Logo
Logo
×

পরবাস

আঙ্কারায় রোজা-ইফতার

Icon

ইমতিয়াজ আহমেদ সজল

প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২৩, ০৩:৫৩ পিএম

আঙ্কারায় রোজা-ইফতার

প্রায় শতভাগ মুসলমানের দেশ তুরস্ক বা তুর্কি। ওসমানী খেলাফতসহ ইসলামী ইতিহাসের বহু নিদর্শনের স্মৃতি বহন করে এ তুর্কি। 

ভূ-রাজনীতি ও ঐতিহাসিক বহু নিদর্শন ধারণ করে বলে ইস্তাম্বুল তুর্কির সবচেয়ে বিখ্যাত শহর। তবে রাজধানী শহর হিসেবে আঙ্কারারও রয়েছে বহুমাত্রিক তাৎপর্য। 

রাজধানী আঙ্কারাসহ তুরস্কের প্রায় সব মসজিদের স্থাপত্য শৈলী একই রকম। ওসমানী খেলাফত আমলে নির্মিত মসজিদগুলোর সঙ্গে সমঞ্জস্য রেখেই পরবর্তীতে নতুন সব বড় বড় মসজিদ তৈরি করা হয়েছিলো। 

মসজিদগুলোর ভেতরের দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ, ক্যালিওগ্রাফি আর আলোকসজ্জা মনোমুগ্ধকর। আঙ্কারার সবচেয়ে বড় মসজিদ খোজাতেপে জামে। এখানকার মসজিদগুলো সাধারণত পাহাড়ের উপরে নির্মিত হয়, যার ফলে একদিকে যেমন দূর-দূরান্ত থেকে দৃশ্যমান হয়, অন্যদিকে মসজিদের আজান ছড়িয়ে পড়ে বহুদূর পর্যন্ত। 

এখানে সব মসজিদে একই সময়ে সুললিত কন্ঠে আজানের সুর ভেসে আসে। সাধারণত নামাজের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার সাথে সাথেই আজান হয়, আজানের পর সুন্নত নামাজের পরপরই জামাত শুরু হয়ে যায়, শুধু ফজরের জামাত হয় সূর্যোদয়ের আধা ঘন্টা আগে। 

এখানে আজানের আগেই মুসল্লিরা সবাই মসজিদে চলে আসেন। নামাজ শেষে তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া-মুনাজাত শেষ করেই সবাই মসজিদ থেকে বের হন। এখানের মসজিদগুলো সাধারণত একতলা, একটি বড় গম্বুজকে কেন্দ্র করে মসজিদের মূল কাঠামো, আর মসজিদের পেছনের দিকে দোতলা বা তিনতলা বারান্দা থাকে। সেখানে ভিন্ন প্রবেশ পথ দিয়ে নারীদের জন্য নামাজের জায়গা থাকে। 

নানান প্রয়োজনে বাসার বাহিরে আসা নারীদের নামাজ পড়ার ব্যবস্থা সত্যিই এখানে অনেক সুন্দর। সেই সাথে কচি-কাঁচা শিশুদের মসজিদে উপস্থিতি চোখে পড়ে, তবে তাদের কলরবে বিরক্তিবোধ করেন না কেহই।

রমজানের প্রথম চার-পাঁচ দিন তারাবির নামাজের পূর্বে রমজানকে আহলান-সাহলান ও মারহাবা জানিয়ে বিভিন্ন ধরনের গজল পরিবেশন করা হতো মসজিদে। আবার এখন রমজানের অর্ধেক পার হয়ে যাওয়ার পর আল-বিদা মাহে রমজান বলে গজল গাওয়া হয় তারাবির আগে। 

এখানে শতভাগ হানাফী মাযহাবের অনুসারী। তাই, রমজানে ২০ রাকাত তারাবি সুশৃঙ্খলভাবেই তারা আদায় করেন গুরুত্বের সাথে। তবে কিছু প্রবণতা আমাদের দেশের মতো এখানেও আছে। যেমন রমজানের শুরুর দিকে মসজিদগুলোতে উপচে পড়া ভিড়, ধীরে ধীরে কমতে থাকে শেষের দিকে। তারাবি নামাজ শেষে মাঝে-মাঝে থাকে তাবারুকের ব্যবস্থাও। 

কখনো সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে আর কখনো ব্যক্তি উদ্যোগে মসজিদের বাইরে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন দেয়া হয় মুসল্লিদেরকে। আঙ্কারার অন্যতম একটি বড় মসজিদ মেলতেপে জামে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে এ মসজিদেই যেতে হয় আমাকে। বেশভূষা দেখে রাস্তায় প্রায়ই অনেক ভারতীয় কিংবা পাকিস্তানি নাগরিকরা স্বদেশীয় ভেবে এগিয়ে আসেন কথা বলতে, জিজ্ঞেস করেন ‘কাঁহা চে?’। 

স্থানীয় তুর্কিরাও জিজ্ঞেস করেন পাকিস্তান, হিন্দুস্তান? তখন একটু গর্ব করে বলি- বাংলাদেশ; অনুধাবন করি, এ স্বতন্ত্র পরিচয়ের জন্যই রক্ত দিয়েছেন লাখো মানুষ।

আমি আঙ্কারায় এসেছি ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে। ডরমিটরিতে এসেই শুনলাম মার্চ মাসে রমজান উপলক্ষে খাবারের দাম কমে হবে তিন ভাগের এক ভাগ। রমজান আসতেই শুনলাম সাহরি থাকবে ফ্রি আর নিয়মিত খাবারের পরিমাণও বাড়বে। 

আরব দেশগুলোর মতো তুর্কিতেও রমজানে নানান পণ্য ও সেবায় বিভিন্ন রকম ছাড় থাকে, যাতে মানুষের জীবন-যাপন সহজ হয়। যদিও, আমাদের দেশে পরিলক্ষিত হয় ঠিক ভিন্ন চিত্র; রমজান এলেই যেন ব্যবসায়ীরা নানান সিন্ডিকেট আর মজুতদারির পসরা সাজিয়ে বসে। 

এ বিষয়ে কথা বলেছিলাম আফ্রিকার কয়েকটি মুসলিম দেশের বন্ধুদের সাথে, তারা বলল তাদের দেশেও নাকি একই রকম পরিস্থিতি, রমজান এলেই দ্রব্যমূল্যের দাম হয়ে যায় আকাশচুম্বী। 

আঙ্কারার বিভিন্ন স্থানে বিদেশি শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষদের জন্য বিনামূল্যে ইফতারের কিছু আয়োজন থাকে। এখানে, রাতে ভারী খাবার খেলেও সাহরিতে সবাই হালকা খাবার খায়। আমাদের দেশের মতো রমজানে ফজরের নামাজ আগে না পড়ে নিয়মিত সময়েই পড়ে। এ দেশে রমজানেও অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সময় স্বাভাবিক থাকে, যার ফলে সকালে ঘুমানোর সুযোগ তাদের থাকে না বলেই সাহরিতে চা পান করা এখানে একটা সাধারণ অভ্যাস। 

আঙ্কারার আরেকটি বিখ্যাত মসজিদ হাজী বাইরাম ওলী মাসজিদ। হাজী বাইরাম ওলী সম্পর্কে বাংলাদেশী কোন শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করলেই তারা সহজে উপমা দেয় যে- আমাদের যেমন আছে শাহজালাল (রহ.) এদের তেমনি হাজী বাইরাম। 

তুর্কি বন্ধুদের কাছেও এ সম্পর্কে অনেক শুনলাম। তুরুস্কে কামাল আতাতুর্ক পরবর্তী ইসলামের পুনঃজাগরনে উল্লেখযোগ্য অবদান ছিলো বিভিন্ন সুফিবাদী তরীকার। প্রসিদ্ধ চার তরীকার মধ্যে তুরুস্কে নক্সবন্দিয়া তরীকা বেশি সমাদৃত। 

এখানে, নক্সবন্দিয়া তরীকায়, নক্সবন্দিয়া-বাইরাম ধারা যোগ করেছেন হাজী বাইরাম ওলী। একদিন চলে গেলাম হাজী বাইরাম ওলী’র খানকা, মাজার ও মাসজিদ দেখতে। দেখলাম সেখানকার সুন্দর অবকাঠামো আর ইসলামের অনেক ঐতিহ্য। 

হাজী ভাইরা মসজিদের পাশেই থাকেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাজমুস সাকিব, যিনি আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মতত্ত্বে পিএইচডি করছেন। তিনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন হাজী বাইরাম মসজিদ সংলগ্ন বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা ও নিদর্শনের সাথে। এবং ব্যাখ্যা করেন যে, ঐতিহ্য সংরক্ষণের ব্যাপারে তর্কীরা খুবই যত্নশীল। 

একটা জাতি যখন তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করবে, পরবর্তী প্রজন্ম সেগুলো থেকে শিক্ষা নেবে; অনুপ্রেরণা পাবে; চেতনা সঞ্চার হবে। মসজিদের লাগোয়া একটি বহু শতাব্দী পুরনো গির্জার ধ্বংসাবশেষ আছে, গির্জাতে উপাসনা করার কেউ নেই, তবে ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে এটি এখানে সংরক্ষিত আছে। মসজিদের কাছেই পাহাড়ের উপরে রয়েছে আঙ্কারা ক্যাসেল, যেটি আঙ্কারার সবচেয়ে পুরনো বসতি। 

সপ্তাহে প্রতিদিনই বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষজন আসেন হাজী বাইরাম মসজিদে। তবে রবিবারে একটু বেশি ভিড় থাকে। আঙ্কারায় তাবলিগ জামাতের কাজকর্মের প্রাণকেন্দ্র এ হাজী বাইরাম মসজিদ, এখানেই সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার মাশোয়ারা বা পরামর্শসভা হয়। 

একদিন গেলাম সে মাশোয়ারায়, আর সেখানেই কথা হয় আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র বাংলাদেশি শিক্ষক ডক্টর মঈনুল আহসানের সাথে। তিনি সেখানকার অনেকের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন, বাংলাদেশের মানুষকে তারা খুব সভ্য-শান্ত হিসেবে জানে। 

আঙ্কারায় আমাদের এক তুর্কি সহপাঠীর ইফতারের দাওয়াতে আমরা সব বিদেশি শিক্ষার্থীরা একবার গিয়েছিলাম তাদের বাসায়। নানান রকম তুর্কি খাবারে আমরা ছিলাম পরিতৃপ্ত। রমজানের কয়েকদিন আগে জাতীয় শিশু দিবসের প্রোগ্রামে আমাকে আঙ্কারার বাংলাদেশ দূতাবাসে নিয়ে যান আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো বন্ধু রাশেদ হাসান চৌধুরী, তিনিও আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মতত্ত্বে পিএইচডি করছেন। 

সম্প্রতি নতুন রাষ্ট্রদূত এসেছেন, তাই খুব ভালো খাবার-দাবারের আয়োজন ছিলো সেদিন। দূতাবাসে দেখা হয়েছে কয়েকজন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সাথে, যারা সম্প্রতি ভূমিকম্প ও বন্যা কবলিত তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পড়াশোনা করছেন। 

তাদের কাছে শুনেছি সেখানকার মানবিক বিপর্যয়ের কথা। বলেছেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার ফিরে যাবেন সেখানে। আঙ্কারার বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা সবসময় অপেক্ষায় থাকে যে, কখন দূতাবাসে একটি ভালো আয়োজন হবে আর দেশীয় স্বাদের খাবার খাওয়া যাবে। 

প্রতি রমজানেই নাকি দূতাবাসে একবার ইফতার আয়োজন হয়, এ রমজানে এখনো সবাই প্রতীক্ষায় আছে, কখন দূতাবাসে ইফতারের দাওয়াত দিবে। 

লেখক: আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অনুষদে উচ্চশিক্ষারত। 
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম