
প্রিন্ট: ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০২:২০ পিএম
আমরা বাঙালি কতদিনের

ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী
প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
বাঙালি আমরা কত দিনের? এই ইতিহাস এখনো প্রায় অস্বচ্ছ। বাঙালি জাতির ইতিহাস নেই বলে একসময় আক্ষেপ করেছিলেন স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রায় দুই শতাব্দীর পরও সেই খেদোক্তির পুরো অবসান ঘটেনি। প্রসঙ্গটি বেশি জটিল ও ঘোলাটে হয় তখনই, যখন বাঙালি জাতিসত্তার শিকড় কেউ অনুসন্ধান করতে যান। আমাদের বাঙালিদের উদ্ভব ও বিকাশের পরম্পরাগত ঐক্যসূত্র নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। পণ্ডিতদের মধ্যে এ নিয়ে মতভেদেরও ইয়ত্তা নেই।
বাংলা নামে অভিহিত ভূ-খণ্ডটি অতীতে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। আলাদা রাজনৈতিক পরিচয়ও ছিল। কিন্তু তা দীর্ঘকালের বিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন ও রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এগোতে এগোতে অসংখ্য বৈশিষ্ট্য ও উপাদানের অধিকারী হয়। কত যে পালাবদলের খেলা চলেছে এখানকার জনজীবনের ইতিহাসে, তার বিশদ বর্ণনা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
বাংলায় মানব বসতির সঠিক সময় আজও জানা সম্ভব হয়নি। ধ্রুপদী সাহিত্য ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণে’ বলা হয়েছে, পূর্ব ভারতে যে কটি ‘দস্যুকোম’ ছিল, তার একটি হলো ‘পুণ্ড্রকোম’ (বর্তমানে বগুড়া জেলার মহাস্থানগড় অঞ্চল)। অপরদিকে ‘ঐতরেয় আরণ্যকে’ উল্লেখ করা হয়েছে বঙ্গের। এই গ্রন্থ মতে, বঙ্গের অধিবাসীরা পাখির ভাষায় কথা বলত। আর্য ঋষিরা আরেক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, এরা ছিল ভ্রষ্ট, অনাচারী, দাস, দস্যু, লিঙ্গ উপাসক, নিষ্ঠাহীন, অদীক্ষিত, অবৈদিকভাষী এবং দেবতা ও বৈদিক কর্মবিরোধী। বাংলা অঞ্চল আর্যায়িত হয় এখন থেকে সাড়ে তিন হাজার বছরেরও আগে, খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে। তখন থেকে আর্যভাষী আদি নর্ডিক জনগোষ্ঠী এ অঞ্চলে আসে। কিন্তু এর বেশ কয়েক হাজার বছর আগে নব্যপ্রস্তর যুগেই কিন্তু এই ভূখণ্ডে মানবগোষ্ঠীর অবস্থানের প্রমাণ মেলে। এদের ছিল দীর্ঘ মুন্ডু, দীর্ঘ ও মধ্যোন্নত নাস। দেহ ছিল বলিষ্ঠ ও দৃঢ়বদ্ধ। ‘কোলিড’ বা আদি অস্ট্রেলীয় এবং অ্যালপাইন জনের মানুষ ছিল এরা। যদিও এর সঙ্গে খানিকটা মিশেল ছিল নিগ্রিটো (নিগ্রবুট) ও মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর রক্তের। বেশ কয়েক হাজার বছর ধরে চড়াই-উতরাই আর ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বিশেষ করে দীর্ঘমুণ্ডুর আদি অস্ট্রেলীয়, গোলমুণ্ডুর অ্যালপো-দীনারীয় এবং খানিকটা উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় প্রদেশের আদি ‘নর্ডিক’ জনস্রোতের ধারায় বাঙালি জনের উন্মেষ ঘটতে থাকে কাল পরম্পরায়। প্রত্ন বাঙালিত্বের এই পর্বের সমাপ্তি হয় খ্রিষ্টীয় নবম-দশম শতকে, যখন স্বতন্ত্র বাঙালি সত্তার অধিকারী ওই জনগোষ্ঠী ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তার অভ্যুদয়ের পরিচয়কে উপস্থাপন করতে সমর্থ হয়। আত্মশ্লাঘী হওয়ার একটা প্রেরণাও তখন থেকে ভেতরে ভেতরে কাজ করতে শুরু করে তাদের মধ্যে।
সন্ধিক্ষণ পেরিয়ে পূর্ণাঙ্গ বাঙালিত্বে উত্তরণের প্রক্রিয়াও ঘটে আঞ্চলিক পর্যায়ে ও প্রকৃতির নানা কার্যকারণকে অবলম্বন করে। আর্যবর্জিত বঙ্গ, সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্যের সঙ্গে কখনই তেমন আত্মীয়তা গড়ে তোলেনি। কিন্তু বঙ্গেই শিক্ষা-দীক্ষা এবং জ্ঞান চর্চার নিজস্ব একটা পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিল। যার সঙ্গে সর্বভারতীয় বৈশিষ্ট্যের কোনো যোগসাজশ ছিল না, প্রভাব তো ছিলই না। বাঙালির এই স্বাতন্ত্র্যবোধের কথা বর্ণনা করেছেন সপ্তম শতাব্দীর চীনা পরিব্রাজক ইউয়েন সাঙ। বাঙালির জ্ঞানচর্চায় ও জ্ঞানস্পৃহার প্রমাণ মিলে যখন বাঙালি পণ্ডিত শীলভদ্র বিশ্বশ্রুত