জুলাই বিপ্লবের প্রকাশ্য বিরোধিতাকারীদের নিয়ে এফডিসিতে নির্বাচন!
এফ আই দীপু
প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:২৯ এএম
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি পেতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছিল বিরোধী দলগুলো। কিন্তু দমনপীড়নের মাধ্যমে হাসিনা তার দুঃশাসন চালিয়ে গেছেন গত ১৬ বছর ধরে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন এ স্বৈরশাসক।
হাসিনার এ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আন্দোলন নিয়ে রাস্তায় নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে ছাত্রদের একটি সংগঠন। শুরুটা হয়েছিল কোটাবিরোধী আন্দোলন দিয়ে। গত বছরের ১৬ জুলাই রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে মারলে আন্দোলন বেগবান হয়। দেশজুড়ে শেখ হাসিনার নির্দেশে যখন পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যসব বাহিনীর সদস্যরা ছাত্রদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করছিল, তখন সাধারণ জনতাও আন্দোলনে যোগ দিয়ে হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
ঠিক সেই মুহূর্তে হাসিনার পাশে এসে দাঁড়ায় সিনেমাশিল্পের একদল আওয়ামী সমর্থক ও সরকারের সুবিধাভোগী। তাদের মধ্যে অভিনেতা-অভিনেত্রী, পরিচালক, প্রযোজকসহ টেকনিশিয়ানও রয়েছেন। জুলাই বিপ্লবের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদেরকে নিয়েই এবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির ২০২৫-২৬ সালের দ্বিবার্ষিক নির্বাচন।
গত ২৮ ডিসেম্বর এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও বিপ্লবের পক্ষের লোকজনের প্রতিবাদের মুখে সেটা পিছিয়ে যায়। এবার নির্বাচনের তারিখ ১০ জানুয়ারি নির্ধারণ করা হয়েছে। এ নির্বাচন নিয়ে এরইমধ্যে সংস্কৃতি অঙ্গনে বেশ ক্ষোভের জন্ম নিয়েছে। অনেকেই বলছেন, আন্দোলন চলাকালীন যারা প্রকাশ্যে ব্যানার নিয়ে ছাত্র-জনতাকে দেশাদ্রোহী আখ্যা দিয়ে হাসিনার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, তারাই আবার সিনেমাশিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের নেতৃত্বের জন্য লড়াইয়ে নেমেছেন!
জানা গেছে, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির এবারের নির্বাচনে দুটি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। একটি প্যানেল তৈরি হয়েছে সমমনা ঐক্য পরিষদ নাম দিয়ে। যেখানে সভাপতি প্রার্থী মুশফিকুর রহমান গুলজার ও মহাসচিব প্রার্থী সাফিউদ্দিন সাফি। এ প্যানেলে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আবুল খায়ের বুলবুল, মো. সালাহউদ্দিন, মো. তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়া, আব্দুর রহিম বাবু, রফিক সিকদার, এসডি রুবেল, মোস্তাফিজুর রহমান মানিক, শাহ আলম কিরণ, বদিউল আলম খোকন, ইফতেখার জাহান, মোস্তাফিজুর রহমান বাবু, বজলুর রাশেদ চৌধুরী, গাজী মাহবুব, মো. আনোয়ার সিরাজী, দেওয়ান নাজমুল, জয়নাল আবেদীন ও মো. আতিকুর রহমান লাভলু।
প্যানেলটিতে সভাপতি প্রার্থী মুশফিকুর রহমান গুলজার জুলাই বিপ্লবের সরাসরি বিরোধীতাকারী। তিনি আন্দোলন চলাকালীন এফডিসিতে প্রকাশ্যে আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসী ও দেশাদ্রোহী বলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, হাসিনার শাসনামলে তিনি একাধিকবার সরকারি অনুদানে সিনেমা নির্মাণসহ সিনেমাসংশ্লিষ্ট সব ধরনের সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছেন। বিতর্কিত ‘আলো আসবেই’ গ্রুপেরও সক্রিয় সদস্য ছিলেন গুলজার। এ প্যানেলের মহসচিব প্রার্থী সাফিউদ্দিন সাফিও আন্দোলন চলাকালীন ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে ফেসবুকে একাধিক স্টেটাস দিয়ে শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্য সমর্থন দিয়েছেন। ৫ আগস্টের পর তিনি সেসব স্টেটাস মুছে দিয়েছেন। একই প্যানেলে ছাত্র-জনতা আন্দোলনের প্রকাশ্য বিরোধিতাকারী ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান মানিক, শাহ আলম কিরণ এবং গায়ক এসডি রুবেল। প্যানেলটির অন্য প্রার্থীরাও আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন ও হাসিনাবিরোধী আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন। তবে আশ্চর্য হলেও সত্যি, একই প্যানেল থেকে ছাত্র-জনতা আন্দোলনের পক্ষের বিএনপি সমর্থিত চিত্রপরিচালক বদিউল আলম খোকন এবং তারিকুল ইসলামও (সায়মন তারিক) ফ্যাসিবাদের দোসরদের সঙ্গে মিলেমিশে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন!
অন্যদিকে ‘পাশে ছিলাম, পাশে আছি পাশে থাকব’ স্লোগানে সভাপতি পদে শাহীন সুমন ও মহসচিব পদে শাহীন কবির টুটুল একটি প্যানেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। একই প্যানেলের অন্যরা হলেন কবিরুল ইসলাম রানা (অপূর্ব রানা), সেলিম আজম, ওয়াজেদ আলী বাবলু, বন্ধন বিশ্বাস, সাইফ চন্দন, সাইদুর রহমান সাঈদ, ছটকু আহমেদ, জাকির হোসেন রাজু, শাহাদাৎ হোসেন লিটন, পল্লী মালেক, মো. জয়নাল আবেদীন, হাবিবুল ইসলাম হাবিব, এখলাস আবেদীন ও ডা. বুলবুল বিশ্বাস। এ প্যানেলের বেশিরভাগ প্রার্থীই আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে প্রকাশ্যে জড়িত ছিলেন বলে জানা গেছে।
এদিকে বন্ধ হয়ে যাওয়া নির্বাচন আবারও ১০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে এরইমধ্যে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রথমত, স্বৈরাচার হাসিনার প্রকাশ্য সমর্থকদের আবারও সিনেমার নেতৃত্বে আসার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে সরকার, এমন অভিযোগ জুলাই বিপ্লবের পক্ষের সাধারণ নির্মাতাদের। তারা বিষয়টি মোটেও মানতে পারছেন না। দ্বিতীয়ত, শেখ মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের তারিখ ১০ জানুয়ারি। ঠিক এ দিনেই আওয়ামী ফ্যাসিস্টরা নির্বাচন করে আবারও পরিচালক সমিতির ক্ষমতা নিজেদের দখলে নেবেন, এটাকে একটা গভীর ষড়যন্ত্র হিসাবেই দেখছেন জুলাই বিপ্লব সমর্থকরা। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের দাবি, গণহত্যার প্রকাশ্য সমর্থনকারী ও স্বৈরাচারের দোসরদের নিয়ে অনুষ্ঠিতব্য এ নির্বাচন বন্ধ করতে হবে। তাদেরকে এফডিসিসহ সিনেমাসংশ্লিষ্ট সব ধরনের কাজে নিষিদ্ধ করতে হবে। পাশাপাশি মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় সমিতিকে সচল রাখতে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত একটি নির্বাচনি আহ্বায়ক কমিটি করে দেওয়ার জন্য সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব নিতে হবে। তাদের দাবি, দুই হাজারেরও অধিক শহিদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে অর্জিত এই বিপ্লবের সুফল স্বৈরাচার ও গণহত্যাকারী হাসিনার দোসরদের কোনোভাবেই ভোগ করতে দেওয়া যাতে না হয়।