ফিলিস্তিনের মহান মুক্তি সংগ্রামী নেতা ইয়াসির আরাফাতের জন্মদিন আজ
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০১৯, ১০:৪৫ এএম
ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের অবিসংবাদিত মহান নেতা ইয়াসির আরাফাত
ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের অবিসংবাদিত মহান নেতা ইয়াসির আরাফাতের ৯০তম জন্মদিন আজ।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই ইয়াসির আরাফাত বাংলাদেশের জনগণের মহান বন্ধুর মর্যাদায় অভিসিক্ত হয়ে আসছেন।
ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে পরিচিত এই মহান ফিলিস্তিনি নেতা ১৯২৯ সালের ২৪ আগস্ট মিসরের কায়রোতে জন্মগ্রহণ করেন।
অবৈধ রাষ্ট্র ইহুদিবাদী ইসরাইলের দখলদারি থেকে মাতৃভূমি ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে আমৃত্যু স্বাধীনতা সংগ্রামরত ছিলেন ইয়াসির আরাফাত।
ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে তাকে হত্যার জন্য একের পর চেষ্টা করে ইসরাইলি গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদ।
অবশেষে ২০০৪ সালে দিনের পর দিন অবরুদ্ধ করে রেখে তাকে সায়ানাইডের চেয়েও ১০ লাখ গুণ বেশি ভয়ঙ্কর বিষ পলোনিয়াম ২১০ প্রয়োগ করে মোসাদ। অবশেষে প্যারিসে চিকিৎসাধীন ২০০৪ সালের ১১ নভেম্বর তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
আরাফাতের পুরো নাম মুহাম্মদ আবদেল রহমান আবদেল রউফ আরাফাত আল-কুদওয়া আল-হুসাইনি। কৈশোরে তিনি ইয়াসির নামে পরিচিত ছিলেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে সমর্থকরা আবু আম্মার নামে সম্বোধন করতে থাকেন।
আরাফাত ছিলেন একটি ফিলিস্তিনি সুন্নি মুসলিম পরিবারের সন্তান। তার বাবা আবদেল রউফ আল-কুদওয়া আল-হুসাইনি গাজার এবং মা জোয়া আবুল সাউদ জেরুজালেমের অধিবাসী ছিলেন। মাত্র চার বছর বয়সে মাকে হারান আরাফাত।
আরাফাত ১৯৪৪ সালে কায়রোর ইউনিভার্সিটি অব কিং ফুয়াদ ওয়ানে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন। এ সময় ইহুদিবাদীদের রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি সম্বন্ধে অবহিত হন।
এর পর ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে অস্ত্র সংগ্রহ শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে মুসলিম ব্রাদারহুডের হয়ে গাজায় যুদ্ধে অংশ নেন।
পরে ১৯৪৯ সালে কায়রো ফিরে গিয়ে তিনি ফের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনায় যোগ দেন। ১৯৫২-৫৬ সাল পর্যন্ত তিনি ফিলিস্তিনি ছাত্র সংগঠন জেনারেল ইউনিয়ন অব প্যালেস্টাইনিয়ান স্টুডেন্টসের (জিইউপিএস) প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
পরে কায়রোতে অবস্থান করে মিসরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। একপর্যায়ে মুসলিম ব্রাদারহুডের আবু খলিল আল ওয়াজির বা আবু জিহাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন।
পড়াশোনা শেষে আরাফাত কুয়েতে শিক্ষকতা করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। ওই সময় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য তিনি একটি প্যারামিলিটারি দল গড়ে তুলতে আরব দেশগুলোর কাছে সহযোগিতা চান। তবে আরব শাসকরা তাকে বিমুখ করেন। অবশ্য এ সময় আরবের কিছু ব্যবসায়ী তাকে সাহায্য করেন।
আরাফাত ১৯৫৯ সালে জাতীয়তাবাদী দল ফাতাহ প্রতিষ্ঠা করেন। এর পাঁচ বছর পর ১৯৬৪ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সব সশস্ত্র দলগুলোকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসতে সক্ষম হন আরাফাত। সর্বদলীয় জোট হিসেবে গঠন করেন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)। ১৯৬৯ সালে তিনি পিএলওর নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
ফাতাহ দল মূলত জর্ডানে ঘাঁটি স্থাপন করে ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনা করত। কিন্তু ১৯৬০ ও '৭০-এর দশকে জর্ডানের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন ইয়াসির।
ফলে জর্ডানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক বাহিনীর নির্মম দমন-পীড়নের শিকার হন ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামীরা। একপর্যায়ে আরাফাতসহ ফাতাহ দলের যোদ্ধারা জর্ডান থেকে বিতাড়িত হয়ে লেবাননে অবস্থান নেন।
ফিলিস্তিনের নেতা হিসেবে ইয়াসির আরাফাত ১৯৭৪ সালের ১৩ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দেন।
এদিকে লেবাননে অবস্থানকালে ফাতাহ দলের যোদ্ধারা ১৯৭৮ ও ১৯৮২ সালে ইসরাইলি আগ্রাসনের শিকার হতে থাকেন।
এ অবস্থায় ১৯৮৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণদানকালে নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত ২৪২ মেনে নেয়ার ঘোষণা দেন।
