ঘরের জানালা থেকে দেখি হলুদ পাতা আর কালচে ডালে সাদা ও বেগুনী রঙের ফুল ফুটে আছে গাছে গাছে। তার পিছনে নীল আকাশ ঝুলে আছে উজ্জ্বল সূর্যালোক ও শাদা মেঘ নিয়ে। পাপড়ি উড়ছে বাতাসে বাতাসে। বর্ণীল সব পাপড়ি ঝরে পড়ছে নগরীর কালো-পিচ-ঢালা পথে। যে পথে কোলাহল নেই, মানুষ আর যানের চলাচল নেই। এমন মনোরম দৃশ্যে আমিও বেড়িয়ে এলাম ঘরের দরজা খুলে। প্রতি বসন্তেই এমনভাবে প্রকৃতি সাজে নিউইয়র্কে। সাত বছরে প্রকৃতিকে কোনো দিন এমনভাবে অনুভব করিনি। দেখিনি তার এমন অপরূপ সাজ।
রুটিনবাঁধা জীবন ছিল সাত বছরের প্রতিটা দিন। শুধু আমি নই। নিউইয়র্কেও সব কর্মজীবী মানুষ কেউ ঘড়ি ধরে চলতে হয়। এখন সবাই পেয়েছে শ্রান্তির বিশ্রাম, ঘড়ির অ্যালার্ম আর নাগরিক জীবন থকে মুক্তি, স্বস্তিতে ঘুমানোর সুযোগ। এমন একটি সময় যেন চেয়ে আসছিল সবাই যুগ যুগ ধরে, মনে মনে। করোনাভাইরাসের কারণে যখন সবকিছু বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল তখন দেখেছি মানুষ কী স্বার্থপরভাবে একা বাঁচতে চায়!
সব খাদ্য আর প্রয়োজনীয় সামগ্রী একাই মজুদ করতে চায়। করেছেও অনেক জন। কেউ ভাবছে না তার পাশেরজন ভালো না থাকলে সেও সুস্থ থাকতে পারবে না। এই যুদ্ধ মোকাবেলা করতে হবে সবার একসঙ্গে তবে পৃথক থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত।
ঘর থেকে বের হয়ে দেখি শহর জুড়ে নিস্তব্ধতা। যে পথ ছিল লোকে লোকারণ্য সেই পথ এখন জনমানবহীন। বার-রেস্তোরা-শপিংমলের কপাট বন্ধ। এ কোন শহর! যে শহরের রেলে ও গাড়িতে চড়ার জন্য লোকে দীর্ঘ লাইন দেয় সময়ের আগে, এখন কোনো তাড়াহুড়ো নেই, দীর্ঘ সারি নেই, কেবলই বিজন নির্জনতা। এই নীরব শহরে অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকেন দেশের নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত সুসজ্জিত বাহিনী। শহরে অপরাধ থেমে নেই। আরও বেড়েছে এই সংকটে। তাই তাদের দায়িত্বও বেশি এখন।
বন্ধ হয়ে যাওয়া এই সব প্রতিষ্ঠান ও যানবাহন কেন্দ্রিক যারা কাজ করতেন তারা সবাই বেকার। তাদের অর্থনৈতিক প্রণোদনা দিবেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্প। কিন্তু তাদের সময় অতিহাহিত হয় কী করে? মোবাইল ফোনে শত শত নাম্বার সেভ করা থাকলেও বেশির ভাগ মানুষকে কল করা হয় না। খোঁজ নেওয়া হয় না কোন প্রিয়জন কেমন আছে? শুধুমাত্র সময়ের মিল না থাকায় আমরা যোগাযোগের ভিন্ন ও সাশ্রয়ী মাধ্যম থাকার পরেও ছিলাম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এখন সবাই জানে প্রত্যেকে তাদের নিজেদের বাসায় অবস্থান করছে। ফোনের আলাপনে জানা যায় কেউ কেউ অফিস-আদালতের কাজ বাসায় বসেই করছেন।
যারা একেবারেই বেকার তারা নিজের বাসায় থেকে নিজের পরিবারকে সময় দিচ্ছেন। যে সন্তান তার পিতা-মাতাকে কোনো দিন এক সঙ্গে পেতো না তারা আজ সবাই এক সঙ্গে জীবন যাপন করছে। সন্তানদের এমন সুখের সময় যেন কোনো দিন আসেনি এর আগে। স্বামী-স্ত্রী পৃথক সময়ে কাজ থাকায় তাদের মধ্যেও যোগাযোগ ছিল প্রতিবেশীসুলভ। এখন তারা দুজনে মিলে রান্নাসহ ঘরের নানান কাজ করছেন। অনেকটা নতুন সংসার গোছানোর মতো। বৃদ্ধমানুষরা এই সময়ে পাচ্ছেন পরিবারের আর সবার অকৃত্রিম ভালোবাসা ও সেবা। পরিবারের প্রতিটি মানুষ যেন আগের চেয়ে অনেক সুখী।
জাতিসংঘ, বিশ্ব ব্যাংক, ওয়াল স্ট্রিটসহ আরও কতশত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান কার্যত অচল আজ। সব কিছুতেই এক অমোঘ নৈঃশব্দ্য। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিবে। নাগরিকরা স্থায়ীভাবে কাজ হারাবে। এসবের পরেও সমৃদ্ধ দেশ তাদের সাধ্যমতো নাগরিকদের জীবনযাপনের জন্য অর্থসহায়তা দিচ্ছে। সমস্ত কিছু বন্দ হয়ে গেলেও বন্দ হইনি গবেষণাগার, চিকিৎসা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। বিশ্বেও সব মানুষ এমন সব মহৎ প্রতিষ্ঠানের দিকে আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
এজন্যই নানান সংবাদপত্র এবং অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিত্য খোজ রাখছেন কখন কী উদ্ভাবন হলো, আগে টেস্ট করানো যেত ৭ দিনে এখন করা যায় ৪৫ মিনিটে। আরও কমলো নাকি সেই দিন? কোনো ঔষধ-ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে নাকি? পুরাতন কোন ঔষধ নতুন করে করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করছে? আরও কতো করোনা সম্পর্কিত বিনোদন। গণমাধ্যমের কর্মীরাও সব যোগান দিচ্ছে কেউ পত্রিকা কেউ টিভি কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সব লিংক শেয়ার করে। নানান ধাপে মানুষ খোজে এই ভাইরাস থেকে মুক্তির উপায়। এই সময়ে আপনি ঘরে থাকলেই সমস্ত মানুষের পরিশ্রম সফল হবে।
বিশ্বের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে খ্যাত নিউইয়র্ক শহর নাকি ঘুমায় না কোনো দিন, না ঘুমাক, তারও অন্তত কিছুটা বিশ্রাম প্রয়োজন। এই শহর যেন তার নিজের জন্য বিশ্রাম নিয়েছে। কতদিন তার বিশ্রাম প্রয়োজন কেউ জানে না। এই রাজ্য এখন অবরুদ্ধ (লকডডাউন)। নিউইয়র্কের মতো বিশ্বের সব শহর আর রাজ্য বিশ্রাম চায়; যেন পৃথিবী ভীষণ রকম ক্লান্ত। কোনো কোনো শহর পেয়েছে, অনেকেই পায়নি। বুদ্ধিমান জাতি ও দেশে তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত বন্ধ রেখেছে। কই তাতে তো কারো কোনো ক্ষতি হয়নি। চিন্তা করা যায় এই সময় যদি বিজ্ঞানী আর চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিতরা নিজেদের গুটিয়ে নিতেন?
