Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বাইফোকাল লেন্স

বিচারের কাঠগড়ায় হাসিনাকে দাঁড়াতেই হবে

Icon

একেএম শামসুদ্দিন

প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিচারের কাঠগড়ায় হাসিনাকে দাঁড়াতেই হবে

১২ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার বাংলাদেশে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ক্ষমতা অপব্যবহারের বিষয়ে লিখিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে ক্ষমতায় থাকতে নৃশংস পদক্ষেপ নেওয়ার অভিযোগ আনা হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। প্রতিবেদন প্রকাশ করতে গিয়ে বলা হয়, গণবিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে একটি পরিকল্পিত এবং সুসমন্বিত কৌশল হিসাবে এমন কিছু বর্বরোচিত পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যা বিচারের দাবি রাখে। বিক্ষোভ দমনে তিনি ও তার ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে, তাদের সমন্বয়ে ও নির্দেশনায় শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচারে গ্রেফতার ও আটক এবং নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। তাদের কাছে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য ও প্রমাণ আছে, যা ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও মানুষকে নিশানা করে হত্যার উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেছে। এসব নৃশংস ঘটনা জাতীয় ক্ষতচিহ্ন হিসাবে বিবেচিত হবে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় আওয়ামী লীগের সহিংস কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি শেখ হাসিনার সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পদ্ধতিগতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাবলি আন্তর্জাতিক অপরাধের শামিল বলেও বিবেচিত হতে পারে। গত ১৯ জুলাই অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সাক্ষ্যদানের ভিত্তিতে রচিত প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা নিজেই নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বিক্ষোভ দমনে বিক্ষোভকারীদের হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিশেষ করে ‘বিক্ষোভের মূল হোতা, গণ্ডগোলে অংশগ্রহণকারীদের গ্রেফতার, হত্যা, এমনকি হত্যার পর লাশ লুকিয়ে রাখারও নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার প্রতিবেদন প্রকাশের সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বলেন, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে গুম, নির্বিচারে গ্রেফতার ও সহিংস পদ্ধতিতে বিক্ষোভ দমনের মতো নানা ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনে সঙ্গে শেখ হাসিনা জড়িত ছিলেন। তিনি শেখ হাসিনার সৃষ্ট বাংলাদেশের এ ‘জাতীয় ক্ষত’ সারাতে এবং ভবিষ্যতের জন্য জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাকে অপরিহার্য বলে মনে করেন।

হত্যার শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে ১২ শতাংশ ছিল শিশু। ১৩ হাজারের ওপর মানুষকে আহত করা হয়েছে, যার মধ্যে ৭৩৬ জন চোখে আঘাত পেয়েছে। চোখে আঘাতপ্রাপ্তদের মধ্যে অধিকাংশই চিরতরে হয় দুই চোখ অথবা এক চোখে দেখার শক্তি হারিয়েছেন। ১১ হাজারেরও বেশি আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মানুষ হত্যা করতে প্রাণঘাতী অস্ত্রই ব্যবহার করা হয়েছে বেশি। হত্যাকাণ্ডে যেসব অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, তার মধ্যে ৬৬ শতাংশ ৭.৬২ ক্যালিভার রাইফেল, যা কেবল সামরিক বাহিনীতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, শেখ হাসিনাই বেনজীর আহমেদ আইজিপি থাকাকালীন পুলিশ ফোর্সের অস্ত্র তালিকায় এ প্রাণঘাতী অস্ত্র বরাদ্দ দিয়েছিলেন। জানামতে, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের পুলিশ ফোর্স এ অস্ত্র ব্যবহার করে না। এ ছাড়াও ১২ শতাংশ শটগান, ২ শতাংশ পিস্তল এবং ২০ শতাংশ অন্যান্য অস্ত্রের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন।

২৭ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে যে তদন্ত করেছে, সে তদন্ত প্রতিবেদনেও শেখ হাসিনাকে গুম ও খুনের সরাসরি নির্দেশদাতা বলা হয়েছে। এইচআরডব্লিউর একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ‘আফটার দ্য মুনসুন রেভ্যুলুশন-এ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ’ নামের ৫৫ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুম ও খুনের বিষয়ে অবগত আছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন কর্মকর্তারা এইচআরডব্লিউকে একাধিক গুম ও খুনের ভয়াবহ ঘটনার তথ্য দিয়েছেন। শেখ হাসিনার শাসনামলে পুলিশ-র‌্যাবসহ অন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে তদন্তকারী সংস্থাটি। এইচআরডব্লিউ এসব বিষয় নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন বলে জানানো হয়েছে। কর্মকর্তারা বলেছেন, বাহিনীকে রাজনীতিকরণ করার মধ্য দিয়ে জনগণের সামনে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং র‌্যাবে আওয়ামী লীগের পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়োগ, পদোন্নতি এবং পুরস্কৃত করে নিরাপত্তা বাহিনীর রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে সরাসরি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করতে ব্যবহার করা হতো নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীকে। এমনকি বিরোধী মতাদর্শের ব্যক্তিদের নিষ্পেষণের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের প্রণোদনা হিসাবে পুরস্কৃতও করা হতো।

২০০৮ সালে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করার প্রথম দু’তিন বছর নিয়মতান্ত্রিকভাবে দেশ পরিচালনা করলেও ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনব্যবস্থা বিলোপের পর ধীরে ধীরে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী চরিত্র প্রকাশ পেতে থাকে। ২০১৪ সালের অটোপাশ-এর নির্বাচনের পর আবারও ক্ষমতায় আসীন হয়ে শেখ হাসিনা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন। বিরোধী রাজনৈতিক দল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন ও নিপীড়নে পুলিশ ও র‌্যাবকে দলীয় ক্যাডারদের মতো ব্যবহার করা শুরু করেন। গুম ও খুনের মাধ্যমে দেশ ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে ভয়-ভীতির সংস্কৃতি চালু করেন। একটি কেন্দ্রীয় কমান্ড কাঠামোর অধীনে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গুমের ঘটনা ঘটত। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের গুমের ঘটনা দেখাশোনা করতেন স্বয়ং শেখ হাসিনা এবং তার নির্বাচিত কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা। কথিত কেন্দ্রীয় কমান্ডের নেতৃত্বে ছিলেন শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক সিদ্দিক। তিনি শেখ হাসিনার নিকটাত্মীয়ও বটে। এছাড়াও সামরিক কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান, পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম এবং মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ গুম-খুনের জন্য গঠিত কেন্দ্রীয় কমান্ডের সদস্য ছিলেন। গুমের সঙ্গে জড়িত এমন কর্মকর্তা বলেছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুম ও খুনের সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা স্বয়ং।

এত ভয়াবহ অপরাধের পরও শেখ হাসিনার ভেতর অনুশোচনার কোনো লক্ষণ নেই। গদিচ্যুত হয়ে পলায়নের পর তিনি ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। পালিয়ে গিয়েও তিনি চুপ করে বসে থাকেননি। গোপন স্থানে অবস্থান করে মাঝে-মধ্যেই তিনি নানাবিধ বক্তব্য ও বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন। এসব বক্তব্য ও বিবৃতিতে একবারের জন্যও তিনি তার কৃতকর্মের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেননি। দুঃখ প্রকাশ তো দূরে থাক, তিনি এখনো কর্তৃত্ববাদী শাসকের মতোই বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে বেড়াচ্ছেন, যা এ দেশের মানুষ ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারছে না। ফলে এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। সাম্প্রতিক ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িসহ বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগের দুর্নীতিবাজ নেতাদের বাড়িঘরে যে আক্রমণ হয়েছে, এটি তারই ফল। ভবিষ্যতেও হাসিনা যদি একই কাজ করেন, তাহলে জনগণের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তাই দেখার বিষয়।

