
ছবি: সংগৃহীত
দেশীয় নাটকে সিন্ডিকেটের কথা এখন পুরোনো টপিক। প্রতিষ্ঠিত অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে গুটিকতক শিল্পী রয়েছেন যারা তাদের সার্কেলের বাইরে কারও সঙ্গে অভিনয় করতে চান না। এরমধ্যে যেমন নায়ক রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন নায়িকাও। নির্মাতারা নায়ক কিংবা নায়িকা যে কোনো একজনকে নিলে নিজেরাই জুটি হিসাবে কাকে নিতে হবে সেটা ঠিক করে দেন।
ব্যবসায়িক কারণে অনেক সময় পরিচালকরা সেটা হাসিমুখে মেনে নিতে বাধ্য হন। শুধু তাই নয়, অনেক সময় নাটকে অন্যান্য চরিত্রের জন্য কোন শিল্পী নিতে হবে, সেটিও নায়ক বা নায়িকা নির্বাচন করেন। নায়ক-নায়িকাদের এ খামখেয়ালিপনা ও সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে বলি হচ্ছেন অনেক প্রতিভাবান শিল্পী। বাদ যাচ্ছেন না পার্শ্বচরিত্রে রূপদানকারীরাও। সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে অনেকের ক্যারিয়ারে নেমেছে ধস। তাতে করে মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে মিডিয়াকে বিদায় জানিয়েছেন অনেকে। কেউ কেউ তো দুনিয়া ছেড়েও চলে যাচ্ছেন। যদিও এর জন্য নাটকের সিন্ডিকেট পুরোটা দায়ী এটা না বলা গেলেও, সিন্ডিকেট যে একেবারেই দায়ী নয় এটাও বলা যাবে না।
সম্প্রতি শাহবাজ সানি নামে একজন পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতা মারা গেছেন। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি নাটকে অভিনয় করছেন। তবে শেষ কয়েক মাস ধরেই কাজ নিয়ে বেশ হতাশাগ্রস্ত ছিলেন বলে জানা যায়। তার মৃত্যুর পর, সহকর্মীদের প্রশ্নে আবারও সিন্ডিকেটের পুরোনো টপিক নতুন করে আলোচনায় আসে। নাটকে যে সিন্ডিকেট এখনো বিদ্যমান তা যেন জলের মতো স্পষ্ট।
সানীর মৃত্যুর পর সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই সানী নাটকের কাজ পাচ্ছিলেন না। অনেকের সঙ্গে কাজের চেষ্টা করে আসছিলেন। কিন্তু কাজ পাচ্ছেন না, আবার অনেক কাজ কনফার্ম হওয়ার পরও, তাকে বাদ পড়তে হচ্ছিল। প্রতিভাবান অভিনেতা হওয়া সত্ত্বেও সানীকে বাদ দেওয়ার বিষয়টিকে সিন্ডিকেটের শিকার বলে দাবি করছেন সহকর্মীরা। দীর্ঘদিন কাজ না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন এ অভিনেতা।
এক সময় মিডিয়া থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তও নেন। কিন্তু তবুও যেন ভালোবাসার টানে ছাড়তে পারছিলেন না। কিন্তু হতাশা তাকে তিলে তিলে ভিতর থেকে শেষ করে দিচ্ছিল।
অবশেষে, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান তিনি। সানীর এ চলে যাওয়া কি শুধুই একটি প্রাণের মৃত্যু, নাকি তিলে তিলে করা খুন?
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সানীর এক সহকর্মী বলেন, ‘সানী কখনোই কোনো গ্রুপ হয়ে কাজ করেনি। তার চেষ্টা থেকেই সে নিজের একটা ভালো অবস্থান তৈরি করে নেয়। কিন্তু ভালো প্রস্তাব পাচ্ছিল না। ইচ্ছা করেই অনেকে তাকে দুই একটি দৃশ্য ধরিয়ে দিত। কিন্তু সেসব ছোট চরিত্র না করলে সম্পর্ক খারাপ হতো। সে কারণে সে কিছু কাজ করত। আবার কখনো হঠাৎ কাজ থেকে বাদ দিত। হতাশা আর অভিমানেই ছেলেটা পৃথিবী থেকে চলে গেল।’
এদিকে দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসা নাটকের এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে ফাইট করার মতো যেন ইন্ডাস্ট্রিতে ক্ষমতাবান কেউ নেই। বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে একাধিকবার সংবাদ প্রকাশ হলেও সংশ্লিষ্টদের টনক নড়ছে না। কোথায় যেন অদৃশ্য এক শক্তির কাছে তাদের হাত বাঁধা। শক্তিশালী এ সিন্ডিকেটের কাছে সবাই যেন আজ অসহায় নিরুপায়।
এ প্রসঙ্গে বরেণ্য অভিনেতা, নাট্যকার ও পরিচালক আবুল হায়াত বলেন, ‘টিভি চ্যানেল আর এজেন্সি যেন হরিহর-আত্মা। গল্পের দিকে মনোনিবেশ না করে পরিচিত কিছু মুখকে নাটকে অভিনয় করার বিষয়ে অনেক বেসরকারি টিভি চ্যানেল থেকে নির্মাতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। তাতে করে মানের দিক দিয়ে টিভি নাটক যেমন নিম্নগামী হয়েছে, তেমনি সিন্ডিকেটের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিভাবান শিল্পীরা। হাতেগোনা কিছু নাটক ছাড়া বেশিরভাগ নাটকই আটকে যায় একটি নির্দিষ্ট ফরম্যাটে ও নির্দিষ্ট শিল্পীদের মধ্যে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিছুসংখ্যক নির্মাতা ও অভিনেতা সিন্ডিকেট করে টিভি নাটকে কাজ করছেন। ঈদ বা বিশেষ দিবসের আগে সিন্ডিকেট মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ সময় চাহিদাসম্পন্ন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা নির্দিষ্ট পরিচালকের বাইরে গিয়ে কাজ করেন না। এমনকি কাজের প্রস্তাব দিলেও, সিন্ডিকেটের বাইরের পরিচালকদের সিডিউল নেই বলে ফিরিয়ে দেন।
বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অভিনেতা ইরফান সাজ্জাদ। নিজেও সিন্ডিকেটের শিকার হয়েছেন জানিয়ে বলেন, ‘সিন্ডিকেট সব জায়গায় আছে। যুগ যুগ ধরে চলছে এবং থাকবে। আমার মতে এর দায় অবশ্যই প্রযোজক-পরিচালককে নিতে হবে। সেইসঙ্গে কয়েকজন শিল্পীকে। যারা এটার সঙ্গে যুক্ত তারা বলতে পারবেন এখান থেকে কতটা লাভবান হন।’
কাজ হারানোর ভয়ে এ বিষয়টি নিয়ে অভিনয়শিল্পীরা অনেকেই কথা বলতে চান না। তবে একাধিক অভিনয়শিল্পী অতিতেও এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন। সিন্ডিকেটের শিকার হয়ে অনেকেই পেশা বদলের মতো সিদ্ধান্তও নিয়েছেন, অনেকেই ছেড়েছেন এ পেশা। তবুও বিষয়টি নিয়ে সুন্দর কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা।