আমার ছেলে প্রেমিক হলে সে মরবে কেন: প্রশ্ন সালমান শাহর মায়ের
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২০, ০৪:৫৯ এএম
ছবি: সংগৃহীত
প্রয়াত চিত্রনায়ক সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী বলেছেন, আত্মহত্যা নয়, আমার ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমার ছেলে যদি প্রেমিক পুরুষ হয়, তা হলে সে মরবে কেন, প্রেমিকাকে রেখে প্রেমিক তো মরে না। আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে।
মঙ্গলবার লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব অফিসে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমন দাবি করেন। নীলা চৌধুরী বলেন, ২৪ বছর ধরে ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে নিগৃহীত হচ্ছি। আমি সালমানের মা হিসেবে নয়, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে এই হত্যার বিচার চাই।
এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের তদন্ত সংস্থা পিবিআই জানিয়েছে, আত্মহত্যাই করেছিলেন বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় এ নায়ক। দীর্ঘ তদন্তের পর সংস্থাটি বলছে, পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে হত্যার যে অভিযোগ করা হয়েছিল, এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
কিন্তু পিবিআইয়ের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে ফের সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন নীলা চৌধুরী। তার অভিযোগ, সালমানের স্ত্রী সামিরা এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত।
ঘণ্টাব্যাপী সংবাদ সম্মেলনে অধিকাংশ সময়ই তিনি ছেলের স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সালমান শাহকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। সে যদি আত্মহত্যাই করে থাকে, তা হলে কেন আমরা তার ঘরে যাওয়ার আগেই তাকে ফ্যান থেকে নামিয়ে ফেলা হলো?
তিনি আরও বলেন, সে যে ফ্যানে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে বলা হচ্ছে, তা বাস্তব সম্মত নয়। কারণ ফ্যানে ঝুললে তার পা মাটিতে লেগে যেত।
পুত্রবধূ সামিরাকে ছেলে হত্যার জন্য দায়ী করে নীলা চৌধুরী বলেন, সামিরার অবৈধ সম্পর্ক জেনে যাওয়ার কারণে সালমান শাহকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়।
চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে সালমানের প্রেমের সম্পর্ক ছিল যে দাবি করা হয়, তা মিথ্যা বলে তিনি উড়িয়ে দেন। সংবাদ সম্মেলনে সালমান শাহর ভাই শাহরান চৌধুরী বিল্টু ও মামা আওরঙ্গজেব বুলবুলও উপস্থিত ছিলেন।
এর আগেও পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনকে মনগড়া ও ভিত্তিহীন বলে মন্তব্য করে নীলা চৌধুরী বলেন, আমি এই রিপোর্ট মানি না মানব না।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তার মধ্যে ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইস্কাটন রোডে নিজের বাসা থেকে সালমান শাহর (চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইমন) লাশ উদ্ধার করা হয়।
তখন ঘটনাটিকে আত্মহত্যা ধরে সেই সময় অপমৃত্যু মামলা হয়। তাতে আপত্তি জানায় সালমান শাহর পরিবার। ১৯৯৭ সালে সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদনে ঘটনাটিকে ‘আত্মহত্যা’ উল্লেখ করা হয়।
এর পর ২০০৩ সালের ১৯ মে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে পাঠানো হয়। এর প্রায় ১২ বছর পর ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এতেও সালমান শাহর মৃত্যুকে ‘অপমৃত্যু’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
২০১৫ সালের ১৯ এপ্রিল মহানগর দায়রা জজ আদালতে আবার রিভিশন আবেদন করেন সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী। ২০১৬ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বিশেষ জজ ৬-এর বিচারক ইমরুল কায়েস তা মঞ্জুর করে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
পিবিআইপ্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, তদন্তের দায়িত্ব নেয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে সালমানের তখনকার স্ত্রী সামিরাসহ ৪৪ জনকে। তাদের মধ্যে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন ১০ জন। তদন্তের ভিত্তিতে মামলার ৬০০ পৃষ্ঠার ডকেট তৈরি করেছে পিবিআই। আজ আদালতে জমা দেয়া হবে এই তদন্ত প্রতিবেদন।
আগের দুই দফা ময়নাতদন্তে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য নিয়ে, তদন্তকালে সবার সাক্ষ্য বিবেচনা করে পিবিআই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। তাকে হত্যার কোনো প্রমাণ তদন্তে পাওয়া যায়নি।
সালমান শাহর মৃত্যুর এক বছর পর ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই তার বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী অপমৃত্যুর মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত করার আবেদন জানান। এর পর অপমৃত্যু মামলার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের বিষয়টি একসঙ্গে তদন্ত করতে আদালত সিআইডিকে নির্দেশ দেন।
১৯৯৭ সালের ৩ নভেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে সিআইডি জানায়, তারা আত্মহত্যার আলামতই পেয়েছে। সিআইডির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে কমরউদ্দিন রিভিশন মামলা করেন। ২০০৩ সালের ১৯ মে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে পাঠান আদালত। এর পর প্রায় ১২ বছর মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে ছিল।
এর মধ্যে কমরউদ্দিন মারা গেলে মামলাটি চালিয়ে যান সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী। যিনি এখন যুক্তরাজ্যে রয়েছেন। ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের কাছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন মহানগর হাকিম ইমদাদুল হক।
তাতে অপমৃত্যুর কথাই উল্লেখ করা হয়। নীলা চৌধুরী বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনও প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর হাকিম জাহাঙ্গীর হোসেনের আদালতে ওই প্রতিবেদনের বিষয়ে ‘নারাজি আবেদন’ দাখিল করেন।
তখন হত্যাকাণ্ডের আসামি হিসেবে সালমানের স্ত্রী সামিরা, তার মা লতিফা হক লুসি, ব্যবসায়ী ও চলচ্চিত্র প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাই, রুবি, রিজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ, সহকারী নৃত্যপরিচালক নজরুল শেখ, ডেভিড, আশরাফুল হক ডন, মোস্তাক ওয়াইদ, আবুল হোসেন খান ও গৃহকর্মী মনোয়ারা বেগমের নাম উল্লেখ করেন নীলা চৌধুরী।
আদালত নারাজি আবেদনটি মঞ্জুর করে র্যাবকে দিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন। এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে আবেদন করলে তা বাতিল হয়। এর পর পিবিআইকে দেয়া হয় তদন্তভার।
প্রসঙ্গত রুপালি পর্দার সালমান শাহর আনুষ্ঠানিক নাম শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন। সিলেটের জকিগঞ্জে নানাবাড়িতে ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তার জন্ম। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ড. মালেকা সায়েন্স ইনস্টিটিউট থেকে গ্র্যাজুয়েশন করা ইমন ১৯৯২ সালে বিয়ে করেন বিউটি পার্লার ব্যবসায়ীর মেয়ে সামিরাকে। তখন তার বয়স ২২ বছর ছিল।
মঈনুল আহসান সাবেরের লেখা ধারাবাহিক নাটক ‘পাথর সময়’-এর একটি চরিত্র দিয়ে ইমনের অভিনয় ক্যারিয়ার শুরু। মাত্র সাড়ে পাঁচ বছরের চলচ্চিত্র-জীবনে ২৭টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করা সালমান শাহ ঢাকাই সিনেমার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন।
নব্বইয়ের দশকে যারা বয়সে ছিলেন কিশোর-তরুণ, তাদের অনেকের হৃদয়েই সালমান শাহ বাংলাদেশের ‘সেরা রোমান্টিক অভিনেতা’ হয়ে থাকবেন।