথা না।

যুগান্তর : আপনার দৃষ্টিতে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা কী কী?

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : আমাদের অভিজ্ঞতার ঘাটতি ছিল। আমাদের পাবলিক কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে দুর্বলতা আছে। আমরা একটা ভগ্নস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে কাজ করছি। এমন ভগ্নস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে আরও ভালো পারফর্ম করা হয়তো সম্ভব। কিন্তু এর চেয়ে বেশি পারফর্ম করার আকুতি বা চেষ্টা করা সম্ভব কি না, সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।

যুগান্তর : আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তী সরকারের বিচারের কথা বলেছেন। এতে আপনি ভীতু বা চাপবোধ করছেন কি না?

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : প্রশ্নই আসে না। কোনো চাপবোধ করছি না। উনি যেসব কথা বলেন, তা হাস্যকর মনে হয়। উনি বারবার বলেন, আমি কিন্তু বাংলাদেশে চলে আসব ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা বলছি, আপনি বাংলাদেশে আসেন। এটাই আমরা চাচ্ছি। আপনাকে প্রত্যর্পণের আবেদন করে রেখেছি। আপনি বাংলাদেশে এসে আদালতের বিচারের সামনে দাঁড়ান। আমরা তো সেটাই চাই। মাঝেমধ্যে ওনাকে (শেখ হাসিনা) মানসিক ভারসাম্যহীন মনে হয়। এত মানুষকে হত্যা করার পর এভাবে মিথ্যাচার করে কবিতা আবৃত্তি করেন, ওনার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙচুর হয়ে গেছে, ওনার নেতাকর্মীরা হুমকির মুখে অথচ উনি অন্য একটি দেশের আতিথেয়তা গ্রহণ করে কবিতা আবৃত্তি করা কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব না।

যুগান্তর : রোজা ও ঈদে দ্রব্যমূল্য সহনীয়, নির্বিঘ্ন ঈদযাত্রা ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে সরকারের কৌশল কী ছিল?

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল : এ তিন ইস্যুতে যতরকম ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তার সর্বাত্মক প্রস্তুতি ছিল। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রে কোনোভাবে যাতে সিন্ডিকেট না হয়, সেজন্য সার্বক্ষণিক সচেতন ছিলেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। আগে জাহাজে পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার চেষ্টা করা হতো, সেটা বন্ধ করা হয়েছে। ফলে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক ছিল, কোনো কালোবাজারি সিন্ডিকেট করতে দেওয়া হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা-সরকারের লোকজনের মধ্যে কোনো দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট ছিল না। ফলে এখানকার এ সিগন্যালও কালোবাজারি, মজুতদারি এবং সিন্ডিকেটগুলোকে রোধ করার ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। আর বিদ্যুতের ক্ষেত্রে আমাদের সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টার যথেষ্ট অবদান ছিল। সারাক্ষণ এ ব্যাপারে তিনি সচেতন ছিলেন। আর ঈদযাত্রায় স্বস্তির ক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টার একটি সিদ্ধান্ত চমৎকার কাজ করেছে। তিনি নির্বাহী আদেশে মাঝখানের একদিন ছুটি দেওয়ার মাধ্যমে মোট ৯ দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। এ নয়দিন বন্ধের কারণে মানুষের জন্য খুব সুবিধা হয়েছে। সবমিলিয়ে সরকারের আন্তরিকতা, সততা এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞাই এসব সফলতার নেপথ্যে বড় ভূমিকা রেখেছে।

নির্বাচন প্রধান উপদেষ্টা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম