
ছোটবেলার ফাগুনে আগুনরাঙা বসন্ত
নিজদেশে পরাধীন অথচ পরের দেশে স্বাধীন শুনেছেন এমন কাহিনী? না। তাহলে আসুন শুনি। আমি সুইডেনে পড়াশোনা করেছি। পরে চাকরি এবং স্থায়ীভাবে বসবাস। এখানে চাকরি করা মানে ট্যাক্স-পে করা আর সমস্ত নাগরিক অধিকার ভোগ করা। অন্য কথায় দেয়া এবং নেয়া।
যারা জন্মসূত্রে সুইডেনের নাগরিক তারা আমার তুলনায় বেশি নিয়েছে যদি আমাকে তাদের সঙ্গে তুলনা করি। যেমন আমার বয়সী যারা তাদের জন্মের শুরুতে নার্সারি থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে সরকারি সমস্ত সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছে।
এর ফলশ্রুতিতে তারা তাদের জীবনকে নানা ধরণের সুযোগ সুবিধার মধ্যদিয়ে সুন্দর করে গড়তে পেরেছে। তারা এখন কাজ করছে এবং ট্যাক্স-পে করছে। আমি এসেছি সুইডেনে বিশ বছর বয়সে। বাংলাদেশে নার্সারি, স্কুল এবং কলেজ অধ্যায়ন শেষ করেছি।
আমাদের সময় প্রাইমারিতে পড়তে বই পুস্তক নিজেদেরই কিনতে হতো। স্কুল এবং কলেজে ফি দেয়া থেকে শুরু করে বাবা-মার অর্থে পড়াশোনা করতে হয়েছে। যে অর্থনৈতিক ঋণ তা বাবা-মার কাছে রয়েছে বাংলাদেশে। সুইডেন বিনা খরচে বা জিরো ইনভেস্টে আমাকে বলতে গেলে ডে ওয়ান থেকে এজ এ ফিনিস প্রোডাক্ট হিসাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে।
তাই আমি নিজেকে কাইন্ড অব প্রাউড ফিল করি। কারণ আমার কনট্রিবিউশন সুইডিশদের চেয়ে ভালো বিধায় নিঃসন্দেহে প্রাউড ফিল করতেই পারি। বাংলাদেশে বসবাসরত যারা তারাও নিশ্চয়ই ট্যাক্স-পে করে থাকেন। জানি না বেতনের বা টোটাল ইনকামের কত পারসেন্ট ট্যাক্স বাংলাদেশে পে করতে হয়।
তবে সুইডেনে আয়ের একটি বড় অংশ ট্যাক্স পে করতে হয় এবং কোন রকম ফাঁকি ঝুকির বালাই নেই। আমি কোন এক সময় সর্বোচ্চ ৭০% ট্যাক্স পে করেছি। এখন আমার আয় কম আগের তুলনায় তবুও ৪০% ট্যাক্স পে করতে হয়।
প্রসঙ্গত, সুইডেন বিশ্বের শীর্ষে রয়েছে ট্যাক্স আদায়ের দিক দিয়ে। তবে এখন ম্যাকসিমাম ট্যাক্স ৬০%। ১৯৯০-৯১ সালে সুইডিস স্যোশাল ডেমোক্রাট পার্টি এই ট্যাক্সের পরিবর্তন করে। ট্যাক্স কোথায় কীভাবে খরচ করা হবে তা সিদ্ধান্ত নেয় সুইডিস পার্লামেন্ট।
গণতন্ত্রের বেস্ট প্রাকটিস সুইডেনে হবার বড় কারণ এখানেই যে আমি ট্যাক্স পে করছি বিধায় আমার গুরুত্ব অন্য সবার মত। আমার ভোট কেউ জোর করে বা চুরি করে দিতে পারবে না। আবার দুর্নীতি করার উপায় নেই কারণ সব কিছু মনিটরিং করার ব্যবস্থা রয়েছে।
যেমন জন্ম তারিখের সঙ্গে চারটি এক্সট্রা সংখ্যা যোগ করা হয় এবং সে সংখ্যা এমন ভাবে সেট করা যে কে পুরুষ বা মহিলা তাও চেনার উপায় রয়েছে। আমার জন্ম তারিখের শেষে যেমন রয়েছে- ৩০৯১ এই চারটি সংখ্যা যোগ করলে যদি বেজোড় হয় তাহলে আমি পুরুষ। আবার যেমন ০১৮৫ একই ভাবে চারটি সংখ্যা যোগ করলে যদি জোড় হয় তবে সে মহিলা।
আবার আমার বেতন ব্যাংক একাউন্টে আসছে, হিসেব করে দিয়েছে সেখানে ট্যাক্সের আগে কত এবং ট্যাক্স দেবার পরে কত পেলাম। বছরের শেষে টোটাল হিসেব করে যদি দেখা যায় ট্যাক্স কম বা বেশি দিয়েছি তখন তা অ্যাডজাস্ট করা হয়।
সব ধর্মে যেমন ভয় দেখানো হয়েছে অন্যায় করলে কী হবে। ভালো কাজ করলে কি হবে? পৃথিবীর প্রতিটি দেশেও ঠিক একই ভাবে নানা ধরণের নিয়ম কানুন করা হয়েছে। চোর যেমন চুরি করে নানা উপায়ে, পুলিশ ঠিক তেমন করে ধরার চেষ্টা করে নানা উপায়ে, চলছে এই প্রথা সারা বিশ্বে।
তার পর ডিজিটাল যুগে নতুন পদ্ধতির কারণে সুইডেন দুর্নীতি বা নীতিতে বেশ পিছে পড়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করলে। বাংলাদেশ বর্তমানে দুর্নীতিতে বিশ্বের প্রথম সারিতে রয়েছ। কনগ্রাচুলেশন। সামান্য পিয়নের বা কেরানীর চাকরি করে যদি টোটাল ইনকাম হাজার কোটি টাকা হয়, তবে বলতে হবে What a grate success! What a great achievement!
এদের থেকে অবশ্যই যথেষ্ট শিক্ষণীয় রয়েছে। তা হলো সামান্য ছোট কাজ করেও কোটি কোটি লোকের চোখ ফাঁকি দিয়ে যদি হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়া যায় তবে স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার কি দরকার।
বছরের পর বছর অর্থের অপচয় করে শিক্ষা নেবার পরও অনেকেই নিজের ভরণ পোষন করতে পারছে না। তাই আবারও বলতে হয় কি শিক্ষা? কীভাবে শিক্ষা? কেন শিক্ষা? এ বিষয়গুলো নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবার সময় এখন।
ভালো শিক্ষা পেতে হলে এবং দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করতে হলে শুধু সুশিক্ষা নয় দরকার সিস্টেমের পরিবর্তন করা এবং সুশিক্ষার সমন্বয় ঘটানো। সিস্টেমকে ডিজিটালাইজেশন করে পরিবর্তন আনতে হবে বাংলাদেশে।
মহাশূন্যে হাজার কোটি টাকার স্যাটেলাইট হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছে, এদিকে সেই দেশের কিছু জনগণও হাজার কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আর কতদিন চলবে এভাবে? খারাপ কাজ করতে যেমন প্রাকটিস করতে হয়। ভালোকাজ করতেও তো প্রাকটিসের দরকার।
এখন প্রশ্ন সব জায়গায় তো শিক্ষা দেয়া হয় ভালো কাজ কর, ভালো কথা বল, ভালো ভাবে চল। অথচ দিনের পর দিন খারাপের দিকটা সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে বেশি। কী কারণ রয়েছে এই রহস্যের পিছনে? দুর্নীতি সামনের দিকে এগিয়ে চলছে কোন স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণ ছাড়া।
অথচ সুস্থ প্রশিক্ষণের পেছনে লাখ লাখ কোটি টাকা খরচ করা সত্বেও আশানুযায়ী ফল পাওয়া যাচ্ছে না। কী জাদু রয়েছে এই কু-শিক্ষার পিছনে? বা কী প্রশিক্ষণ কাজ করছে এত বড় notorious success এর পিছনে! বাংলাদেশ সত্যি ভাগ্যবান। কারণ বিনামূল্যে বাংলাদেশ নতুন প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে অল্প সময়ের মধ্যে সকল সমস্যার সমাধান করতে পারে।
আমার জীবনের ত্রিশ বছরের বেশি সময় কেটেছে ফার্মাসিউটিক্যালস এবং এলিট স্পোর্টসের ওপর। একজন ইন্ডাস্ট্রি প্রভাইডার হিসেবে আমার জীবনের চ্যালেঞ্জ ছিল সমস্যা কী এবং তা খুঁজে বের করা। যখনই সমস্যা সনাক্ত করা হয়েছে তখন সমস্যা নয় কীভাবে সমাধাণ করতে হবে সেটাই ছিল লক্ষ্য।
বাংলাদেশের সমস্যা সবাই দেখছে, শুনছে, তারপরও কেউ এর সমাধান করতে ইচ্ছুক নয়। এর কারণ কী হতে পারে? কোথায় বলে, লোকাল কনসার্ন গ্লোবাল সলিউশনস। আমার বিশ্বাস কিছু স্থানীয় সমস্যার সমাধান করলেই পুরো দেশের পরিবর্তন হবে।
দেশের এডমিনিস্ট্রেশনে বড় ধরনের গড়মিলের কারণ হতে পারে সমাধাণ না করার কারণ। বিশ্ব দেখছে আমরা কী করছি, আমরা জানি আমাদের কী করণীয়। প্রশ্ন আর কত দিন দেরি করতে হবে সমস্যা সমাধানের?
আজ পহেলা বসন্ত। বসন্তের ফুলের বাহারে আসলে কত না গন্ধ সেই ছোটবেলায়। সেই বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ এখন আর আসে না এই দূরপরবাসে। তবে স্মৃতির জানালা খুলে আজও প্রাণ ভরে অনুভব করি সেই ছোটবেলার দিনগুলোর কথা, পরাধীন বাংলাদেশের কথা।
প্রাইমারী স্কুলের প্রশ্ন ফাঁস বা পিয়নের আয় হাজার কোটি টাকা এসব গল্প শুনিনি তখন। আমাদের স্বপ্নে আমাদের জাগরণে তখন একটি আকাঙ্খা ছিল তা হলো- স্বাধীনতার চেতনা আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণা। আজ আমরা স্বাধীন হয়েছি। বুক ভরা আশা আর প্রাণ ভরা ভালোবাসার সঙ্গে ফিরে যেতে চাই জাতির পিতার স্বপ্নে, আজকের ফাগুনে আগুনরাঙা বসন্তে।
রহমান মৃধা, দূরপরবাস সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com