Logo
Logo
×

পরবাস

হ্যালোইনে আমি একা

Icon

রহমান মৃধা

প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৫৮ পিএম

হ্যালোইনে আমি একা

হ্যালোইন

হ্যালোইন একটি বিশেষ উৎসব, যা ভয়, সৃষ্টিশীলতা এবং সম্প্রদায়ের এক ভিন্ন মেজাজ তৈরি করে। এটি মূলত আয়ারল্যান্ডের প্রাচীন সামহেইন (Samhain) উৎসব থেকে উদ্ভূত, যেখানে মৃত আত্মাদের পৃথিবীতে ফিরে আসার বিশ্বাস ছিল। এই উৎসবের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ভয়ের মুখোমুখি হওয়ার সাহস তৈরি হয় এবং তারা ভুতুরে পোশাকে সেজে একে অপরকে ভয় দেখিয়ে আনন্দ উপভোগ করে। হ্যালোইন পালনের মূল থিমগুলো হলো-

১. মৃত্যু ও স্মৃতি: হ্যালোইন মৃতদের স্মরণে উৎসর্গ করা হয়। এটি জীবনের অমোঘ সত্য, মৃত্যু এবং স্মৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের প্রতি এক গভীর দৃষ্টি দেয়।

২. ভয় এবং হাসি: ভয়ের সঙ্গে মজার সমন্বয়। ভুতুরে পোশাক এবং সাজসজ্জার মাধ্যমে মানুষ ভয়কে উপভোগ করে। এটি আমাদের শেখায় যে, ভয় অথবা অজানা কিছু থেকে পালানোর বদলে সেটাকে মোকাবেলা করা এবং উপভোগ করা সম্ভব।

৩. সম্প্রদায়ের সংহতি: হ্যালোইন এক ধরনের সামাজিক মিলনমেলা। এটি মানুষকে একসঙ্গে নিয়ে আসে, যেখানে তারা আনন্দ এবং মজা ভাগ করে নেয়। শিশুদের ‘ট্রিক অর ট্রিট’ করার মাধ্যমে এবং বড়রা পার্টির আয়োজন করে একে অপরের সাথে যুক্ত হন।

৪. সৃষ্টিশীলতা: হ্যালোইন কল্পনা ও সৃষ্টিশীলতার একটি প্ল্যাটফর্ম। কুমড়া খোদাই, ভুতুরে সাজসজ্জা, এবং ভৌতিক খেলাধুলা সবই আমাদের সৃজনশীলতা প্রকাশের সুযোগ দেয়।

আমার হ্যালোইনের অভিজ্ঞতা

মরতে তো একদিন হবেই—এ কথা সবাই জানে, কিন্তু মৃত্যুতে মজা, না সাজা, তা কেবল মৃতরাই জানে। শরৎচন্দ্র শ্রীকান্ত উপন্যাসে লিখেছেন, ‘মরতে তো একদিন হবেই।’ এই বাক্যটি যেন জীবনের এক অনিবার্য সত্য। জীবন তার আপন গতিতে চলে, থেমে থাকে না, এবং চলার মধ্যে কখনো পর হয়ে যায় আপন, কখনো দিন হয়ে যায় রাত।

আমার একটি বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা স্মরণ করতে পারি, যা আমাকে জীবন এবং মৃত্যুর থিমগুলোর সাথে সংযোগ করতে সাহায্য করেছে। অক্টোবরের শেষ দিন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডর্মিটরি ছিল প্রায় ফাঁকা। বন্ধুরা ছুটিতে বাড়ি গেছে। সুইডেনে এই সময়টা ‘আল হেলগোন’ নামে পরিচিত, যখন মৃতদের স্মরণে কবরস্থানে মোমবাতি ও ফুল নিয়ে যাওয়া হয়।

১৯৮৫ সালের ৩১ অক্টোবর, আমি ডর্মিটরিতে একা ছিলাম। ঠাণ্ডা বাতাস ও তুষারবৃষ্টিতে বাইরের পরিবেশ ছিল ভীষণ ভয়ানক। রাতের অন্ধকারে, নিঃশব্দ ডর্মিটরিতে হঠাৎ দরজার বেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই দেখি, দু’টি পেত্নীর মতো চেহারার মেয়ে। গা ছমছম করে উঠল—সুইডেনে ভূত?

হঠাৎ আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম, দেখি আমার দুই সুইডিশ বান্ধবী—ছারা আর সুজান—আমার পাশে। তারা আমাকে হ্যালোইনের সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল, কিন্তু পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে ওরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল হ্যালোইনের ভয়ের মজাটা উপভোগ করা, কিন্তু আমার অবস্থায় তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে আমি হয়তো হার্টফেল করেছি। সেদিনের সেই মজার এবং ভয়ের মিশ্রিত ঘটনা আজও মনে পড়ে।

জীবনে শত সমস্যার মাঝেও মজা করা এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। সমস্যাগুলো আমাদের ঘিরে ধরে, কিন্তু ক’জনই বা শিখেছে কিভাবে তাদের মধ্যে থেকেও হাসিমুখে বেঁচে থাকতে হয়? পৃথিবীর অনেক সমাজেই মানুষ এই দক্ষতাটি অর্জন করেনি। কিন্তু জীবন কেবল দুঃখ-কষ্টে ভরা নয়—এতে আনন্দ, হাসি এবং মজার মুহূর্তও রয়েছে, যদি আমরা তা খুঁজে নিতে পারি।

