জীবন পরিবর্তনে প্রকৃত ভালো বন্ধু প্রয়োজন
মো. শরীফ উদ্দিন, দক্ষিণ আফ্রিকা
প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২১, ০৪:০২ পিএম
"বন্ধু" তিন অক্ষরের ছোট এই শব্দের মাঝে যেন মিশে আছে সহজ-সরল অনুভূতি, বিশ্বস্ততা আর নির্ভরতার মায়া। আর এই মায়ার বাঁধন তৈরি হয়েছে স্কুলজীবন থেকে। সেই সময় বন্ধুদের নিয়ে হাঁসি, ঠাট্টা, গল্প, আড্ডা, খেলাধুলা আর গানে গানে কাটেছে সময়। তখন আনন্দময় দিনগুলো নানা আয়োজনে মেতেছি সবাই। এসব সোনা, হীরা, রুপার বন্ধুর মধ্যে দিয়ে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের নিয়ে জীবন কাটাতে হচ্ছে আমাদের। তবে হ্যাঁ এটা সত্যি বন্ধুত্ব চলমান একটি প্রক্রিয়া। তাই শিশুকাল থেকে বৃদ্ধাকাল পর্যন্ত জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রতিটি মুহুর্তে বন্ধু তৈরি হতে পারে। মনে রেখ হীরা পেয়ে সোনাকে ভুলে যেও না। কারন বাস্তব জীবনে হীরা ধারণ করতে সোনাই লাগবে। আর সেই সোনা বন্ধু হলো স্কুলজীবনের বন্ধু।
বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আমাদের ফেসবুকে-মেসেঞ্জারে নানা ধরনের বন্ধু তৈরি হয়ে থাকে। এদের স্থায়িত্ব হয় একদিন, দুই দিন বা কয়েক মাস। এসব বন্ধু বিশ্বাস বা আস্থার জায়গায় থাকে হাতে গোনা দু'একটি।
প্রায় ১ যুগ আগে নিজ পরিবারসহ বন্ধু-বান্ধব ছেড়ে বিদেশে আসতে হয়েছে আমাকে। প্রবাসে আসার পর নতুন করে আরেকটি বন্ধু মহল তৈরি হয়েছে। জীবনে যত বন্ধু আসবে স্কুল জীবনের বন্ধুরা হলো বেষ্ট। চিন্তা চেতনা হৃদয়জুড়ে আছে স্কুল জীবনের বন্ধুরা। বর্তমানে বন্ধুদের মধ্যে মানসিক দূরত্ব দেখতে পাচ্ছি।
তাই একে একে সব বন্ধুকে ফোন করতে লাগলাম। ডা. গোলাম মোস্তফা সোহেল, অ্যাডভোকেট শাখাওয়াত হোসেন শাহীন, অফিসার সাইফুল্লাহ, শহিদুল্লাহ সুমন, আলী হায়দার রাসেদ, আ. মতিন সুমন, শিল্পপতি ওয়াহিদ উল্লাহ, মো. ফরহাদ, প্রবাসী আলা উদ্দিন, জহির উদ্দিন, গিয়াস উদ্দিন, শিক্ষক আবুজর গিফারী নায়েব, শিক্ষকা খালেদা আক্তারসহ ক্লাসমেট প্রায় সব বন্ধুদের সঙ্গে কথা হয়। কিন্তু কিছু বন্ধু কেন আমার সাথে আপনি আপনি করে কথা বলছে! স্কুল জীবনের ছোটবেলার বন্ধুরা আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করছে শুনে নিজেকে বেশ ছোট মনে হচ্ছিল। কি এমন পরিবর্তন হয়েছে আমার। প্রায় বন্ধুরা আমার সাথে এমন ভাব নিলো কেন? বন্ধুদের কাছ থেকে এমন আচারন (ভাল কিছু নয়) সৌভনীয় নয়।
অর্থ, স্বার্থ, শিক্ষা নাকি অন্য কোনো কারণে?
অবশেষে বন্ধুরা স্বীকার করতে বাধ্য হলো আমি কেন তাদেরকে না জানিয়ে প্রবাসে গেলাম এবং দীর্ঘ সময় যোগাযোগ করলাম না কেন? তাই সব বন্ধুরা রাগ করেছে। দীর্ঘদিন যোগাযোগ না থাকায় মান অভিমানের কথাগুলো সবার কাছ থেকে উঠে এসেছে। এখন আবার যেন বন্ধুত্বের বন্ধন সজীবতায় পিরে এল। সম্পর্কের গুরুত্বে সাময়িক দুরুত্ব হলেও সবাই যেন হারানো জীবন ফিরে ফেল। চোখের আড়াল হলেও মনের আড়াল হয়না আসল প্রকৃত বন্ধুরা এটাই প্রমাণিত।
দু'দিন আগে বন্ধু বিপুলকে ফোন দিলাম। সে ক্লাসের রোল ১ ফাস্ট বয়। একটা প্রাইভেট হাসপাতালে আছে। সেও তাই আপনি আপনি শুরু করলো। কি ব্যাপার বলতো! তুই ও আমাকে আপনি আপনি করছিস কেন? এ কথা সে কথা বলার পর সে নিজ থেকে বলতে শুরু করল তুইতো আগের মতই আছিস। অনেক দিন যোগাযোগ না থাকার কারণে হয়ত তুই রাগ করবি আমার ধারণা হয়েছে বদলে গেছিস। এখনতো দেখছি তুই বন্ধু আগের মতোই আছিস।
দীর্ঘদিন পর ছোটবেলায় শৈশব-কৈশোর কালে ফিরে গেলাম। কিযে আনন্দো লাগছে কাউকে বলে বুঝাতে পারবো না। সেই সময় সকল বন্ধুদের হাসিমাখা মুখখানা ভেসে উঠলো। হঠাৎ ডজন ডজন এসএমএস আমার ফোনে। কনেপক্ষ থেকে এসেছে বরের কাছে। আর সেই বর হলো নায়েব। সন্তানের পিতা হয়েও নিজকে অবিবাহিত তরুন মনে করে। সে আমার স্কুল জীবনের চর্তুদশী বন্ধু। দীর্ঘ সময় কেটেছে ফোনে গল্প আর স্কুল জীবনের স্মৃতির স্মরণিকার মধ্য দিয়ে। তখন বুঝলাম বন্ধুত্বের জীবন কতই না মধুর। ফিরে গেলাম জীবনের সেই ফেলে আসা মুহূর্তে। সত্যি বন্ধুত্ব সম্পর্ক কখনোই বদলায় না, বদলায় সময়।
বন্ধুত্বের মূল্যায়ন সত্যি কি সবাই বুঝে? নিজকে প্রশ্ন করলে উত্তর অবিশ্যয়ই বেরিয়ে আসবে। উত্তর আসবে যা কিছু বুঝি তবে সেইটা আমরা হারিয়ে পেলার পর বুঝতে পারি। ইতি মধ্যে ক্লাসমেট ২বন্ধুকে চিরদিনের জন্যে হারিয়েছি। জীবন থেকে হারিয়ে গেলেও হৃদয় থেকে নয়। তাদের নিয়ে অনেক স্মৃতি রয়েছে আমাদের। যা কখনো ভুলার নয়।
একজন বন্ধু কতটা শিক্ষিত বা ধনী-গরিব তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। উন্নত চরিত্রে বন্ধুত্বের সম্পর্ক কতটা আন্তরিক সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। ছোট বেলায় আমাদের বন্ধুত্ব ছিল স্বার্থ এবং শর্ত ছাড়া। ঠিক তেমনি বন্ধুরা যত শিক্ষিত এবং অর্থে ধনী হোক না কেন, বন্ধু -বন্ধুই থেকে যায়। সময়ের ব্যবধানে কিছু বন্ধু আমদের স্ট্যাটাস বা চায়ের আড্ডায় স্থান পায়না। অথচ আমাদের দেখার পর তাদের চক্ষু শিতল হয়ে কাছে সুটে আসে। এমন সব প্রাণের বন্ধুদের খেয়াল রাখা দরকার বড় স্বার্থপর যেন না হয় কোন বন্ধু।
আমার সঙ্গে যাদের শিক্ষাজ্ঞনে সম্পর্ক ছিল তারা আমার সেই সময়ের বন্ধু। দক্ষিণ আফ্রিকা (প্রবাসে) আসার পর কয়েক বছর তেমন কারো সঙ্গে প্রথম দিকে ভালো যোগাযোগ ছিলো না। ফেসবুকের মাধ্যমে বা সোশ্যাল কাজ করতে গিয়ে একে একে প্রায় সবার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়। অহংকারী ইস্পাত কঠিন মনের দু'একজন বন্ধু ছাড়া সবার সঙ্গে যোগাযোগ আজও আব্যহত রয়েছে। বন্ধুত্বহীন জীবন সত্যি মূল্যহীন। তাই আর ঘৃণা নয়, সুমিষ্ট হাঁসি দিয়ে বলি বন্ধু হও হাতটা বাড়াও। হৃদয়কে কোমল করে নাও সুভাস দিয়ে।
ভালো বন্ধু আজীবনের সম্পদ। অনেকেই সুইমিংপুলের পাশে থেকেও ময়লা ডোবাই গা-ভাসায়। প্রকৃত বন্ধু চিনতে ভুল করে। একটা ভুল সারাজীবনের কান্না। জীবনে ভালো আর মন্দ দু'ধরনের বন্ধু থাকে। তাই অনেকেই বন্ধুত্বের মর্ম বুঝতে পারে না। মরণকালে সুটে এসে সম্পর্কের গুরুত্বে ফুল দিয়ে তখন অশ্রু ছাড়া কিছুই (পাবেনা) থাকে না। তাই দাঁত থাকতে দাঁতের মর্মে বন্ধুত্বের সম্পর্কের মূল্যায়ন বুঝতে শেখ।
