Logo
Logo
×

সম্পাদকীয়

অপসাংবাদিকতার স্বাধীনতা নয়

মারুফ কামাল খান

মারুফ কামাল খান

প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:১৫ পিএম

অপসাংবাদিকতার স্বাধীনতা নয়

একটা দেশে সরকার আছে কিন্তু খবরের কাগজ নেই। কিংবা দেশটিতে খবরের কাগজ আছে কিন্তু কোনো সরকার নেই। এই দুই অবস্থার মধ্যে যে-কোনো একটিকে বেছে নিতে বলা হলে আপনি তুললামূলকভাবে কোনটাকে ভালো মনে করে বেছে নেবেন? টমাস জেফারসন এই দুই অবস্থার মধ্যে সরকার না থাকলেও সংবাদপত্র আছে - এমন পরিস্থিতিকেই উত্তম বলে বিবেচনা করতেন। এই দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপিতাদের একজন এবং দেশটির তৃতীয় প্রেসিডেন্ট।

মিডিয়ার গুরুত্বের ব্যাপারে জেফারসনের ওই উক্তির চেয়ে আর কোনো বেশি জোরালো মন্তব্য আমার অন্তত জানা নেই। আপনি যদি একটা আধুনিক রাষ্ট্র গড়তে চান এবং গণতন্ত্রকে যদি সেই রাষ্ট্রের পরিচালনার পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করেন তাহলে সেই রাষ্ট্রে গণমাধ্যমের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সরকারের চেয়ে বেশি না হোক, কম নয় মোটেও। মিডিয়া ছাড়া রাষ্ট্রের কল্পনা আধুনিক সভ্যতার পরিপন্থী।

মিডিয়ার সবচে' অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে স্বাধীনতা। স্বাধীনতা ছাড়া মিডিয়া হয় না, হতে পারে না। নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া মানে কোনো পক্ষের ইশতেহার বা সরকারি তথ্যবিবরণী। কাজেই মিডিয়া কখনো নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। মিডিয়া মানেই ফ্রি। কাজেই আলাদা করে মুক্ত মিডিয়া বা ফ্রি প্রেস বলার দরকার পড়ে না। এই বিশেষণ একেবারেই অপ্রয়োজনীয়।

তবে মুক্ত বা ফ্রি হলেই যে সব মিডিয়া ভালো হবে এমন কোনো কথা নেই। স্বাধীন মিডিয়াও মন্দ হতে পারে। সে পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে, তথ্যকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করতে পারে এবং তার সম্পাদকীয় বিবেচনা ও যোগ্যতা খুব ত্রুটিপূর্ণ বা দুর্বলও হতে পারে। যদি এমনটাও হয় তবুও সে মন্দ মিডিয়ার স্বাধীনতা খর্ব না করার পক্ষে মত দিয়েছেন তাত্ত্বিক ও পণ্ডিত মানুষেরা। তারা বলেন- মন্দ ও ভালো মিডিয়ার মধ্যে প্রতিযোগিতায় মন্দগুলো এমনিতেই সংশোধিত হবে, নতুবা ঝরে যাবে।

এ কথার মানে তারা এমন একটা আদর্শ পরিস্থিতিকে অপরিহার্য বলে ধরে নিয়েছেন, যেখানে মন্দ মিডিয়া এবং সত্যনিষ্ঠ ও সৎ মিডিয়ার মধ্যে অবাধ প্রতিযোগিতা চলমান থাকে।

এখন চট করে চলে আসুন বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায়। এখানে দেড় দশকের বেশি সময় ধরে এক ভয়ঙ্কর ফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থা দোর্দণ্ড প্রতাপে বিরাজ করেছে। এই ফ্যাসিবাদ মিডিয়াসহ দেশ-সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্র ও অঙ্গনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে গেছে। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক, ডিজিটালসহ গণমাধ্যমের প্রতিটি ধারাকেই এই ফ্যাসিবাদ করেছে দুর্নীতিগ্রস্ত, বিকৃত ও কলুষিত। মিডিয়ার স্বাধীনতাই কেবল তারা কুক্ষিগত করেনি, অনেক মিডিয়া বন্ধ করেছে। বেয়াড়া অনেক সাংবাদিককে এই ফ্যাসিস্টরা মেরে ফেলেছে। অনেককে গুম, অপহরণ, জেল-জুলুম ও দৈহিক নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে।