যান্ত্রিকতা থেকে প্রকৃতির দিকে তাকালে দেখা যায় নদীর পানি আগের চেয়ে স্বচ্ছ। বাতাস আরও বিশুদ্ধ। পুরো প্রকৃতি আরও স্নিগ্ধ এবং নির্মল। করোনাভাইরাস আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করলে সে ফুঁসে উঠবেই।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শহর দেখে ঘরে ফিরে দেখি বইয়ের তাকে ধুলোর আস্তরণ। অনেকগুলো বই জমিয়ে রেখেছিলাম অবসর পেলে পড়বো বলে। মাঝেমধ্যে দুই একপাতা পড়লেও পুরো বই পড়ে শেষ করতে পারিনি। অনেক লেখা লিখবো বলে চিন্তা-খাতায় লিখে রেখেছি। লেখা শুরু করতে পারিনি। সময় নেই। আমার মতো অনেকেই শখের অনেক কাজ করবেন বলে তালিকা তৈরি করে রেখেছেন। অবসরে নিজে পছন্দের কিছু গান শোনা, প্রিয় সিনেমা দেখা, নিজের ভালো লাগা খাবার রান্না করা কতো কী! ঘরে থেকে ঘরে থাকার আনন্দ উপভোগ করা। আরও কতো কিছু যে আমরা করতে পারি না শুধু সময়ের অভাবে তা আমরা নিজেরাও জানি না। করোনাভাইরাস আমাদের দিয়েছে অফুরন্ত সময়।
এ যেন অনাহুত অবকাশ। এই অনাহুত অবকাশে কত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেন জন লেনন। প্রকৃতি যেন লেননেরই স্বপ্নের পৃথিবী বিনির্মাণের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে কী নির্মমভাবে আমাদের সামনে হয়েছে হঠাৎ আবির্ভূত। ইংলিশ রক সিঙ্গার জন লেনন ও তাঁর স্ত্রী ইয়োকো অনো মানবতার জন্য ‘ইমাজীন’ শিরোনামের একটি গান লিখেছিলেন ১৯৭১ সালে। জন লেননের গাওয়া সেই গানটি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছিল।
সে গান যা এখনো মানুষকে উদ্দীপ্ত করে বিশ্ব মানবতার জন্য-
মনে করো স্বর্গ নেই/ সহজ হবে যদি আরও চেষ্টা করে ভাবো/ আমাদের অতলে কোন নরকও নেই/ আমাদের আছে শুধু আকাশ/ মনে করো, সব মানুষ বেঁচে আছে আজকের জন্য/ ভাবো, পৃথিবীতে কোনো দেশ নেই/ এই স্বপ্ন দেখা কঠিন নয়/ কোন ধর্মও নয়/ শান্তিতে জীবনযাপনকারী সমস্ত মানুষকে কল্পনা করো/ তুমি বলতে পার যে আমি স্বপ্নবিলাসী/ কিন্তু আমি শুধু একা না/ আশা করছি কোনো একদিন তুমিও আমাদের স্বজন হয়ে একই স্বপ্ন দেখবে/ এবং পৃথিবী হবে সবার জন্য এক হিসাবের/ কোন সম্পদ কল্পনা করো না/ যদি তুমি এমন ভাবতে পারো তবে কোনো লোভের দরকার নেই।
একটি দিনের সমাপ্তি হলে ভাবি গাছ থেকে মাটিতে ঝরে পরা পর্যন্তই যে পাপড়ির জীবন, সেই পাপড়ির কি জিজ্ঞাসা নেই “জীবন এতো ছোট ক্যানে”? তারপরেও সে বাতাসে ভাসতে ভাসতে জীবনকে উপভোগ করে মৃত্যু দিকে এগিয়ে যায় শুধু। আমরাও সদি সব দুঃচিন্তা বাদ দিয়ে লেলনের স্বপ্নের সারথী হয়ে শুধু স্বপ্নের মতো করে অবকাশ যাপন করতে থাকি; তবে কেমন হয়? “বন্ধু এসো আকাশ দেখি পুরোটা চোখ খুলে”।
তোফাজ্জল লিটন, নাট্যকার ও সাংবাদিক, নিউইয়র্ক থেকে