সুইডেনের ‘এক্সপেডিশন রবিনসন’ ও খেলাধুলায় অনৈতিকতা
রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে
প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২০, ০৫:৩৮ এএম
সুইডেনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত দুই টেনিস খেলোয়াড়
এক্সপেডিশন রবিনসন একটি সুইডিশ টেলিভিশন শো। ইউনাইটেড কিংডমের টিভি চ্যানেল প্ল্যানেট ২৪ সর্বপ্রথম এই ফর্মেটটি চালু করে ১৯৯৪ সালে। ১৯৯৭ সালে সুইডিশ টেলিভিশন এই শোটি সর্বপ্রথম প্রচার করে। সেই থেকে এটি সুইডেনে দেখানো হচ্ছে। এক্সপেডিশন রবিনসন শোটি তৈরির মূল কারণ নির্জন দ্বীপে অপরিচিত কিছু লোককে প্রথমে একত্রে রাখা, যেখানে তারা নানা ধরণের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে জয়ী হয়ে সেখানে টিকে থাকবে।
তারা নিজের জন্য খাবার, আগুন এবং আশ্রয়ের ব্যবস্থা করবে। কেউ যদি প্রথম দিকে বাদ পড়ে তাকে নির্জন আরেকটি দ্বীপে রাখা হয়। রবার্ট অ্যান্ডেরসন নামে এক সুইডিশ যে রবিনসন রব্বান নামেও পরিচিত, এই অনুষ্ঠানটি রেকর্ডিংয়ের সময় নির্জন দ্বীপে বেশিরভাগ দিন অতিবাহিত করার বিশ্বরেকর্ড গড়েছিল। আগের বিশ্বরেকর্ডটি ছিল ১১৯ দিন, অ্যান্ডারসন নতুন রেকর্ড করে ১২৫ দিন নির্জন দ্বীপে বাস করে।
যেহেতু এক্সপেডিশন রবিনসন একটি চ্যালেঞ্জের প্রতিযোগিতা সেক্ষেত্রে প্রতিযোগীরা বিভিন্ন অ্যাকটিভিটিসের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং যে জয়ী হয় সে ছাড়া বাকিরা গেম থেকে বাদ পড়ে। এছাড়া নানাভাবে গ্রুপের মধ্যে জোট তৈরি থেকে শুরু করে নানা ধরণের ট্যাকটিকের মাধ্যমে সবাই যার যার জায়গা থেকে টিকে থাকার চেষ্টা করে। অনেক সময় সবাই এক জোট হয়ে ভোটের মাধ্যমে একজন যোগ্য ব্যক্তিকে গ্রুপ থেকে বের করে দেয়।
এই খেলায় শুধু বেস্ট পারফরমেন্স হলেই হবে না। এরা জেতার জন্য যা প্রয়োজন ট্যাকনিক্যালি তার কোন কিছুই করতে দ্বিধা করে না। এভাবে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস প্রতিযোগিতা চলতে চলতে শেষ অবদি যে টিকে থাকতে পারে সেই জয়ী হয় এবং চূড়ান্ত বিজয়ী হয়ে বড় অংকের অর্থ পুরষ্কার পায়। প্রোগ্রামটি দেখলে বর্তমান বিশ্বের কুৎসিত রাজনীতির সঙ্গে এর বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
সিনাইয়া সাভিজা নামে একজন রাশান বংশোদ্ভূত সুইডিশ প্রতিযোগী ১৯৯৭ সালে প্রথম এই এক্সপেডিশন রবিনসন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। সে সব বিষয়ে ভালো পারফরমেন্স করা স্বত্বেও প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়ে। মনের দুঃখে বাড়িতে ফিরে এসে সে ট্রেনের সামনে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। তার বাদ পড়ার পেছনে যে কারণ ছিল তা হলো গ্রুপের অন্য সবাই ভোটের মাধ্যমে তাকে সরিয়ে দেয় যা সে মেনে নিতে পারেনি।
এক্সপেডিশন রবিনসন প্রোগ্রামটি টেলিভিশনে প্রচারের কয়েকদিন আগে সাভিজার বিধবা স্ত্রী নার্মিনা সাভিজা তার আইনজীবীর মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি প্রচার বন্ধের দাবী করে। সে মনে করে তার স্বামীকে গ্রুপের সবাই মিলে ডিস্ক্রিমিনেট করে বাদ না দিলে সে জিততে পারত বিশ্বের প্রথম এই ধরণের প্রতিযোগিতা। যেহেতু অনুষ্ঠানটির অনিয়মের কারণে সিনাইয়া মৃত্যুবরণ করেছে বিধায় এটির প্রচার বন্ধ করে দেওয়া উচিত। সুইডিশ টেলিভিশন এটি প্রত্যাখ্যান করে এবং সমস্ত প্রতিবাদ স্বত্বেও এটি প্রচার করে। আর এ কারণে দর্শকরা এই টিভি চ্যানেলকে ফ্যাসিবাদী টেলিভিশন এবং বুলিং টেলিভিশন বলে অভিহিত করেছে।
আমি প্রোগ্রামটি সেই ১৯৯৭ থেকে ফলো করে আসছি। প্রতি বছর প্রোগ্রামটি সুইডিশ টেলিভিশনে দেখানো হয়। গতকাল এক্সপেডিশন রবিনসন অনুষ্ঠানটির ফাইনাল দিন ছিল। এ বছর যে সেরা রবিনসন হতে পেরেছে সে এক ভিন্ন চরিত্রের মানুষ, নাম মাইকেল। তাকে সবাই পছন্দ করেছে। কোনোরকম দুই নাম্বারি বা ফেইক সম্পর্ক না করে, মিথ্যা কথা না বলে, কোনো জোটের কুৎসিত চিন্তা চেতনায় না পড়ে, সে তার সততার পরিচয় দিয়েছে সারাটি সময় এবং সেই জিতেছে শেষ পর্যন্ত। মাইকেল পেশায় একজন খ্যাতনামা বাবুর্চি কিন্তু সে তা বলেনি। তার পলিসি ছিল আগেভাগে পরিচয় না দিয়ে কাজের মাধ্যমে সবার মন জয় করা। সে যখন গ্রুপের হয়ে লড়েছে তখন গ্রুপকে জয়ী করতে সামনের দুটো দাঁত পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছে।
খেলাটি ছিল হাত বাঁধা অবস্থায় মুখ দিয়ে ঝুলন্ত গোস্ত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় এনে একটি হাড়িতে রাখতে হবে। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যে বেশি গোস্ত সংগ্রহ করতে সক্ষম হবে সেই জিতবে। বেচারা মাইকেল দাঁত দিয়ে গোস্তের হাড় কামড়াতে গিয়ে সামনের দুটো দাঁত ভেঙ্গে ফেলে।
মাইকেলের সততা, নিষ্ঠা অন্যকে অনুপ্রাণিত করেছে। সেইসঙ্গে কাউকে অন্যায়ভাবে ঠকিয়ে নয় বরং লড়াই করে জিতার মানসিকতা জুগিয়েছে। সে সবাইকে দেখিয়েছে একজন উদীয়মান তারকা হতে হলে খেলাধুলার পাশাপাশি অন্যান্য কী কী গুণ থাকা দরকার। সু-শিক্ষা যেমন সুনাগরিক তৈরি করে, কু-শিক্ষা তেমনি একজন ব্যক্তির অধঃপতন ও ধ্বংসের রাস্তা প্রশস্ত করে।
এবারের রবিনসন কনটেস্টে জয়ী হতে সে যেভাবে লড়াই করেছে তা ছিল অতীতের সমস্ত ঘটনার ব্যতিক্রম। নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণেই সমাজে অনেক ধরনের পাপ ও অন্যায়ের পথ প্রশস্ত হয়। অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্টরাই এখানে বিভিন্ন রকমের পাপ ও অন্যায় করতে বিন্দুমাত্র সংকোচবোধ করে না। মাইকেল যে চরিত্র এক্সপেডিশন রবিনসন প্রোগ্রামে দেখিয়েছে এবং যে শিক্ষা দর্শকরা পেয়েছে তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে সবার মাঝে। কারণ আমরা তো এমন কিছু জানতে, শিখতে এবং দেখতে চাই যা আমাদের সমাজ জীবনে নৈতিকতার অবক্ষয় রোধে ও মূল্যবোধ সৃষ্টিতে সাহায্য করে।
রহমান মৃধা, দূরপরবাস সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com