মিডিয়ার ব্যাপারে ফ্যাসিবাদী রেজিম 'ক্যারট অ্যান্ড স্টিক' কৌশল অবলম্বন করে কাউকে লোভে-টোপে বশীভূত এবং কাউকে ভয় দেখিয়ে স্তব্ধ করে দিয়েছে। স্বাধীনচেতা সাংবাদিকদেরকে নানা অপকৌশলে বেকারত্বের পথে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। গত দেড় দশকে সাংবাদিকতা পেশার রিক্রুটমেন্টের ক্ষেত্রে একচক্ষু নীতি অবলম্বনে বাধ্য করা হয়েছে। ফ্যাসিবাদের সমর্থক ও অনুগত ছাড়া কাউকে কোথাও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আর মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ও নেতৃস্থানীয় পদগুলোতে বেছে বেছে বশংবদদের বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এইসব কার্যকলাপের মাধ্যমে বাংলাদেশের মিডিয়া অঙ্গনে সম্পূর্ণ ভারসাম্যহীন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। যেখানে সাংবাদিকতা ও ক্ষমতাসীনদের স্তাবকতাকে সমার্থক করে ফেলা হয়েছিল।

এখন আমাদের দেশে মন্দ মিডিয়া বনাম সত্যনিষ্ঠ মিডিয়ার মধ্যে অবাধ প্রতিযোগিতার কোনো অবকাশই নেই। কেননা সবখানে ও সবক্ষেত্রে এখন মন্দ মিডিয়ার দোর্দণ্ড প্রতাপ। সৎ সাংবাদিকতা এখানে এখন 'মাইক্রোস্কোপিক মাইনোরিটি।' ভারসাম্যহীন এ পরিস্থিতিতে মিডিয়ার স্বাধীনতার অর্থই দাঁড়াবে অপসাংবাদিকতার স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা গণতন্ত্র, মানুষের স্বাধীনতা, অধিকার ও স্বার্থের বিরুদ্ধেই যাবে।

তার মানে আমি কি এখন বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিরোধিতা করছি? না তা মোটেও নয়। গণমাধ্যমের অবারিত স্বাধীনতা অবশ্যই থাকতে হবে। তবে সেই সঙ্গে সত্যনিষ্ঠ মিডিয়া ও সৎ সাংবাদিকতাকে দ্রুত শক্তিশালী করে ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এই দায়িত্ব রাষ্ট্রের ও সমাজের। এরজন্য সাংবাদিকতাকে আক্রমণ করা যাবে না। কিন্তু সাংবাদিকতাকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে যে-সমস্ত অন্যায়, অপরাধ, অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে তার প্রতিকার ও বিচার অবশ্যই করতে হবে। সাংবাদিকতায় রিক্রুটমেন্টের ক্ষেত্রে আবারো অবাধ প্রতিযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। মিডিয়ার শীর্ষ পদগুলোতে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। বিলুপ্ত করে দেওয়া স্বায়ত্বশাসিত প্রেস ট্রাস্টকে অবিলম্বে পুনরুজ্জীবিত করে ট্রাস্টের সংবাদপত্রগুলো পুনঃপ্রকাশ করতে হবে। একই সঙ্গে ট্রাস্টের মালিকানায় নিউজ এজেন্সি, নিউজ পোর্টাল এবং রেডিও-টেলিভিশন চালু করা যেতে পারে।

এইসব উদ্যোগ দ্রুত ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। সরকারি বিজ্ঞাপন ও মিডিয়াকে প্রদেয় অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বিতরণের ক্ষেত্রে সৎ সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করার নীতি গ্রহণ করতে হবে। তবে কোনোক্রমেই সৎ সাংবাদিকতার নামে অনুগত সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করা যাবে না।

এই পদক্ষেপগুলোকেই আমি ক্রান্তিকালীন মিডিয়া সংস্কারের অংশ বলে মনে করি। এবং এই পদক্ষেপগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে সাংবাদিকতায় ভালো ও মন্দের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি হবে। আর তখনই সাংবাদিকতার স্বাধীনতা হবে কল্যাণপ্রসূ।

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম