মানুষ গুজব ছড়ায় বা পরচর্চা করে। বাংলা, ইংরেজি, স্প্যানিশ, সুইডিশ, জার্মান, ফ্রান্সসহ পৃথিবীর সব ভাষায় শব্দ দুটি রয়েছে এবং এর ব্যবহার বেশ হয়ে থাকে।
জার্মান ভাষায় বলে Gerücht, ফ্রান্স ভাষায় rumeur, স্প্যানিশ ভাষায় Rumores এবং সুইডিশ ভাষায় বলে Ryktet। রোগজীবানুর ক্ষেত্রে ভাইরাস বা বাক্টেরিয়া বা ফুলের রেণু যেমন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে ঠিক তেমনি মানুষ জাতিও ভালো মন্দের ঘটনা একের থেকে অন্যের মাঝে ছড়িয়ে থাকে। পৃথিবীর সর্বত্র গুজব প্রথা চালু রয়েছে। আমি থাকি সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের অদুরে বে অফ বাল্টিক সাগরের বেশ কাছে। জানালা দিয়ে বা বালকোনিতে দাঁড়িয়ে সাগরের ভিউ দেখার বেশ সুযোগ ছিল গত বছর অবধি।
বাসাটি কেনার কয়েকটি কারণের মধ্যে সাগরের ভিউটা ছিল একটি। বছর দুই যেতেই খবরে জানতে পারলাম যে, আমাদের প্রোপার্টির সামনে নতুন বিল্ডিং তৈরি করা হবে। বাসা বাড়ি কেনার সময় সিটি প্লানে এমন কোনো প্ল্যান ছিল না। বরং সাগরের সামনে একটি পার্ক হবে এবং সরাসরি সাগরে যাওয়ার জন্য ব্রীজ করা হবে এ সব ছিল তখনকার সিটি প্লানে। অথচ সব প্ল্যান বাতিল করে নতুন প্রজেক্ট? এ মেনে নেয়া যায় না। সকল প্রতিবেশি মিলে লেখালিখি থেকে শুরু করে কমপ্লেইন করলাম। কিছু দিন কোর্ট কাচারিও হলো।
আমরা বড় একটি টাকার ডিমান্ড করলাম আর্থিক ক্ষতিপূরণ হিসাবে। সরকার পক্ষ হিসাব করে দেখলো অনেক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বিধায় সিদ্ধান্তে আসলো সিটি ম্যাপ নতুন করে আপডেট না হওয়া পর্যন্ত নতুন কিছু করবে না। স্বস্তি পেলাম কিছুটা। এদিকে অনেকেই জায়গা এবং বসতবাড়ি বিক্রি করে চলে যেতে শুরু করল শুধু আমি ছাড়া। যারা বিক্রি করে চলে গেছে তাদের ধারণা আমি ভালো অংকের একটি টাকা পেয়েছি সরকার থেকে, যার কারণে এখনও একই জায়গায় বসবাস করছি।
মনে রাখতে হবে কিছু ঘটলেই কিছু রটে। যা ঘটেনি ঘটতে পারত বা যা ঘটার কথা তার থেকে যখন রটার মাত্রা বেশি হয়, তখন গুজব বিশাল আকারে প্রভাব বিস্তার করে। ইউরোপে বেশির ভাগ সময় প্রতিবেশিকে নিয়ে বা টিন এজের প্রেমের ওপর বেশ গুজব রটে। কে কার সঙ্গে প্রেম করল, কার সঙ্গে কার ডিভোর্স হলো, প্রতিবেশি নতুন গাড়ি কিনলো এসব নিয়ে গুজব রটে। আবার কিছু খবরের কাগজ গুজব রটাতে পছন্দ করে। অনেকে এ সব কাগজ পড়ে কারণ তারা গুজব জানতে চায়। তবে একটি সচেতন দেশের নাগরিক সবসময় তার নিজের দেশের কথা ভাবে। বৃহত্তর স্বার্থে কখনও এমন কিছু করে না যা তার মাতৃভূমির সম্মানের হানি করতে পারে। জোকস, হাসি-তামাশা থাকা ভালো তবে তারও সীমা থাকা উচিত। জাতি হিসাবে আমাদের একটা পুরানো ঐতিহ্য আছে। বলা যেতে পারে এটা আমাদের অর্জনও বটে। হুজুগে বাঙালি শব্দটার সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা গুজবকে বেশ যত্নের সঙ্গে লালন পালন করে রেখে গেছেন তাই আমরা দিব্যি তার চর্চা করছি। জনসাধারণ সম্পর্কিত যে কোন বিষয় বা ঘটনা নিয়ে মুখে মুখে প্রচারিত গল্প দেশে এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ গুজবের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিছুদিন আগে ঘটেছিল পদ্মাব্রীজ তৈরি করতে মাথা লাগবে। শুরু হলো ছেলে-মেয়ে ধরা। দিতে হলো কতগুলো লোকের জীবন দিবালোকে। বেচারি মা স্কুলে গিয়েছিলেন মেয়েটাকে ভর্তি করবে বলে, জীবন দিতে হয়েছিল। এমন হাজারও ঘটনা আমরা জেনেছি যা সত্য আবার অনেক ঘটনা যা আদোও ঘটেনি তবে রটেছে। যেমন বুয়েটের শিক্ষার্থীকে হত্যাকরা হয়েছে যে সে শিবির করে। তদন্তে প্রমানিত হয়েছে এ গুজব এবং আদোও সত্য নয়। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সরকারের নামেও চলছে গুজব। সরকার এদিকে তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা সত্বেও বিরোধী দল কি করেছে বা না করেছে তার ওপর রটাচ্ছে গুজব। সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢাকা বা সত্যের মধ্যে মিথ্যা ঢুকানো অথবা মানুষকে বিভ্রান্ত করাও গুজব।
দুঃখের বিষয় গুজব শব্দটার ব্যবহার শুধু খারাপ কাজেই হয়ে থাকে। যেমন পরনিন্দা বা পরচর্চা করা গুজবের একটি অংশ। যে ঘটনাগুলো ভালো বা যা জানালে বা শোনালে অন্যে অনুপ্রানিত হয় তেমন ধরনের ঘটনা সমাজে ছড়ানো গুজব নয়। যেমন যদি আমি বলি স্বপ্নে দেখি যে সোনার বাংলার নতুন প্রজন্ম ফুটবলে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবে, সুশিক্ষার বাংলাদেশ দেখতে চাই, সততায় বিশ্বসেরা হতে চাই ইত্যাদি। এ ধরণের কাল্পনিক চিন্তা ধারা বা আবেগের প্রবনতাকে রটানো গুজব নয়। প্রতিটি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ে আদর্শ এবং নৈতিকতার ওপর প্রশিক্ষণ চালু করা উচিত। মন্দিরে মসজিদে দুর্নীতি, পরনিন্দা এবং পরচর্চা বন্ধ করা দরকার।
যে কোনো শিক্ষা ও সামাজিক অনুষ্ঠানে কথা বলার সুযোগ পেলেই সবাই বদনাম তুলে ধরতে পাকা। এসব বন্ধ করে বরং মোরাল ভ্যালুর ওপর কথা বলার প্রাক্টিস করা হোক। সৃজনশীল সমাজে সারাক্ষণ মিথ্যা গুজব নয় সত্যের বাণী ছড়িয়ে দিতে শেখা উচিত। জাতির সুশিক্ষার এক প্রতিশ্রুতি হোক সত্যকে তুলে ধরার এবং যা আমাদের জীবনকে সুন্দর করতে সাহায্য করে তার চর্চা করা।