
প্রিন্ট: ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৩১ পিএম

প্রকাশ: ১৩ মে ২০২০, ১০:৩৩ পিএম

আরও পড়ুন
করোনা মহামারী মোকাবেলা তথা বাংলাদেশকে আবারও সুস্থ করে তোলার জন্য পেশা ভিত্তিক বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় এখন সময়ের দাবি। বৈশ্বিক করোনা মহামারি সুন্দর মানব সমাজ গঠনের জন্য উন্মোচন করেছে নতুন নতুন চিন্তার দ্বার। এক কথায়, করোনা মহামারী খুব পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছে দুটি কথা।
(১) রাষ্ট্রের সীমানা বা দূরত্ব বলতে পৃথিবীতে আর কিছুই নেই। বরং জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা এবং সক্ষমতাই সবকিছু। এবং (২) পুঁজিবাদী রাষ্ট্র পরিচালনা পর্ষদকে অর্জন করতে হবে। সাধারণ নাগরিকের অনাস্থা নয় বরং আস্থা এবং পরিচয় দিতে হবে সাম্যবাদীতার।
প্রশ্ন জাগে, করোনা পরবর্তী পৃথিবীকে আমরা কেমন দেখতে চাই? এভাবে বললে ভুল হবে বরং আমরা কিভাবে এই পৃথিবীকে সাজাতে চাই সেটা বলা যেতে পারে। করোনা পরবর্তী পৃথিবীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা কি আগের মতো হবে নাকি মানুষের কল্যাণের জন্য হবে?
এই প্রশ্নগুলো বিশ্লেষণে দেখা যাবে, ‘করোনা মহামারীর পূর্ববর্তী-বর্তমান-পরবর্তী পৃথিবী’ নিয়ে বিভিন্ন পেশা বা গবেষণায় জড়িত বিজ্ঞানীদের বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটে বিভিন্ন আঙ্গিকে। যেমন, প্রিয় পাঠক আপনাদের জন্য, বাংলাদেশ ডক্টরস প্লাটফর্ম ইন ফিনল্যান্ড (বিডিপিএফ)-এর সঙ্গে জড়িত অল্পসংখ্যক বিজ্ঞানী, করোনা-ভাবনা নিয়ে নিম্নে তাদের মতামত প্রদান করেছেন।
বহু-সংস্কৃতি বুদ্ধি বিশেষজ্ঞ সাইদুল কাজীর মতে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের দিক বিবেচনা করলে, বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক- জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের জন্য আমরা এখন জীবন এবং মৃত্যুর মাঝামাঝি অবস্থায় অবস্থান করছি।
স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং নিয়মিত শরীর চর্চার মাধ্যমেও আমাদের অনেকটাই রক্ষা করতে পারি এই সংক্রমণের হাত থেকে। মোদ্দাকথা, এই সংক্রমণ থেকে বাঁচতে হলে জনসচেতনতা সৃষ্টি খুবই জরুরি। একই সঙ্গে এ কথা বলতে হয়, করোনা মহামারী তথা করোনাভাইরাস প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে আমরা রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার অর্থনীতিতেও অবদান রাখতে পারি। যদিও অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির বিপর্যয় ঘটাবে কোভিড-১৯।
সমাজ এবং সার্কুলার অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ মো. মঞ্জুরে মওলা করোনা মহামারীকে দেখছেন ‘প্রকৃতি ও মানুষ-বান্ধব’ অর্থনীতির নির্দেশক হিসেবে। কারণ এই মহামারীর জন্য অর্থনীতির ভাষায়, যে ‘ডিমান্ড এন্ড সাপ্লাই সক’ দেখা দিয়েছে এবং আগামীতে তা আরও প্রকটভাবে দেখা দিতে পারে।
অর্থনীতির এই অবস্থাকে মোকাবেলা করার জন্য ‘প্রকৃতি ও মানুষ-বান্ধব’ স্বনির্ভর অর্থনীতির দিকে এগুতে হবে। যা মানব কল্যাণকর পৃথিবীকে আরও সুন্দর ও টেকসই করার ক্ষেত্রে আলো দেখাতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, করোনা পরবর্তী সময়ে আমরা কোন অর্থনীতিকে বেছে নিব। করোনা পূর্ববর্তী অর্থনীতি নাকি মানব কল্যাণকর সমন্বিত-স্বনির্ভর অর্থনীতি। প্রিয় পাঠক প্রশ্নটি থাকলো আপনার কাছে।
লজিস্টিক এবং সরবরাহ চেইন বিশেষজ্ঞ এ এইচ এম শামসুজ্জোহা মনে করেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি বাংলাদেশে শিক্ষানীতি পরীক্ষা করার সুবর্ণ সুযোগের দ্বার খুলে দিয়েছে। যার মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ একটি ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করাতে পারে। শিক্ষাব্যবস্থার এই নতুন যুগটি দেশের বৃহত্তম অংশের মানুষের সঙ্গে, সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য (শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না গিয়ে) শিক্ষার সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারে।
বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ বাণিজ্য ক্ষেত্রেও ই-কমার্সের অংশীদারিত্বের ক্রমবর্ধমান সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। যেমন, অনলাইন বাণিজ্যের অংশীদারিত্ব বর্তমানে প্রায় ২.৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। যদিও কোভিড-১৯ এর কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে প্রাথমিক বাধা রয়েছে, যা বিশ্বের প্রতিটি দেশকে তার স্থানীয় শিল্প বিকাশে মনোনিবেশ করতে সহায়তা করবে। যা আমাদের স্থিতিশীল সরবরাহ চেইন বজায় রাখার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সরকারকে সর্বস্তরে জনগণ-বান্ধব প্রযুক্তি নীতির বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে।
টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ শাহরিয়ার শাহাবুদ্দিনের অভিমত, গত কয়েক দশক ধরে মানুষের সামাজিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি সহায়ক শক্তি হিসেব আসন করে নিয়েছে। তাই করোনার মতো মহামারী মোকাবেলায় ব্যাপকভাবে ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
এ ছাড়াও করোনা মহামারির পরবর্তী সময়ের রাষ্ট্রের মূল চ্যালেঞ্জগুলো (সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক) মোকাবেলা করতে হলে প্রযুক্তির ব্যবহার শহর অঞ্চল এবং শিক্ষিত ও তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বরং তার যথাযথ প্রয়োগ ও ব্যবহার শেখাতে হবে তৃণমূল পর্যায়ের সকল জনগোষ্ঠীকে।
এক কথায়, আগামীতে দেশের সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হলে ইন্টারনেটকে দেখতে হবে বিদ্যুৎ ও পানির মতো ইউটিলিটি হিসেবে। এ জন্য বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রতিটি নাগরিক এর কাছে স্বল্প মূল্যে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেয়া। দেশব্যাপী একটি শক্তিশালী টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো তৈরি করা সম্ভব হলে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে আমরা উত্তর ইউরোপের দেশ ফিনল্যান্ড থেকে শিক্ষা নিতে পারি।
টেকসই পরিবেশ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ এস এম শফিকুল আলমের অভিমত, করোনা মহামারী আমাদের স্পষ্ট করে বলেছে বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদী হতে। অন্যদিকে আরও বলেছে, বৈশ্বিক যে কোন মহামারীকে পরাভূত করতে হলে প্রয়োজন বুদ্ধিভিত্তিক শাসনতন্ত্র, দক্ষ নেতৃত্ব এবং সঠিক কৌশল গ্রহণ। করোনা সংক্রমণ রুধ এবং মহামারির পরে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিপর্যয় ঠেকাতে বাংলাদেশের সরকারকে নিতে হবে স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘ মেয়াদী কৌশলগত কর্ম-পরিকল্পনা।
দীর্ঘ মেয়াদী কর্ম-পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পরিবেশে দূষণ হ্রাস করার লক্ষ্যে যথাযথ কৌশল গ্রহণ, রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা বাড়ানো এবং সময়োপযোগী সঠিক কর্মসূচী গ্রহণে যত্নশীল হতে হবে। যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা, টেকসই উন্নয়ন এবং করোনার মত পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত স্বাস্থ্য সমস্যা প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
জৈব বিজ্ঞানী এবং দন্ত বিশেষজ্ঞ এহছানুল হক অপু মনে করেন, কোভিড-১৯ মহামারী পরিস্থিতি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য শিল্পের স্বাস্থ্যসেবার খাতগুলোতে খুলে দিয়েছে অনেক সম্ভাবনার দ্বার। যেমন, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) ডব্লিউএইচওর সঙ্গে যৌথভাবে, বাংলাদেশেই উৎপাদন করতে পারে গুণগত অর্থাৎ বিশ্বমানের পিপিই। ফলে রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় কমে যাবে, দেশের পিপিই চাহিদা পূরণের সঙ্গে তা রপ্তানি করার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ দিবে।
একই সঙ্গে করোনা মহামারী পরিস্থিতির মাত্রা বেড়ে গেল আমদের দরকার হবে ২৫ হাজার ভেন্টিলেটর (দ্যা ডেইলি স্টার, ২৯ এপ্রিল)। এই চাহিদা পূরণেও বিভিন্ন টেকনিক্যাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ইনোভেটিভ গবেষণা কেন্দ্রগুলো যৌথভাবে তৈরি করতে পারে ভেন্টিলেটর। যা বর্তমান এবং করোনা মহামারী পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্যশিল্পের বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও অনেক দূরে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
প্রিয় পাঠক, উপরে বর্ণিত বিজ্ঞানীদের করোনা মহামারী নিয়ে প্রদানকৃত মতামত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, করোনা মহামারীর মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করার জন্য (এক) প্রযুক্তি নির্ভর সচেতনতা বাড়াতে হবে, (দুই) সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা অর্জনের পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে; এ ক্ষেত্রে সরকার ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার ঘোষণা করতে পারে, (তিন) সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশের উদীয়মান সকল শিল্প ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করতে হবে, (চার) পরিবেশ বান্ধব সমাজ গঠনের জন্য গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করার পদক্ষেপ নিতে হবে, এবং (পাঁচ) অর্থনীতি চাকা সচল রাখার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হলে প্রকৃতি ও মানুষ-বান্ধব’ স্বনির্ভর অর্থনীতি বেছে নিতে হবে।
এছাড়াও করোনা মহামারী নিয়ে বিভিন্ন পেশা বা গবেষণায় জড়িত বিজ্ঞানীদের প্রদেয় বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিগুলো থেকে একটি কথাই বের হয়ে এসেছে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে আমাদের কী করা উচিত ও করোনা মহামারির পরবর্তী পৃথিবীকে আমরা কিভাবে সাজাতে হবে।
সর্বোপরি, বিজ্ঞানীরা আলোকপাত করেছেন, করোনা মহামারীর মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করার মাধ্যমে আমরা পেতে পারি নতুন নতুন ইনভেস্টর, যা স্থানীয়ভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের পুনর্জন্ম দিবে এবং এতে করে ব্যয়বহুল বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় ঘটতে পারে। একই সঙ্গে করোনা মহামারি মোকাবেলার মাধ্যমে পার্থিব জীবনে আমরা দেখতে পারি পশুত্ব নয় মনুষ্যত্ব, শঠতা নয় সততা, মানবহীনতা নয় মানবতা, পরনির্ভরশীলতা নয় স্বনির্ভরতা এবং স্বাধিকারের সঙ্গে স্বাধীনতা।
লেখক: ড. মোঃ মঞ্জুরে মওলা, শিক্ষক-আলতো বিশ্ববিদ্যালয় ফিনল্যান্ড, ড. এ এইস এম শামসুজ্জোহা, অধ্যাপক ভাসা বিশ্ববিদ্যালয় ফিনল্যান্ড, ড. সাইদুল কাজী, শিক্ষক-তাম্পেরে অ্যাপ্যালাইড সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় ফিনল্যান্ড, ড. শাহরিয়ার শাহাবুদ্দিন, টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, নোকিয়া ফিনল্যান্ড, ড. এস এম শফিকুল আলম, গবেষক তাম্পেরে অ্যাপ্যালাইড সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, ফিনল্যান্ড এবং ড. এহসানুল হক অপু, রিসার্স অ্যাসোসিয়েট এবং ফ্যাকাল্টি-মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র