ভারত যে বাংলাদেশ ও তার নাগরিকদের প্রকৃত বন্ধু নয়, হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে তা আবারও প্রমাণ করেছে। ভারতের এরূপ আচরণে এ দেশের মানুষ অন্তত তাই বিশ্বাস করে। ভারত হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েই বসে থাকেনি; সে দেশে বসে হাসিনা যাতে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে পারে, তার জন্য যাবতীয় যা কিছু প্রয়োজন, তাই জোগান দিয়ে যাচ্ছে। একটি বিষয় আমার প্রায় মনে হয়, ভারত বাংলাদেশে কোনো প্রকার নাশকতামূলক কার্যকলাপ শুরুর পরিকল্পনা করছে কিনা। এমন মনে হওয়ার কারণ আছে। পঁচাত্তরে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এক সপ্তাহের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংহতি সমিতির তৎকালীন নেতা মানবেন্দ্র লারমা ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের আগরতলায় ডেকে পাঠিয়ে গোপন মিটিং করে এবং এক মাসের মধ্যে তথাকথিত শান্তিবাহিনী সংগঠিত করে দুই দশক ধরে পার্বত্য অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে রাখে ভারত। ভারত শেখ হাসিনাসহ সহস্রাধিক আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের আশ্রয় দিয়েছে। কিছুদিন আগে এসব নেতাকর্মী বাংলাদেশে তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা প্রণয়নের জন্য ভারতে বসে মিটিংও করেছে। একটি কথা মনে রাখতে হবে, গত ১৬ বছরে শেখ হাসিনা ও তার দল যে হারে অর্থ লোপাট করেছে, তাতে তাদের অর্থের অভাব নেই। এছাড়াও একই সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইস্যুকৃত লাইসেন্স নিয়ে আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী বিপুল সংখ্যায় অস্ত্রের মালিকও হয়েছে। এর অধিকাংশ অস্ত্র এখনো তাদের কাছেই রয়ে গেছে। শেখ হাসিনা যে মানসিকতার মানুষ, তাতে তিনি আবারও আগের অবস্থানে ফিরে আসার জন্য অদূরভবিষ্যতে এসব অস্ত্রবাজ ক্যাডারকে দিয়ে দেশের জেলায় জেলায় যদি নাশকতামূলক কার্যকলাপ চালান, তাহলে আশ্চর্য হব না। দেশে ও বিদেশে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের চাল-চলনে, কথাবর্তায় সে ইঙ্গিতই প্রকাশ পায়। এ ধরনের পরিকল্পনায় আমাদের তথাকথিত বন্ধুরাষ্ট্রটির যে কোনো ইন্ধন থাকবে না, এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।

ভারতে বসে হাসিনা যে পরিকল্পনাই করুক, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের শিকার শত শত সন্তান হারানো মায়ের আত্মনিঃসৃত আর্তনাদ উপেক্ষা করে নিজেকে তিনি যতই নির্দোষ দাবি করুন, দেশি ও আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশনের তদন্তে গুম ও খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পরও ভারত শেখ হাসিনাকে যদি ফেরত না-ও দেয়, তাতে সবচেয়ে ক্ষতি হবে শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের। মনে রাখতে হবে, সন্ত্রাস ও নাশকতার মাধ্যমে আর যাই হোক, এ দেশের মানুষের মন জয় করা যাবে ন। এভাবে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে যে জাতির জন্ম, সে জাতি এ দেশের হাজারও মানুষের রক্তে রঞ্জিত কোনো স্বৈরশাসককে মেনে নেবে না। সুতরাং, শেখ হাসিনাকে রাজনীতি করতে হলে তার অপকর্মের সব হিসাব চুকিয়েই করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এজন্য বিচারের কাঠগড়ায় তাকে দাঁড়াতেই হবে। এ ছাড়া শেখ হাসিনার আর কোনো গত্যন্তর আছে বলে মনে হয় না।

একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম