জাতিসংঘ, গ্লোবালাইজেশন এবং আমরা
রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে
প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০২:৫৪ পিএম
দীর্ঘ ছয় বছর (১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল) পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। বিজয়ী মিত্রশক্তি পরবর্তীকালে যাতে যুদ্ধ ও সংঘাত প্রতিরোধ করা যায় এই উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়। তখনকার বিশ্ব রাজনীতির পরিস্থিতি জাতিসংঘের সাংগঠনিক কাঠামোতে এখনও প্রতিফলিত হয়ে চলেছে।
উদাহরণস্বরূপ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫টি স্থায়ী সদস্যদের ভেটো প্রদানের ক্ষমতা। এই পাঁচটি দেশ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া এবং গণচীন। এর কারণ হলো এরা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী দেশ।
অক্টোবর ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা ১৯৩টি। এর সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে অবস্থিত। সাংগঠনিকভাবে জাতিসংঘের প্রধান অঙ্গ সংস্থাগুলো হলো সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ, সচিবালয়, ট্রাস্টিশীপ কাউন্সিল এবং আন্তর্জাতিক আদালত। এছাড়াও রয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনেস্কো, ইউনিসেফ ইত্যাদি।
জাতিসংঘের প্রধান নির্বাহী হলেন এর মহাসচিব। কথিত রয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন সমস্যা এবং শত কোটি মানুষের জীবনের মান উন্নয়নে জাতিসংঘের মহাসচিব এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আর তাই এই কাজের জন্য সেরা ব্যক্তিটিকে বেছে নেওয়া জরুরি। কিন্তু জানেন কি এই নির্বাচন প্রক্রিয়া গোপনীয় এবং সেখানে মাত্র ৫টি রাষ্ট্র এই সিদ্ধান্তের ক্ষমতা রাখে? এটা আমাদের সবাইকে প্রভাবিত করে।
ভেটো কী এবং কে বা কারা ভেটো দেবার ক্ষমতা রাখে এবং কেন? ভেটো ইংরেজি শব্দ এর মানে বাধা। ভেটো হচ্ছে একপক্ষীয়ভাবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, দেশের মনোনীত প্রতিনিধি কর্তৃক কোনো সিদ্ধান্ত বা আইনের ওপর স্থগিতাদেশ প্রদান করা।
অবশ্যম্ভাবী শব্দ হিসেবে ভেটো শব্দটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ব্যাপকভাবে পরিচিত ও এটি বৈশ্বিকভাবে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া এবং ফ্রান্স এই ৫টি দেশের প্রত্যেকেই ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারী। এর মাধ্যমে যেকোনো একটি দেশ নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত যেকোনো ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আইন প্রণয়ন অনুমোদনে বাধা প্রদান করতে পারে।
যার কারণে অন্য সব দেশ প্রস্তাবের পক্ষে থাকলেও কোনো কাজ হয় না। যেমন গণহত্যা সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলো ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে বিধায় অনেক সমস্যার কোনো সমাধান নেই। নিরাপত্তা পরিষদের ৫টি স্থায়ী সদস্যদেশ বেসামরিক মানুষদেরকে রক্ষার চেয়ে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ বা ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেয়। সেক্ষেত্রে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বেসামরিক মানুষদেরকে রক্ষায় দারুণভাবে ব্যর্থ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর এভাবেই চলছে জাতিসংঘের কাজ। বিশ্ব রাজনীতিতে জোর যার মুল্লুক তার (might is right) কনসেপ্ট ব্যবহৃত হচ্ছে। যার ফলে বাংলাদেশের মতো দেশের তেমন কোনো ক্ষমতা নেই জাতিসংঘে প্রভাব বিস্তার করা।
আসুন জানি এখন কীভাবে চলছে বাংলাদেশের রাজনীতি। সরকারের চেয়ে সরকারি এবং বেসরকারি দলগুলো সমাজের স্তরে স্তরে এমনভাবে দৌরাত্ম্য করছে যে সাধারণ মানুষ অনেক বিষয়ে একান্ত ন্যায়সঙ্গত কথা বলতে সাহস পাচ্ছে না।
দেশের প্রশাসন, শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থায় মারাত্মক ত্রুটি রয়েছে। সে কারণে শিক্ষার মানের অবনতি ঘটেছে। অবস্থার উন্নতির জন্য কোনো মহল থেকে কোনো উদ্যোগ নেই। আসলে এটি জাতীয় ব্যর্থতা। গোটা জাতিই এর জন্য দায়ী। তবে যারা যত ক্ষমতাবান, তারা তত বেশি দায়ী।
বাঙালি এবং বাংলাদেশি বিতর্ক এখন আর আগের মতো নেই। ফলে কেউ এখন বাংলাকে যে সোনার বাংলা করতে হবে তা নিয়ে ভাবে না। তবে মুসলিম বাংলা গঠনের চিন্তা করছেন কেউ কেউ। কিন্তু সেটা সমাধান নয়; কারণ মুসলিম শাসন দিয়েই তো ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সাথে দল বেধেছিলাম। কী পেয়েছি আর কী হারিয়েছি মনে আছে?
এখন দরকার নৈতিক আদর্শ নিয়ে আলোচনা এবং সমালোচনা করা। নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটিয়ে ধর্ম, বর্ণ, ভাষার দোহাই দিয়ে গণতন্ত্রের শাসন কায়েম করা সম্ভব হবে না। বরং দুর্নীতির অবসান ঘটাতে হবে।
সন্ত্রাস দূর করার জন্য বাংলাদেশে অপারেশন ক্লিনহার্ট, এনকাউন্টার, ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ইত্যাদি চালানো হচ্ছে। জঙ্গিবাদ দমনের জন্য বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জঙ্গিবাদবিরোধী যুদ্ধে শামিল থাকার চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে।
এভাবে সমস্যার কোনো সমাধান হতে পারে না। দেশে দিনে দিনে প্রতিশোধমূলক আচরণ এবং ঘৃণার বীজ বিশাল আকারে প্রভাব ফেলছে। এখন সময় এসেছে বুঝে শুনে কাজ করার। গণতন্ত্রের বিকল্প নেই কিন্তু কীভাবে তা পাওয়া সম্ভব? স্বল্প সময়ে সবকিছু সহজে ফিরে পাওয়া যাবে না।
কারণ উপরের বর্ণনায় বিশ্ব রাজনীতির অবস্থা এতটাই দুর্বল যে ন্যায়বিচার থেকে শুরু করে কোনো ভালো কিছুই আমরা আশা করতে পারি না। সেক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের সমস্যার সমাধান নিজেদেরকেই করতে হবে।
কোভিড-১৯ এর কারণে গোটা বিশ্ব সমস্যার মাঝে হাবুডুবু খেতে শুরু করেছে। গ্লোবালাইজেশন এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। বিশ্ব ভাবতে শুরু করেছে কীভাবে প্রযুক্তিকে আরও জোরালো করা এবং সেই সঙ্গে মানুষের ফিজিক্যাল মুভমেন্ট বন্ধ করা যায়।
গ্লোবালাইজেশনের অবসান ঘটাতে হলে গ্লোবাল মুভমেন্টের বন্ধ করতে হবে। তা কি আদৌ সম্ভব এখন? ধর্ম, রাজনীতি, বর্ণ ভাষাগতভাবে মানুষ জাতি চেষ্টা করেছে পৃথিবীতে স্থিতিশীলতা আনতে, সম্ভব হয়নি। এখন কী করা বাকি রয়েছে বা আমাদের কী করণীয় যদি একটি সুন্দর পৃথিবী পেতে চাই?
আমি মনে করি নিজ নিজ জায়গা থেকে পরিবর্তন আনতে হবে। Agree to disagree concept-এ বিশ্বাস আনতে হবে। দরিদ্রতা দূর করতে হবে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ কমাতে হবে, respect and be respected, accept and be accepted কনসেপ্টের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। ভিক্ষা, ধার বা অনুদান কখনও স্বাধীনতা দিতে পারে না। সবশেষে জাতিসংঘের পরিবর্তন ঘটাতে হবে যেমন ৫টি সুপার পাওয়ার নয়, ১৯৩টি দেশের সমন্বয় ঘটাতে হবে সব ধরণের সিদ্ধান্তে।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com