কীর্তির জন্য বিহারের নালন্দা মহাবিহারে আচার্যের পদ অলঙ্কৃত করেন। ইউয়েন সাঙ আরও লিখেছেন, সে সময় বাঙালিরা বৌদ্ধ, নির্গ্রন্থ ও ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা-দীক্ষার পাশাপাশি ব্যাকরণ, শব্দবিদ্যা, হেতুবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, সংখ্যাতত্ত্ব, সংগীত, মহাযানশাস্ত্র, অষ্টাদশ নিকায়বাদ, যোগশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে অভিজ্ঞ ছিলেন। একেবারে পুরোপুরিভাবে বাংলায় এসব বিষয়ে খানিকটা চর্চা হয় খ্রিষ্টীয় নবম-দশম শতকে পাল শাসনামলে। এসময়ই মাগধী অপভ্রংশের গৌড়-বঙ্গীয় রূপ গড়ে ওঠে। একটি কথা এখানে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় যে, ভাষা হিসাবে বাংলার উত্তরণের কাজ ত্বরান্বিত করতে বাংলার রাজশক্তির অবদান অবশ্যই ছিল। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী শাসকরা চেয়েছিলেন ধর্মতত্ত্বকথা জনগণের কাছে পৌঁছাতে হলে লোকায়ত ভাষা বাংলায়ই সহজতর হবে। চর্যাগীতিই সেই লোকায়ত ভাষার সৃজ্যমান বাংলার প্রাচীনতম পরিচয়। এ সময় বাংলা ভাষা সূক্ষ্ম ও সুগভীর ভাব প্রকাশের ক্ষমতা অর্জন না করলেও ধর্মের তত্ত্বকথা ধারণ ও উপস্থাপনের যোগ্যতা লাভ করে। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম দলিল চর্যাগীতির মূল্য বাঙালির কাছে অনেক। এর মধ্যে দিয়েই বাঙালি প্রথম এবং স্বতন্ত্রভাবে তার মনের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা লাভ করে। বলতে কী, চর্যার যে ছন্দ, তাও কিন্তু এসেছে ‘সদানীরা’ অর্থাৎ জলময় পরিবেশের লোকায়ত লাচাড়ি ছন্দ থেকে। নদী, নৌকা ও মানুষ নিয়ে অসাধারণ বাংলার প্রকৃতি এই সৃষ্টিতে ঘুরেফিরে এসেছে। চর্যাগীতিকার মতো সমসাময়িক কালের পোড়ামাটির ভাস্কর্যেও বাঙালির জীবনপ্রবাহ ধরা পড়ে। দৈনন্দিন জীবন নানাভাবে সেখানে উপস্থিত। কথা-কাহিনি থাকলেও পোড়ামাটির সেই শিল্পে কোনো গভীর ভাব-রহস্য নেই, নেই বিস্তৃত কোনো তত্ত্ব কিংবা আদর্শ। বাংলার চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছিল। বাঙালির সমাজ সংস্থায় সর্বোপরি যে স্বতন্ত্র জীবনচর্যা গড়ে উঠেছিল, শিল্পকলায়ও তার দৃষ্টান্ত মিলে। বাঙালির ভাস্কর্য শিল্পের প্রকাশ ভঙিমায় অন্তর্লোকের কোনো গভীর চিন্তা বা ভাবে অভিব্যক্তি নেই। মুখাবয়ব স্থূল ও অমার্জিত, দাঁড়াবার ভঙ্গিও আড়ষ্টপূর্ণ। কিন্তু অবাক হতে হয়, এসব শিল্পে রয়েছে অসাধারণ প্রাণের প্রাচুর্য। বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাসে এই আঞ্চলিক রূপ ও রীতি ধরা পড়ে পাল আমলের তালপাতার অলংকরণোদ্দেশ্যে আঁকা চিত্রশিল্পে। সমসাময়িক কালের বাংলার সামাজিক অবস্থারই চিত্রায়ণ এ চিত্রশিল্প।
সেই সময়ের বিশাল ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গ তো একটি জনপদ বিশেষ। সামন্ত রাষ্ট্রের চেতনায় লালিত হয়ে আঞ্চলিক মনোবৃত্তির যোগ্যতা অর্জন করেছে মাত্র, যা কেবল জীবনবোধ ও মনমানসিকতাই নয়, ভাষা-সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। একটি জাতির পরিপূর্ণ অভ্যুদয়ের মধ্যে দিয়ে তার সমাপ্তি ঘটে। প্রত্ন বাঙালি পর্ব থেকে এখানকার জনগোষ্ঠী এ সময়ই বাঙালি হয়ে ওঠে। চর্যার কবি ভুসুকুপা সর্বস্ব খুইয়ে বাঙালি হলেন, ‘আজি ভুসুকু বাঙালি ভইলী’। ভুসুকুপার কথাটি যদি এভাবে নিই, তবে স্বীকার করতে হবে, তিনি পদ্মাপাড়ের জলদস্যুর দস্যুবৃত্তির কারণে সর্বস্ব খুইয়ে চণ্ডালীনি স্বদেশভূমির কাছে আত্মনিবেদন করেছিলেন। ভুসুকুপার, বাঙালিদের পুরোপুরি বাঙালি হয়ে উঠতে আরও কয়েকশ বছর সময় লেগেছে। খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতকে ইলিয়াস শাহের ‘শাহ-ই-বাঙালিয়ান’ই বাঙালি হিসাবে নিজেকে উপস্থাপনের প্রথম প্রয়াস। ইতিহাসের এই অভিজ্ঞান কোনোক্রমেই বিস্মৃত হওয়া চলবে না আমাদের।
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী : গবেষক; অধ্যাপক, লিবারেল আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস, রাজশাহী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নাটোর