হ্যালোইন এই ধরনের একটি উদাহরণ হতে পারে। ভয়ের সজ্জা, ভূতের রূপধারণ এবং অদ্ভুত পোশাকের মাধ্যমে মানুষ একে অপরকে ভয় দেখিয়ে মজা পায়। কিন্তু এর গভীরে লুকিয়ে আছে এক শিক্ষণীয় দিক। হ্যালোইন আমাদের শেখায় যে, ভয় বা অজানা কিছু থেকে পালানোর বদলে আমরা সেটিকে উপভোগ করতে পারি। এমনকি ভয়ঙ্কর বা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিকেও আমরা মজা করে কাটিয়ে উঠতে পারি।

এখানেই হ্যালোইনের আসল শিক্ষা—সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার সময় ভয়ে না গুটিয়ে গিয়ে তার মধ্যে থেকে আনন্দ খুঁজে বের করা। জীবনের প্রতিটি সমস্যাই এক একটি চ্যালেঞ্জ, কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে মজা, উদ্যম এবং সৃষ্টিশীলতা। ভয়ের মুখে দাঁড়িয়ে সাহসী হওয়া এবং হাসতে শেখা—এটি হ্যালোইনের শিক্ষার মূল কথা।

সুইডেনে হ্যালোইন এবং আল হেলগোন উৎসব একসঙ্গে পালন করা হয়—একদিকে ভয়, অন্যদিকে স্মৃতি ও ভালোবাসার মধ্য দিয়ে মৃতদের স্মরণ করা হয়। দিনশেষে, মানুষের মধ্যে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যের বন্ধনটাই আমাদের জীবনকে পূর্ণ করে তোলে।

বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিম, খ্রিস্টান এবং হিন্দু জনগণের দেশে, সবাই যার যার ধর্মে বিশ্বাসী এবং সেই অনুযায়ী জীবন যাপন করে। যদিও সবাই বেহেশত বা সর্গে যেতে চায়, কিন্তু কেউ মরতে চায় না। ধর্মীয় বিশ্বাস আমাদের মধ্যে মৃত্যুকে এক ভয়ঙ্কর সত্য হিসেবে চিহ্নিত করে, যেখানে মৃত্যুর পরের জীবন অপেক্ষা করছে। কিন্তু পশ্চাত্যের সংস্কৃতি, বিশেষ করে হ্যালোইন, মৃত্যু এবং অজানাকে হাস্যরসের মাধ্যমে উপভোগ করার সুযোগ দেয়। এভাবে, তারা মৃত্যু নিয়ে খেলতে পারে, যেন সেটি একটি বাস্তবতা হলেও তাতে ভয়ের কিছু নেই।

এই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ আমাদের শেখায় যে, মৃত্যুকে ভয় পাওয়ার পরিবর্তে, আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোতে আনন্দ খুঁজে বের করা উচিত। আমাদের আধ্যাত্মিক বিশ্বাসগুলোকে মাথায় রেখেও, আমরা যদি মৃত্যুকে একটি নতুন শুরু হিসেবে দেখি এবং জীবনকে উপভোগ করি, তাহলে আমরা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে একটি বিশেষ স্মৃতি হিসেবে রূপান্তরিত করতে পারব।

এভাবেই, জীবন এবং মৃত্যুর সাথে আমাদের সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব, যেখানে ভয় ও আনন্দের এক সুস্থ মিশ্রণ তৈরি হয়। 

আজ আমার ছোটবোন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এসেছে। তার সঙ্গে হ্যালোইন নিয়ে কথা হচ্ছিল। সে জানালো, এই উইকেন্ডে তার দুই মেয়ে ডরমিটরিতে থাকবে, কারণ সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ সময় হ্যালোইন পার্টি করে। তার মতে, এটি তাদের স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়।

ঠিক একই সময়, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা বঙ্গভবন ঘেরাও করেছে, শুধুমাত্র বাকস্বাধীনতার জন্য। তারা বাঁচার সংগ্রাম এবং একটি সুন্দর সৃজনশীল জীবন গড়ার সংগ্রামে মগ্ন। মনে হচ্ছে, একই পৃথিবীতে আমরা বাস করছি—যেখানে চাঁদ, সূর্য, বাতাস এক—কেবল আমরা, মানুষজাতি, ভিন্ন!

জানি না কেন এমন করে ভাবছি! হতে পারে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি যেখানে কোনটা অন্যায়, কোনটা ন্যায় সেটা নিয়ে কথা নেই, কথা হচ্ছে দলগত রেসারেসি। অন্যের দুঃখে দরদ নেই, শুধু আমি ভালো থাকতে চাই। আমার সমস্যাই বড় সমস্যা, আমি যা বলব সেটাই ঠিক ইত্যাদি। এ কোন নতুন বিশ্ব যেখানে এগো, হিংসা, বিদ্বেষ সবার ঊর্ধ্বে, যা আমাকে এবারের হ্যালোইন ভাবতে শিখিয়েছে!

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।

(rahman.mridha@gmail.com)

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম