ভূত-পেত্নী দেখিনি তবে তাদের অনেক গল্প শুনেছি
রহমান মৃধা, দূরপরবাস সুইডেন
প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:২৪ এএম
দুপুর গড়াতেই অন্ধকার সুইডেনে, প্রচন্ড ঠান্ডা তারপর বইছে বাতাস। সারাদিন ঘরের পরিবেশে থাকলে রাতে ঘুম ভালো হবে না তাই প্রতিদিন চেষ্টা করি ৪০-৫০ মিনিট বাইরের পরিবেশে হাঁটতে।
এখানকার লোক সংখ্যা কম, তারপর শীতের সময়। রাস্তাঘাটে সব সময় কারো দেখা মেলে না। আজ হগা পার্কের ভেতরে জঙ্গল দিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ দেখি একটি কবর, ১০০ বছর আগে এক অল্প বয়সী নার্সকে কবর দেয়া হয়েছে। জঙ্গলের রাস্তায় আলো নাই, বেশ অন্ধকার।
দ্রুততার সঙ্গে আমি হাঁটছি, হঠাৎ পেছন থেকে মনে হচ্ছে কেও আমাকে ফলো করছে। দিব্যি শুনতে পারছি তার পদধ্বনি। পেছনে তাকিয়ে দেখি কেও না। হাঁটছি, আবারও একই ধরনের শব্দ অবিকল শীতকালীন বিশাল জুতার শব্দ। বেশ ভয় ভয় লাগছে। রাস্তাও শেষ হচ্ছে না।
মনের মধ্যে যতসব ভয় ভিতির চিন্তা ঢুকেছে। কল্পনায় ভূতপেত্নির চেহারাও দেখতে শুরু করেছি। সুইডিস ভূত দেখতে সাদা ধবধবে, পরনে সাদা কাপড়, সবই ঠিক আছে তবে ভূত তো ভূতই। আল্লাহই জানেন কিই না হবে আজ, একেতো অন্ধকার তারপর প্রচন্ড ঠান্ডা!
হুট করে সাইড থেকে একটি আজগুবি শব্দ শুনতে পেলাম। পা আর এখন চলছে না, অবস হয়ে গেছে ভয়ে। আস্তে করে টেলিফোন পকেট থেকে নিয়ে ভাবলাম ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটতে থাকি তাহলে ভয়ও কমবে আবার সময়টিও পার হবে, ওমা টেলিফোন ঠান্ডায় জমে গেছে। ব্যাটারি শেষ, যেদিকেই তাকাই বিদঘুটে শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
নিশ্চিত চারপাশ দিয়ে আমাকে ঘিরে কেও বা কারা চলছে যদিও কিছুই দেখছিনে। ঠান্ডায় শরীর কাঁপতে শুরু করেছে তারপর ঢুকেছে ভয় শব্দের কারনে।
হঠাৎ মাথায় জ্যাকেট হুড তুলতেই শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। কি ব্যাপার এখন কোন শব্দ শুনতে পারছিনা কেন? জঙ্গলের পথ শেষ হতেই আলোর সন্ধান মিললো, আমিও স্বস্থি ফিরে পেলাম। এখন বুজলাম কেন এমন ধরনের শব্দ হচ্ছিল। আমার জ্যাকেটের হুডটি খুবই পাতলা, বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাবার জন্য এই হুড, শীততাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য নয়। যেহেতু প্রচন্ড বাতাসের মধ্য দিয়ে জঙ্গলে হাঁটছি তাই জ্যাকেটের হুড বাতাসের কারণে পেছনে নড়ছিল আর নানা ধরণের শব্দ করছিল যা আমি অ্যাসোসিয়েট করেছি আমার মনের মাঝে।
ছোটবেলায় মুরব্বিরা নানা ধরনের মজার গল্পের সঙ্গে ভয়ের গল্প শুনিয়েছেন। তারপর গ্রামে ঘরে সেই অন্ধকারে গভীর ঘুমে মগ্ন। ঠিক এ সময়ে পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা খটখট শব্দে ঘুম ভেঙে যেতো। পাশের ঘরে কেউ নেই, তাহলে শব্দটা করছে কে? ধীরে ধীরে হিম হয়ে আসতো শরীর। ভাবনায় একটিই চিন্তা, মানুষ ছাড়া এ কাজ আর কে করতে পারে? অশরীরী কিছু?
এই ভয়ে না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিয়েছি সারাটা রাত। সকালে চোখে মুখে না ঘুমানোর ক্লান্তি। একটি রাতই নয়, এভাবে হয়তো নির্ঘুম কেটে গেছে রাতের পর রাত, যার প্রভাব পড়েছে শরীরে ওপর। এই পরিস্থিতি যে একা ঘরে থাকলেই হচ্ছে, তাও নয়। ঘরে অন্য কেউ থাকলেও অনেক সময় এমন ভূতের ভয় কাজ করত তখন।
এ ছাড়া রাতের অন্ধকার আর ঘরের নীরবতা খুব গা ছমছমে একটা পরিবেশের জন্ম দেয়। যে কারণে মনে হয়, সবাই তো ঘুমাচ্ছে, তাহলে শব্দটা আসছে কোথা থেকে? ভূতের ভাবনায় অনেকবারই কুঁকড়ে গেছি ভয়ে। জোর করে চোখ বন্ধ করে থেকেছি, কখন পার হবে বাকি রাত। এ ধরনের আতঙ্ক ছোটবেলায় আমার মনে প্রতিনিয়তই কাজ করেছে।
ছোটবেলার অনেক ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রভাব ফেলে বাকি জীবনে সে ক্ষেত্রে বিষয়টি মনে রাখা দরকার তা হলো ছোটবেলায় বিশেষ করে ৪-১০ বছর সময়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় যা শোনা, জানা বা দেখা হয় তা জীবনে লেগে থাকে লতার মত। ভূত-পেত্নী জীবনে চোখে দেখিনি, তবে তাদের সম্মন্ধে অনেক গল্প শুনেছি। গল্প শুনে কল্পনাতে তাদের আমি ভয় করতে শুরু করেছি এবং মনের মাঝে ধরে রেখেছি।
এ ধরনের ভয় খুব সহজেই অন্যের মধ্যেও ছড়িয়ে যায়। তাই আমাদের এই ভূত-আতঙ্ক বাসার অন্য দুর্বল চিত্তের সদস্যের মধ্যেও সংক্রমিত হতে পারে। এ কারণে ভূতের গল্প ঘুমানোর আগে না শোনাই ভালো। টিভিতে ভৌতিক কোনো সিরিয়াল বা সিনেমা মনে ভয়ের জন্ম দেয়।
ভূতের ভয় থাকলে এ ধরনের কিছু না দেখাই ভালো। কারণ, ভূত বলতে আসলে কিছুই নেই। যে ভয়টা আমাকে সুইডেনের জঙ্গলে তাড়া করছে, তা আর কিছুই নয়, এটা সেই ছোটবেলার গল্পশোনা দুর্বল চিত্তে গড়ে ওঠা একটি ভাবনামাত্র!