প্রশিক্ষণে কারচুপি জাতির সর্বনাশের কারণ
রহমান মৃধা, দূরপরবাস সুইডেন থেকে
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৬:০৩ পিএম
সুইডেনে A থেকে E প্রাইমারি স্কুলের পাশের গ্রেড। A সর্বোচ্চ পাশের হার আর E সর্বনিম্ন। F যারা পায় তারা ফেলের দলে পড়ে। হাইস্কুলে পাশের গ্রেড এমভিজি (MVG), ভিজি (VG) এবং জি(G)। এরা পাশ করার পর নানা জনে নানা জায়গা বেছে নেয়।
হাইস্কুল পাশের পর কেউ উচ্চ শিক্ষা বেঁচে নেয় আবার কেউ বিভিন্ন পেশায় যোগ দেয়। উচ্চশিক্ষা বেছে নেবার মূল্য উদ্দেশ্য পৃথিবীর বা নিজ দেশের বড় বড় জটিল সমস্যার সমাধান করা। অনেকে নতুনত্বের আবির্ভাব ঘটিয়ে নোবেল পুরস্কারের মতো খ্যাতি অর্জন করে।
পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা মানে তাকে নিয়ে বাবা-মা, সমাজ এবং দেশ স্বপ্ন দেখে, কারণ এসব মেধাবীরা দেশ ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করবে। যারা কর্মজীবন বেছে নেয় তারা দেশের সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নে সাহায্য করবে, এটাই সবাই আশা করে।
দেশ গড়ায় সবার সর্বাঙ্গীণ অংশগ্রহণ করা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, সবার দায়িত্ব এবং কর্তব্য। এই নিয়ম হাজারো সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশের মানুষের জন্য আরও বেশি প্রযোজ্য হবার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে বিষয়টি এর সম্পূর্ণ বিপরীত।
এখানে সবাই লেখাপড়া শিখে জিপিএ ৫ গোল্ড পেয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা প্রশাসনের দায়িত্ব নেয়। দেশ তাদের থেকে অনেক কিছু আশা করে, তাদের নিয়ে গর্ব করে। কিন্তু তাদের কর্মজীবনের ফলাফল জিপিএ গোল্ডের মতো গর্বিত করে না বরং তাদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে।
কারণ তারা তাদের নিজেদের জীবনের মান বাড়াতে বালিশের কভারের দাম ১০ টাকা থেকে ৫০০০০ টাকা করে ধনী হতে উঠে পড়ে লাগে। অনেকে বড় চাকরিতে ঢুকে অন্যকে ঠকিয়ে নিজের জীবনের মান উন্নয়নে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে।
নানান রকম দুর্নীতি করে বড়লোক হয়। কারণ তারা তাদের নিজেদের প্রেস্টিজ এবং লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে কুকর্মে উঠেপড়ে লাগে। তারা সব করতে রাজি জীবনে টাকা রোজকার করার জন্য। পিয়াজের মতো জিনিসের দাম ২০ গুণ হয়েছে।
অনেকে হুড় হুড় করে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে যা খুশি তাই করছে। আর যারা কোনো রকম পাশ করে কর্মে রত হয়েছে তারা কেরানি হয়ে কোটি কোটি টাকা মেরে বড়লোক হয়েছে। শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে বর্জন করার কথা দুর্নীতি এবং অর্থনীতি।
কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষার ফলাফল পুরোটাই উল্টো হয়েছে। কী ক্ষতি জাতি করেছে বা কী অন্যায় দেশ করেছে যে এমনটি হলো?
যদি এমন হতো যে শুধু ৩৩ শে (অতীতে ৩৩ ছিল সর্বনিম্ন পাশের হার) পাশ করে যারা তারই শুধু সমাজের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে, তাহলে বলতাম পাশের মান বাড়ানো হোক। সর্বনিম্ন পাশের হার ৩৩ তাই হয়তো অধঃপতনের কারণ।
কিন্তু না তা নয়। বরং যতো ভালো ফলাফল ততো বেশি দুর্নীতি? জিপিএ গোল্ড পেয়ে যদি কেউ বালিশের কভারের দাম ১০ থেকে ৫০০০০ টাকা করতে পারে তবে ৩৩ পেয়ে কেন কোটি টাকার মালিক হতে পারবে না!
জিনিসের দাম বেড়েছে, মানুষের অহংকার বেড়েছে, অথচ চরিত্রের সর্বনিম্ন মান ৩৩-এর নিচেই রয়েছে। মনের মানের মূল্য যে শিক্ষা বাড়াতে ব্যর্থ হয় সে শিক্ষার নাম কুশিক্ষা। বাংলাদেশ শিক্ষায় গর্বহারা হয়েছে।
কারণ শিক্ষায় কারচুপি ঢুকেছে যার ফলে মনুষ্যত্বের অবক্ষয়ের সঙ্গে জাতির মোড়াল ভ্যালুর বিনাশ ঘটেছে। শিক্ষার মান উন্নয়নে মন্ত্রীর পরিবর্তন হয়েছে। সিস্টেমের পরিবর্তন করা হয়েছে।
সরকার চেষ্টা করছে যথাযথভাবে পরিবর্তন আনতে, কিন্তু তেমন ভালো ফল দেখা যাচ্ছে না। কী কারণ থাকতে পারে মোড়াল ভ্যালুর অধঃপতনের পেছনে? বিবেকের অবক্ষয়, নাকি মনুষ্যত্বের অধঃপতন! শুধু আত্মসুখই কি প্রকৃত সুখ? না প্রকৃত সুখ হতে হবে সমষ্টিগতভাবে।
কারণ আমরা মানব জাতি একে অন্যের সঙ্গে আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ। তাই আমাদের সমষ্টিগতভাবে পরস্পরের সান্নিধ্যে জীবনকে সুখময় করে তোলার মধ্যেই আমাদের প্রকৃত সুখ নিহিত।
জীবনের প্রশিক্ষণ শুধু পাঠশালাতে সীমাবদ্ধ নয়, তার শুরু ঘরে, পরিবারে এবং সর্বোপরি নিজের মধ্যে। সচেতন জাতি নিজ থেকে পরিবর্তনের পথ খুঁজে বের করে। আমি আশাবাদী আমরাও সেই পরিবর্তনের পথ খুঁজে বের করব এবং নতুন করে দুর্নীতি মুক্ত বাংলাদেশ গড়ব।
রহমান মৃধা, দূরপরবাস সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com