যে পরিস্থিতিতে ‘নিজেকে শেষ করে দেয়ার’ সিদ্ধান্ত নেন সালমান
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১২:১৯ পিএম
ফাইল ছবি
পারিবারিক জীবনের নানা কোন্দলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন ৯০ এর দশকের জনপ্রিয় অভিনেতা সালমান শাহ। পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে হত্যার যে অভিযোগ করা হয়েছিল, এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
পুলিশের তদন্ত সংস্থা পিবিআই এমন দাবিই করেছে। সোমবার রাজধানীর ধানমণ্ডিতে পিবিআই সদর দফতরে সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে পারিবারিক কলহ আর স্ত্রী সামিরার কারণে মা নিলুফা চৌধুরী ওরফে নীলা চৌধুরীকে ছেড়ে দূরে থাকার মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেই অভিমানী সালমান শাহ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন বলে তাদের মনে হয়েছে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তার মধ্যে ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইস্কাটন রোডে নিজের বাসা থেকে সালমান শাহর (চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইমন) লাশ উদ্ধার করা হয়।
বনজ কুমার মজুমদার বলেন, তদন্তের দায়িত্ব নেয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে সালমানের তখনকার স্ত্রী সামিরাসহ ৪৪ জনকে। তাদের মধ্যে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন ১০ জন।
তিনি বলেন, তদন্তের ভিত্তিতে মামলার ৬০০ পৃষ্ঠার ডকেট তৈরি করেছে পিবিআই। আজ আদালতে জমা দেয়া হবে এই তদন্ত প্রতিবেদন। আগের দুই দফা ময়নাতদন্তে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য নিয়ে, তদন্তকালে সবার সাক্ষ্য বিবেচনা করে পিবিআই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। তাকে হত্যার কোনো প্রমাণ তদন্তে পাওয়া যায়নি।
সালমান শাহর মৃত্যুর এক বছর পর ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই তার বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী অপমৃত্যুর মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত করার আবেদন জানান। এরপর অপমৃত্যু মামলার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের বিষয়টি একসঙ্গে তদন্ত করতে আদালত সিআইডিকে নির্দেশ দেন।
১৯৯৭ সালের ৩ নভেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে সিআইডি জানায়, তারা আত্মহত্যার আলামতই পেয়েছে। সিআইডির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে কমরউদ্দিন রিভিশন মামলা করেন। ২০০৩ সালের ১৯ মে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে পাঠান আদালত। এরপর প্রায় ১২ বছর মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে ছিল।
এর মধ্যে কমরউদ্দিন মারা গেলে মামলাটি চালিয়ে যান সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী। যিনি এখন যুক্তরাজ্যে রয়েছেন। ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের কাছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন মহানগর হাকিম ইমদাদুল হক।
তাতে অপমৃত্যুর কথাই উল্লেখ করা হয়। নীলা চৌধুরী বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনও প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর হাকিম জাহাঙ্গীর হোসেনের আদালতে ওই প্রতিবেদনের বিষয়ে ‘নারাজি আবেদন’ দাখিল করেন।
তখন হত্যাকাণ্ডের আসামি হিসেবে সালমানের স্ত্রী সামিরা, তার মা লতিফা হক লুসি, ব্যবসায়ী ও চলচ্চিত্র প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাই, রুবি, রিজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ, সহকারী নৃত্যপরিচালক নজরুল শেখ, ডেভিড, আশরাফুল হক ডন, মোস্তাক ওয়াইদ, আবুল হোসেন খান ও গৃহকর্মী মনোয়ারা বেগমের নাম উল্লেখ করেন নীলা চৌধুরী।
সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই প্রধান বলেন, সালমান শাহর আত্মহত্যার পেছনে পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করেছেন তদন্তকারীরা। এগুলো হল- সালমান শাহ ও চিত্রনায়িকা শাবনূরের অতিরিক্ত অন্তরঙ্গতা, স্ত্রী সামিয়ার সঙ্গে দাম্পত্য কলহ, মাত্রাধিক আবেগপ্রবণতা (এ কারণে আগেও একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন), মায়ের প্রতি অসীম ভালোবাসা এবং জটিল সম্পর্কের বেড়াজালে পড়ে পুঞ্জীভূত অভিমান এবং সন্তান না হওয়ায় দাম্পত্য জীবনে অপূর্ণতা।