এর মধ্য দিয়ে আরাফাত সশস্ত্র অভিযান থেকে সরে এসে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পাশে দখলদার অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দিতে সম্মত হন।
এর পরের বছরগুলোতে মার্কিন উদ্যোগে সায় দিয়ে ইসরাইলের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে সম্মত হন আরাফাত।
এর অংশ হিসেবে ১৯৯১ সালে মাদ্রিদ সম্মেলনে যোগ দেন ইয়াসির আরাফাত। দুই বছর পর ১৯৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে পিএলওর সঙ্গে ইসরাইলের অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
১৯৯৪ সালের ১ জুলাই আরাফাত তার রণাঙ্গন গাজায় ২৭ বছর পর পা রাখেন। এর চার দিন পর ৫ জুলাই ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রধান পদে আসীন হন। এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
ফিলিস্তিন-ইসরাইল শান্তি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে অসলো চুক্তি করায় ১৯৯৪ সালের ১৪ অক্টোবর ইয়াসির আরাফাতকে ইসরাইলি নেতা আইজাক রবিন ও শিমন পেরেজের সঙ্গে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়।
তবে দখলদার অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ায় ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামীদের একটি বড় অংশই ফাতাহ ও ইয়াসির আরাফাতের বিরুদ্ধে চলে যায়।
এর মধ্যেই ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা হিসেবে হামাসসহ বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠনের উত্থান ঘটে।
১৯৯৬ সালের ২০ জানুয়ারি ফিলিস্তিনের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে জয়ী হয়ে আরাফাত ফিলিস্তিনের প্রথম প্রেসিডেন্ট হন। এর পর স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য আরাফাত মরিয়া চেষ্টা করেন। যার অংশ হিসেবে ২০০০ সালের ক্যাম্প ডেভিড সম্মেলনে যোগ দেন তিনি।
কিন্তু মার্কিন শান্তি উদ্যোগে আরাফাত বারবার বড় ধরনের ছাড় দিলেও দখলদার ইসরাইল কোনো চুক্তিই বাস্তবায়ন করেনি। তারা ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।
বরং ২০০২ সালে ইসরাইল তার সব নিষ্ঠুরতা নিয়ে আরাফাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইসরাইলি সেনাবাহিনী টানা দুই বছর আরাফাতকে রামাল্লার দফতরে গৃহবন্দি করে রাখে।
সেখানে আরাফাতের দফতরের বিদ্যুৎ-পানি ও গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। তার চিকিৎসা কার্যক্রম পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
সর্বশেষ ২০০৪ সালের ১২ অক্টোবরে ইয়াসির আরাফাতকে মুমূর্ষু অবস্থায় ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের একটি সামরিক হাসপাতালে নেয়া হয়। কিন্তু সেখানে তার অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে এবং কোমায় চলে যান। পরে ১১ নভেম্বর চিকিৎসাধীন ইন্তেকাল করেন।
ইয়াসির আরাফাত স্ত্রী সুহা তাউয়িল আরাফাত ও একমাত্র কন্যা জাহওয়া আরাফাতকে রেখে গেছেন। জাহওয়া বর্তমানে প্যারিসের বাসিন্দা।
বাংলাদেশের মহান বন্ধু আরাফাত ১৯৭৪ সালে লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে আরাফাতকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্ভাষণ জানান।
পরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পরম বন্ধুর মর্যাদায় আরাফাতের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখেন।
এ ছাড়া '৯১ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা নিজ নিজ সরকারের মেয়াদে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ইয়াসির আরাফাতের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখেন।
অবৈধ দখলদারিত্বে অবসান ঘটিয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা অর্জনকে সমর্থন করা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির স্থায়ী নীতি। এর অংশ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়নি বাংলাদেশ।
জীবদ্দশায় ইয়াসির আরাফাত অনেকবার রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় আসেন। এ ছাড়া ফিলিস্তিনের জন্য সমর্থন আদায়ে বিশ্ব ভ্রমণকালে অসংখ্যবার ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২৫ বছরপূর্তি উপলক্ষে ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ আমন্ত্রণে ইয়াসির আরাফাত ঢাকায় আসেন।
ওই অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বর্ণবাদবিরোধী বিশ্বনন্দিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট সুলেমান ডেমিরিল।