"বন্ধুত্ব" হাত আর চোখের মতো। হাত ব্যাথা পেলে চোখ দিয়ে পানি ঝরে পড়ে। আবার চোখ দিয়ে পানি ঝরে পড়লে, তখন সেই ব্যথায় ব্যথাতুর হাতটি চোখের পানি মোছে দিতে ব্যস্ত হয়ে যায়। সুতরাং ব্যথা আর চোখের পানির সম্পর্ক যেমন ঘনিষ্ঠ, তেমনি বন্ধুত্বের বন্ধনও একই সুতায় গাঁথা। কর্মব্যস্ত জীবনে বন্ধুরা চড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও হৃদয় থেকে দূরে নয়। তাই সবার অন্তরজুড়ে থাকতে হবে ষোলআনা বাঁধন।
বর্তমানে আমার বন্ধুরা সমাজ সেবক, রাজনৈতিক নেতা, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, বড় অফিসার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অ্যাডভোকেট, বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়েছে। আমি আমার সকল বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে গর্ব করি।
জীবনে আইকিউ, মেধাশক্তি, জ্ঞানশক্তি সামাজিক (মর্যাদা) অবস্থা সব বয়সে সবার সমান হয় না। সবাই সবকিছু অর্জন করতে পারে না। এমন অনেকেই আছে ক্লাস ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত রোল ১ নিয়ে এসএসসি অংকসহ একাধিক বিষয়ে লেটার নিয়ে পাশ করে এবং অনার্স, মাস্টার্স বড় বড় সার্টিফিকেট অর্জন করে। কিন্তু তারা বাস্তব জীবনে এসে সংসার জীবন অংকের মতো সঠিক মিলাতে পারে না। তাই জীবনে সুখী হতে পারে না।
আবার ছোটবেলায় যে বন্ধু ক্লাসের পেছনে বসেছে হয়ত সে ভালো ছাত্র ছিল না। পরবর্তী জীবনেও যে তাকে পেছনে থাকতে হবে এমন কোনো কথা নেই। মহান মালিকের কাছে সাফল্য চাওয়া, নিজের চেষ্টা, প্রচেষ্টা, কঠিন সাধনা, সঠিক সময় এবং যুগান্তকারী সিন্দান্ত নিয়ে ভাগ্যের পরিবর্তন হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। মানুষের জীবন পরিবর্তনশীল। সফলতা সুখি সমৃদ্ধ জীবন সময়ের ব্যবধানে কর্মের মাধ্যমে আসবেই। জীবন চলার পথে যে জিনিষটার গুরুত্ব সব চেয়ে বেশি তা হলো আত্মবিশ্বাস। আর বিশ্বাসের মাঝে নিঃশ্বাসে বেঁচে থাকে বন্ধুত্বের জীবন।
অনেক বন্ধু পথভ্রষ্ট হয়ে অন্ধকারে ডুবে হাবুডুবু খাচ্ছে, তাদের বাঁচাতে হবে। যেন তারা অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। এ দায়িত্ব শুধু সরকার, বিশিষ্ট ব্যক্তি বা রক্তের সম্পর্কের ঘাড়ে চাপালে হবে না। ভালো বন্ধু হিসেবে আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে।
কারণ পরিবারের কোনো সদস্য বিপথে, অন্ধকারে ধংসের দিকে হারাতে শুরু করার সময় যে সিমটমগুলো প্রথমে দেখা যায় সেগুলো পরিবারের আগে অন্য কেউ সচারচার লক্ষ্য করতে পারে না। তবে কিছু কাছের প্রিয়বন্ধু উপলদ্বি করতে পারে। জীবনে সুখ দুঃখের অনেক কথাই বন্ধুর সঙ্গে ভাগাভাগি করা হয়, যে কথাগুলো হয়তো পরিবারে কখনোই বলা হয়নি। আমি মনে করি একজন প্রকৃত ভাল বন্ধুই হতে পারে জীবন পরিবর্তন করার জন্য যথেষ্ট। জীবনে শ্রেষ্ঠ বন্ধুর দাবি না করে একজন ভালো বন্ধু হওয়া প্রয়োজন। জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া হবে তখনই যখন কোনো বন্ধুর মানসিক দিকসহ সব ধরনের বিপদে-আপদে ছুটে এসে পাশে থাকতে পারবে।
জীবনে বন্ধুর পাশে এগিয়ে আসার মধ্যে সার্থকতা। তাইতো প্রচলিত প্রবাদ আছে- বিপদে বন্ধুর পরিচয়। আসলেও তাই। একটাই কামনা পৃথিবীর সব বন্ধুরা অনেক অনেক আনন্দে উৎসবে থাকুক। কাউকে যেন কোন বন্ধু দ্বারা কষ্টের কারণ না হতে হয়। আর একটা কথা জীবনের ক্লান্তিলগ্নে শুধু রক্তের সম্পর্কগুলো পাশে থাকলেও তার পাশে কিছু ভালো বন্ধু থাকে। সেই ভালো বন্ধু যেন আমরা হতে পারি।