সালমান শাহর বাসায় রান্নার কাজ করা মনোয়ারা বেগমের জবানবন্দির বরাত দিয়ে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, সালমান তার স্ত্রী সামিরা এবং শাবনূর দুজনকেই খুব ভালোবাসতেন।
তিনি শাবনূরকেও বিয়ে করে দুই স্ত্রী নিয়ে সংসার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সামিরা সতীনের সংসার করতে রাজি হননি। পিবিআইর তদন্তে সালমানের মামা, সালমানের বাসার কাজের সহযোগী এবং পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদে বিষয়টি স্পষ্ট ফুটে ওঠে।
পিবিআই প্রধান বলেন, তদন্তের প্রয়োজনে যখন আমরা সালমানের বাসায় কাজের সহযোগী মনোয়ারা বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদ করি, তিনি জানান, সালমান শাবনূরকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। সামিরা ও শাবনূরকে নিয়ে একসঙ্গে সংসার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সামিরা তাতে রাজি হননি।
মনোয়ারা বেগম পিবিআইকে আরও জানান, সালমানের মৃত্যুর আগের দিন রাতেও শাবনূরকে নিয়ে সামিরার সঙ্গে ঝগড়া হয়। ওই সময় শাবনূরকে কল দিয়ে সালমান বলেছিলেন আর কখনও ফোন না দিতে। শাবনূরের উপহার দেয়া সিটিসেল ফোনটি এরপরেই ভেঙে ফেলেন।
এর আগে শাবনূরের আরেকটি দামি উপহার (একটি টেবিল ফ্যান) ভেঙে ফেলেন সালমান। মনোয়ারা বেগম জানান, শাবনূর প্রায়ই বাসায় আসত, এই বিষয়গুলো নিয়ে প্রায়ই সালমান ও সামিরার ঝগড়া হতো। মাঝেমধ্যে সামিরা রাগ করে চট্টগ্রাম চলে যেত।
সালমানের পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া ইজ্জাতুন নেছা সুইটিকে জিজ্ঞাসাবাদেও এমন তথ্য পায় পিবিআই। তিনিও জানান, সালমান-শাবনূরের অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা মেনে নিতে চাননি সামিরা। এ বিষয়গুলো নিয়ে সব সময়ই সংসারে ঝামেলা থাকত। এদিকে পারিবারিক অশান্তির কারণে স্ত্রী সামিরাকে তালাক দিতে চেয়েছিলেন প্রয়াত চিত্রনায়ক সালমান শাহ।
পিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য দেন সালমানের ছোট মামা আলমগীর কুমকুম। ওই সময় সালমান ফোনে মামাকে বলেছিলেন, ‘আমি সামিরাকে তালাক দেব।’
আলমগীর কুমকুম আরও জানান, সালমান মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। তার সন্তান হচ্ছিল না। সার্বিক বিষয় নিয়ে পারিবারিক কলহ লেগেছিল। তিনি শাবনূরকে বিয়ে করে একসঙ্গে সংসার করতে চেয়েছিলেন।
চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা সালমান শাহর আত্মহত্যার অন্যতম কারণ। দীর্ঘ তিন বছর দুই মাস তদন্ত শেষে এমনটাই জানিয়েছে পিবিআই।
তদন্তের স্বার্থে চিত্রনায়িকা শাবনূরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি পিবিআইকে বলেছিলেন, কো-আর্টিস্ট হিসেবে যতটুকু ঘনিষ্ঠতার দরকার ছিল, তা-ই ছিল।
শাবনূর জানান, সালমানের সঙ্গে ৫ সেপ্টেম্বর রাতে ‘প্রেম পিয়াসী’ সিনেমার ডাবিং ছিল, সেসময় সালমানকে খুব স্বাভাবিকই লেগেছিল। সালমানের মৃত্যুর খবর কখন পান- পিবিআইয়ের এমন প্রশ্নের জবাবে শাবনূর বলেন, ৬ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টায় সালমানের মৃত্যুর খবর পাই। কিন্তু আমি সালমানের জানাজায় যাইনি এবং পরে কখনও সালমানের বাসায় যাইনি।
সালমানের আত্মহত্যার পক্ষে বেশকিছু তথ্য-উপাত্তের কথাও জানানো হয় পিবিআইর পক্ষ থেকে। এর মধ্যে একটি হল সালমানের সুইসাইডাল নোট! পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, সিআইডি তদন্তকালে সামিরার কাছ থেকে এই সুইসাডাল নোটটি উদ্ধার করে।
সেটি সালমানের প্যান্টের পকেটে পাওয়া গিয়েছিল। সালমান সুইসাইডাল নোটে লিখেন, ‘আমি চৌ. মো. শাহরিয়ার। পিতা কমরুদ্দীন আহমেদ চৌধুরী। ১৪৬/৫, গ্রীণ রোড ঢাকা-১২১৫ ওরফে সালমান শাহ। এই মর্মে অঙ্গীকার করছি যে, আজ অথবা আজকের পরে যে কোনো দিন আমার মৃত্যু হলে তার জন্য কেউ দায়ী থাকবে না। সেচ্ছায়, সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে আমি আত্মহত্যা করছি।’