
প্রতীকী ছবি
সুন্দর এই বাংলা, বৈচিত্র্যময় এই বাংলাদেশ। বহুবৈচিত্র্য আর বৈভবে গড়া আমাদের এই বাংলদেশ। পৃথিবীর চারটি প্রধান নরগোষ্ঠী যেমন নিগ্রীয়, মঙ্গোলীয়, ককেশীয় ও অস্ট্রেলীয় প্রতিটির কোনো না কোনো শাখার আগমন ঘটেছে এই বাংলায়। মিশ্রি ও বৈচিত্র্যময় একটি জাতির বিকাশ ঘটেছে এই বাংলায়। নৃবিজ্ঞানীরা মনে করেন বাংলার প্রাচীন জনগুলির মধ্যে অস্ট্রিক ভাষীরাই সবচেয়ে বেশি। আজ আমারা যাদের আদিবাসী বলে স্বীকৃতি দিতে দ্বিধাবোধ করি- যেমন সাঁওতাল, বাঁশফোড়, রাজবংশী প্রভৃতি আদি অস্ট্রেলীয়দের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাঙ্গালী জাতি দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষ একটি ইন্দো-আর্য জাতিগোষ্ঠীর নাম।
আজ স্বাধীন বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বরাক উপত্যাকা এবং নিম্ন আসাম ও মণিপুরের কিছু অংশের মধ্যে বিভক্ত। তাদের অধিকাংশই বাংলায় কথা বলে, যা ইন্দো-ইরানি ভাষাসমূহের বিশেষ একটি ভাষা। আমাদের সাংস্কৃতির আচার-আচরণ এর মূলে খুঁজতে গেলে আমাদের বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতির মেলবন্ধন দেখা যায়। এ ভূখন্ডে মুসলমানদের আগমন ও ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও দেখা যায়, সে সময় সুফিবাদের মাধ্যমে বা যাদের হাত ধরে এই বাংলায় মুসলমান ধর্মতত্ত্বের আর্বিভাব হয়েছে সেই সকল সুফি সাধকগণও এই অঞ্চলের মানুষের আচার আচরণ এবং সংস্কৃতিকে কতোইনা গুরুত্ব দিতো। তারা কখনোই এই ভূখন্ডের আদি সংস্কৃতিকে অবমূল্যায়ন করেনি। এই অঞ্চলের সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিয়েই তাদের একেশ্বরবাদ ঘোষণা করেছে। অপামর জনসাধারণের মনে স্থান করে নিয়েছে। বিবেবকে জাগ্রত করে তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বরোধ সৃষ্টি করেছে।
আগ্রাসী সংস্কৃতি এবং বিভেদের এক বেনিয়া সংস্কৃতির শরুটাই হয় ব্রিটিশ বেনিয়াদের হাত ধরে, অনেক সুকৌশলে। যার সুপ্ত আগুনের দহন ভারতবর্ষের প্রতটি এলাকায় দগদগ করে জ্বলছে, ভেতর থেকে দহন করছে, পুড়ছে এই ভূখন্ডের ঐতিহ্য আর সাংস্কৃতিসহ জাতি সত্ত্বাকে। এর প্রতিটি স্তরে সুবিধাভোগী ছিলো সমাজের উঁচু স্তরের তথাকথিত সামাজ, ধনবান সমাজ। তাদের কারণেই বারবার রক্ত ঝড়িয়েছে এই জনপদের মানুষগুলো। বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির মধ্যে বিভেদ ধরিয়ে তারা শুধু নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছে। বিনিময়ে নিম্ন গোত্রের মানুষ কিছুই পায়নি। যুগে যুগে প্রতারিত হয়েছে। আজও তারা প্রতারিত হচ্ছে।
১৯৭১ সালের রক্তের বিনিমিয়ে একখণ্ড স্বাধীনতা পেয়েছে। স্বাধীনতার সুফল নিতে পারেনি এই জনপদের সাধারণ জনতা। ৫২ বছরের প্রতারিত স্বাধীনতার দহনে পুড়েছে এই জনতা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নব্বই এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং চব্বিশ এর ফ্যাসিবাদবিরোধী বিপ্লব সবগুলোই একইসূত্রে গাঁথা। রক্ত দিয়েছে জনতা, প্রাণ দিয়েছে বেশি শ্রমজীবী মানুষ। কথা ছিলো ভালো থাকার। কথা ছিলো ফিরে আসবে সকল জাতি বৈচিত্র্যের স্বাধীনতা। কথা ছিলো ঘরে বাহিরে মুক্ত স্বাধীনতা পাবে আছিয়ারা। মুক্ত আকাশে আর গাছে ঘর বাঁধা পাখিদের স্বাধীনতা, বৃক্ষের স্বাধীনতা, বাতাসের স্বাধীনতা, সবই যেনো আজ খামচে ধরেছে। আছিয়ারা আজ ধর্ষিত হয় ঘরে বাহিরে। উন্নয়নের নামে নির্বিচারে গাছ হত্যা, বন্যপ্রাণী শিকার, বৈচিত্র্যকে বিবেচনায় না নিয়ে উন্নয়ন করা, উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংস করা। সবই যেনো একই সূত্রে গাঁথা। আমরা কতোকিছুরই স্বাধীনতা হারাচ্ছি। আমরা পক্ষে বিপক্ষে ক্ষমতার স্বাধীনতাকে যখন জনগণের স্বাধীনতা বলে চালিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় আরোহন করি। আর দিন শেষে ওই বৈচিত্র্যগুলোকে ভুলে যাই। জাতি আর বৈচিত্র্যকে মুখোমুখি দাঁড় করাই, সহিংসতা ছড়াই, এটাই কি স্বাধীনতা?
একাত্তুরের প্রথম বিপ্লব আমাদের একখন্ড জমি দিয়েছে কিন্তু ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরশাসন মুক্ত করতে পারেনি। চব্বিশের দ্বিতীয় ফ্যাসিবাদবিরোধী বিপ্লবের কথা ছিলো ফ্যাসিবাদমুক্ত। ফ্যাসিবাদমুক্ত হয়তো বাহ্যিকভাবে হতে পেরেছি। মননে এবং হৃদয়ে আমরা ফ্যাসিবাদমুক্ত হতে পারিনি। এই ভূখন্ডে প্রয়োজন তৃতীয় আরেকটি বিপ্লব। তা হোক বিবেকের বিপ্লব। প্রতিটি ঘরে ঘরে বিবেকের বিপ্লবের দুর্গ গড়ে তুলতে নিজ থেকেই শুরু করতে হবে। আমার ঘরে, আমার পরিবারে বিবেককে জাগ্রত করি, বিবেকের বিপ্লবের মহাযাত্রা শুরু হোক। এই বিবেকের বিপ্লবে যেনো আছিয়ারা নিজ ঘরে বা মানুষের ভিড়েও স্বাধীন ধাকতে পারে। এই তৃতীয় বিবেকের বিপ্লবের কারণে যেনো পাখিরা ঘর ছাড়া না হয়, বৃক্ষ যেনো স্বাধীনতা পায় বেড়ে উঠার, বন্যপ্রাণীরা যেনো বিচরণ করে স্বাধীনভাবে। নিম্ন গোত্রের মানুষ যেনো তার অধিকার নিশ্চিত পায়। রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে পাড়া অলিগলি পর্যন্ত দুষ্কৃতকারীরা শাস্তি পায়। বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সরকারি বেসরকারি সকল স্তরে প্রয়োজন তৃতীয় আরেকটি বিপ্লব, তা হোক বিবেকের বিপ্লব।
লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও পরিবেশ আইন গবেষক
বাংলাদেশে রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজিনাস নলেজ-বারসিক
ইমেইল: shahidul546mh@gmail.com