সংশোধনে দরকার পরিবর্তন এবং নতুনত্বের মোকাবেলা করা
রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে
প্রকাশ: ২২ মে ২০১৯, ০২:০০ এএম
কীট পতঙ্গ বা পশুপক্ষী এদের সঙ্গে মানুষের চেহারার মিল নেই তবে কর্মের মিল আছে নানাভাবে। যেমন প্রত্যেকটি মৌচাকে মৌমাছিরা একত্রিত হয়ে একটি বড় পরিবার বা সমাজ গড়ে বাস করে। আকার ও কাজের ভিত্তিতে মৌমাছিরা তিন সম্প্রদায়ে বিভক্ত: রাণী মৌমাছি যা একমাত্র উর্বর মৌমাছি, পুরুষ মৌমাছি এবং কর্মী মৌমাছি বা বন্ধ্যা মৌমাছি।
ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ানোর সময় মৌমাছিরা তাদের পা এবং বুকের লোমে ফুলের অসংখ্য পরাগরেণু বয়ে বেড়ায়। এক ফুলের পরাগরেণু অন্য ফুলের গর্ভমুণ্ডে প্রবেশ করলে পরাগায়ণ ঘটে, যার ফলশ্রুতিতে উৎপন্ন হয় ফল। এভাবে মৌমাছিরা পরাগায়ণের মাধ্যমে ফল ও ফসলের উৎপাদন বাড়ায়। বাবুই পাখি খুব সুন্দর বাসা বুনে বলে এরা তাঁতি পাখি (Weaver Bird) নামেও পরিচিত।
এদের বাসার গঠন বেশ জটিল আর আকৃতি খুব সুন্দর। কয়েক প্রজাতির বাবুই একাধিক কক্ষবিশিষ্ট বাসা তৈরি করতে পারে। এরা মূলত বীজভোজী পাখি, সে জন্য তাদের ঠোঁটের আকৃতি বীজ ভক্ষণের উপযোগী। অধিকাংশ বাবুই প্রজাতির আবাস কিন্তু আফ্রিকায় তবে এশিয়ার অনেক দেশে এদেরকে দেখা যায় যেমন বাংলাদেশে আমরা এদেরকে স্থায়ীভাবে দেখে থাকি। পিঁপড়া হলো কীট বা পোকা, এদের ঘনিষ্ঠ প্রজাতি মৌমাছির মত একই বর্গের অন্তর্গত।
পিঁপড়ার বড় দলগুলি প্রধানত অনুর্বর নারী পিঁপড়াদের সমন্বয়ে তৈরি হয় যারা কর্মী, সৈন্য এবং অন্যান্য বিশেষায়িত বাহিনীতে বিভক্ত থাকে। প্রায় সব পিঁপড়ার উপনিবেশেই কিছু প্রজননক্ষম পুরুষ পিঁপড়া এবং এক বা একাধিক উর্বর নারী পিঁপড়া থাকে, যাদের রাণী পিঁপড়া বলা হয়। পিঁপড়াদের এ উপনিবেশকে কখনো কখনো সুপার-অর্গানিজম বা দলগতস্বত্তাও বলা হয়, কারণ এরা সবাই মিলে কেবল একটি প্রাণীর মত আচরণ করে এবং অস্তিত্ব রক্ষায় ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করে। তাদের এ সাফল্যের কারণ হলো তাদের সামাজিক সংগঠন, দ্রুত বাসস্থান পরিবর্তনের ক্ষমতা, রসদ জোগাড় করার দক্ষতা এবং নিজেদের রক্ষা করার পারদর্শিতা। পিঁপড়া সমাজে শ্রমবিভাগ, ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগ এবং জটিল সমস্যা সমাধানের দক্ষতা রয়েছে। আমরা মানুষ জাতি আমাদের চরিত্রের ওপর সবধরণের গুনাগুন রয়েছে।
পার্থক্য এখানেই মানুষ পরিবর্তনে অগ্রগতিশীল। তাই তারা একই কাজ বার বার করতে পছন্দ করে না অন্যান্ন পশুপক্ষির মতো। যেমন বাবুই পাখির কাজ খাবার যোগাড়, বাসা তৈরি এবং জন্মনিয়ন্ত্রন করা। যুগ যুগ ধরে পুরনো এবং নতুন প্রথা অনুযায়ী একই কাজ করে আসছে বিধায় তাদের কারুকার্জ আমাদের চোখে সুন্দর দেখায়। আমরা মানুষ জাতি সারাক্ষণ নতুনত্বের খোঁজে সীমারেখার বাইরে জানা অজানার সন্ধানে ব্যস্ত।
ভুলের মাঝে শেখা, দেখে শেখা, নকল করা, সহজ উপায়ে কঠিন কাজের সমাধান করা এসব আমাদের চরিত্রগত গুনাবলী। এখানে পশুপক্ষীর জীবনকে টেনে এনেছি কারণ তাদের কর্মের ধরণ, সঙ্গবদ্ধতা এবং একাত্বতা থেকে শিক্ষনীয় কিছু রয়েছে তাই। বর্তমান বিশ্বে আমরা নতুন প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে শুরু করেছি। যার কারণে প্রযুক্তির ব্যবহার সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে। পুরনো প্রথাকে আর ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না কারণ চাহিদা আগের মত আর নেই। শিক্ষা প্রশিক্ষণের সবচেয়ে জরুরি যে প্রশিক্ষণ তা হলো প্রযুক্তির ব্যবহার করতে শেখা এবং জানা তার রক্ষণাবেক্ষণ কৌশল। বর্তমান চিকিৎসায় যে সমস্থ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে নানা কাজে তা যদি ১০০% সঠিক না হয় তবে শুধু ক্ষতি নয় জীবননাশেরও ঝুঁকি রয়েছে। সে ক্ষেত্রে দরকার প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর দক্ষ প্রশিক্ষণের। আজ খবরে দেখলাম সুইডেনের একটি নামকরা হাসপাতালের উপকরণের (equipment ) ত্রুটির কারণে সন্তান প্রসবের সময় শিশুর মস্তিস্কে ঝুকিপুর্ণ সমস্যার সৃষ্টি হয়। খবরটি দেখার পরই আমার ভাবনায় ঢুকেছে প্রযুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে প্রযুক্তির রক্ষণাবেক্ষণের গুরুত্ব এবং কিভাবে সে শিক্ষা পাওয়া যেতে পারে! যেহেতু মানবজাতি পরিবর্তন এবং চ্যালেঞ্জে বিশ্বাসী তাই তারা সারাক্ষণ নতুনত্বের সন্ধানে। আর তাই প্রতিনিয়ত ঘটছে নতুনের আবির্ভাব যেমন বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং। বাংলাদেশে বিষয়টি নতুন হলেও উন্নত বিশ্বে এর কয়েক দশক পার হয়ে গেছে। বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং কি এবং এদের কাজ কি? বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং হলো একটি সাবজেক্ট যা মেডিক্যাল সাইন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং এর মধ্যে যে বিস্তর ফারাক তা দূর করার একটি মাধ্যম। বিশেষ করে বর্তমান প্রযুক্তির যুগে ডাক্তারদের সঙ্গে বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারদের ইন্টিগ্রেশন এবং কলাবরেশনের দরকার পড়েছে আরও বেশি। তাই বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারদের ছাড়া চিকিৎসা ব্যবস্থার ১০০% নিরাপত্বা দেয়া সম্ভব নয়।
যত ভালো খাবার টেবিলে দেয়া হোক না কেন যদি থালা, বাটি এবং ঘটি পরিষ্কার না থাকে, যদি সেখানে হাইজেনিকের অভাব থাকে কি হবে? বিষয়টি বুঝতে কঠিন হবার কথা নয়। অনেকের ধারণা যে বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারদের কাজ হলো শুধু চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত যন্ত্রের ব্যবহার ও তার রক্ষণাবেক্ষণ করা। কিন্তু সত্যিকারে এটি একটি বিস্তৃত শাখা যেমন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে হিউম্যান রোবটিক্স, ন্যানো টেকনোলজি, সবই বায়োমেডিকেলের অন্তর্ভুক্ত।
মানবদেহের সম্পর্কে জানা এবং একই সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং এর ওপর দক্ষতা অর্জন করা বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং এর বিকল্প নেই।বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারদের মূল লক্ষ্য হলো চিকিৎসা বিজ্ঞানকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। যে যন্ত্র-সরঞ্জাম গুলো দরকার তার আরও উন্নতি করা এবং নতুন নতুন উপকরণ তৈরি করা, যেমন কৃত্রিম হৃদপিণ্ড, পেসমেকার, কৃত্রিম বৃক্ক, কৃত্রিম লেন্স, নিউরো হ্যান্ড আবিষ্কারসহ যেকোন ইন্সুলিন কিভাবে আরও উন্নত করা যায়। বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং চিকিৎসাক্ষেত্রে হাজারও সমস্যা সমাধানের এক নতুন উপায়। সহজ করে বলতে গেলে ডাক্তারের হাতে থাকা ইনজেকশন বা গলায় থাকা স্টেথোস্কোপও বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারের অবদান। আমি এর আগে আমার একটি লেখায় বাংলাদেশে বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারের কথা লিখেছি।
বাংলাদেশে বিষয়টি নতুন হওয়ায় এর ওপর চাকুরীর বাজার এখনও অন্যান্য সাবজেক্টের মতো অতটা বেশি না। বিশ্বের অনেক ভালো ভালো হাসপাতালে এখন অনেক ভালো বেতনে বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বের হাসপাতালে নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগ করার কারনে বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। সেক্ষেত্রে যথাযথ যোগ্যতা থাকলেই ইউরোপ, আমেরিকা বা অন্যান্য দেশে চাকরির ভালো সুযোগ রয়েছে। এই সাবজেক্টের ওপর গবেষণা করারও যথেষ্ঠ সুযোগ হয়েছে বিধায় সবচেয়ে বেশি স্কলারশিপ এখন এই ফিল্ডেই দেয়া হচ্ছে। অনেক মেডিকেল ইকুইপমেন্ট রয়েছে যেগুলো আরও আপগ্রেড করা একজন বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারেরই কাজ। শেষ কথা, বাংলাদেশে এর দরকার সবচেয়ে বেশি যদি তুলনা করা হয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে। তাই আগ্রহ এবং শেখার মনোভাবের সঙ্গে যদি ভালোবাসার সমন্বয় ঘটে তবে আটকে রাখতে পারবে না কেও, সাফল্য অবশ্যম্ভাবী। তাই শুভকামনা করি ভবিষ্যতে সকল বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের।