নব্য ‘ক্লাসিক’ ভাষা : প্রহসনের নামান্তর
পবিত্র সরকার
প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ভাষাবিজ্ঞানীরা ‘ক্লাসিক্যাল’ বা ধ্রুপদি বা ‘শাস্ত্রীয়’ ভাষা হিসাবে এতদিন মোদ্দা তিনটি ভাষাকে চিহ্নিত করেছিলেন-গ্রিক, লাতিন ও সংস্কৃত। শর্ত ছিল মূলত দুটো। এক. ভাষাটি অন্তত দু-হাজার বছরের প্রাচীন হবে, আর তার একটি সমৃদ্ধ সাহিত্য থাকবে। আরও একটি শর্ত হয়তো ছিল-সেগুলো এমন একটি সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নির্মাণ করবে, যা থেকে পরবর্তী অনেক ভাষা উত্তরাধিকার পেয়ে সমৃদ্ধ হবে। এগুলো মৃত ভাষা হবে, সেটি ছিল আর একটি অনুমান। ইংরেজি সাধারণ অভিধান খুললে সংস্কৃতের নাম পাওয়া যাবে না। সেখানে শুধু গ্রিক আর লাতিনের উল্লেখ। তবে, অক্সফোর্ড, নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত Tom McArthur-এর The Oxford Companion to the English Language নামক কোষগ্রন্থটিতে (১৯৯২) প্রথমে এ তিনটি ভাষারই নাম আছে। পরে সংগতভাবেই আরবির কথাও এসেছে। সেই সঙ্গে যোগ করা হয়েছে, অ-ধ্রুপদি ভাষারও একটা ধ্রুপদি স্তর থাকতে পারে, যেমন তামিল ও হিন্দিতে সংস্কৃত স্তর (বাংলার কথা মনে পড়েনি টমের), ইংরেজির যেমন আছে লাতিন স্তর। এ কথাটি ভাষা অর্থে না বুঝে শব্দের ব্যবহার বাহুল্য হিসাবে বুঝতে হবে। ব্যাকরণ নতুন ভাষারই, কিন্তু প্রচুর ধার করা শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে প্রাচীন ভাষার। যেমন ধরা যাক ঊনবিংশ শতাব্দীর সাধু বাংলায়।
কিন্তু আশ্চর্যের কথা, এ শতাব্দীর প্রথমদিকে ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে তামিলকে ক্লাসিক্যাল ভাষা হিসাবে ঘোষণা করা হলো। তামিল প্রাচীন ভাষা, সমৃদ্ধ আর জীবন্ত ভাষাও বটে, বোধহয় আরবির আদল মেনে এটি করা হলো। কিন্তু তামিল ভারতের একটি রাজ্যে মূলত সীমাবদ্ধ। এরপর ধারাবাহিকভাবে মোট ১১টি ভাষাকে ক্লাসিক্যাল মর্যাদা দেওয়া হলো। প্রথম হাস্যকর ব্যাপার হলো, ২০০৪ সালে প্রথম তামিলকে এ তকমা দেওয়ার পরের বছর সংস্কৃতের কপালে এ টীকা জুটল। আর এবারের হাস্যকর ব্যাপার হলো, ‘প্রাকৃত’ নামে একটি ভাষাকেও ধ্রুপদি ঘোষণা করা হলো। কিন্তু ভাষার ছাত্র মাত্রই জানে, একটি নয়, মোট চারটি অন্তত প্রাকৃত ভাষা শুধু সংস্কৃত নাটকে ব্যবহৃত হয়েছে-শৌরসেনী, মাগধী, মাহারাষ্ট্রী, অর্ধমাগধী। আরও নানা ক্ষেত্রে নানা রকম প্রাকৃত পাওয়া যাবে। এর মধ্যে কোন্ প্রাকৃত ধ্রুপদি হলো? সবক’টিই? সরকারি বিশেষজ্ঞরা জবাব দেবেন কি?
আমাদের মতো খারাপ লোকের সন্দেহ, এর মূলে একটা অন্য অভিসন্ধি, হয়তো রাজনীতি ছিল, এটা নিছক বিদ্যা ক্ষেত্রের ব্যাপার নয়। দক্ষিণকে খুশি করা প্রথমে, তার পর অন্য রাজ্যগুলোকেও খুশি করা। ভোটের রাজনীতিতে এ রকম খুশি করার ব্যাপার যে থাকে তা আমরা জানি। ভাষার প্রাচীনত্বের সীমা কমিয়ে আনা হয়েছিল, শুনেছি ১৫০০ বছরের পুরোনো হলেই চলবে এখন। নানা রাজ্য সরকার গবেষকদের লাগিয়ে একটা নথি কোনো রকমে তৈরি করে ওই ১৫০০ বছর খাড়া করে দিতে পারলেই হলো, তা হলেই কিস্তিমাত। তা বাংলা, ওডিয়া, অসমিয়া সবাই সে কিস্তিমাত করেছে। এর পরে পাঞ্জাবি, গুজরাতি, রাজস্থানি কেন পড়ে থাকবে জানি না। হিন্দিই বা নেই কেন? নাকি সরকারি ভাষা হিসাবে থেকেই সে খুশি? যাই হোক, পুরস্কৃত ভাষাগুলোর গবেষকদের এজন্য প্রচুর খাটতে হয়েছে, সন্ধান ও কল্পনা দুদিক থেকেই, আশা করি, রাজ্য সরকারগুলো তাদের যথোচিত পুরস্কার দেবে।
২.
এখন আসল কথা হলো, এ ‘ধ্রুপদি’ সম্মানে ভাষাগুলোর ওই নামের গয়না ছাড়া আর কী লাভ হলো? সেটা কেন্দ্র রাজ্য কেউ স্পষ্ট করে বলছে না। এর আগে, ১৯৬৮’র ত্রিভাষা শিক্ষানীতির প্রতিশ্রুতি হিসাবে কেন্দ্রীয় সরকার প্রত্যেক অষ্টম তফশিলের ভাষাকে এক কোটি করে টাকা দিয়েছিল, ‘মাতৃভাষায়’ শিক্ষার জন্য উচ্চশিক্ষার উপযোগী বই প্রস্তুত ও প্রকাশের জন্য। ফলে রাজ্যে রাজ্যে ‘পুস্তক পর্ষদ’ গোছের একটা সরকারি প্রকাশনা সংস্থা গড়ে উঠেছিল, তাতে প্রচুর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ক্লাসের পাঠ্যবই তৈরি হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গেও একটা পুস্তক পর্ষদ ছিল, এখন তার কী দশা জানি না। অর্থাৎ একটা ধ্রুপদি ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের একটা দায়ও তৈরি হয়ে যায়, এটা শুধু ব্যক্তিগত খেতাব দেওয়ার মতো নয়। (অবশ্য শুনেছি ‘পদ্মশ্রী’ বা ‘ভূষণ’রাও ট্রেনে প্লেনে বিনামূল্যে টিকিট পান, কথাটা সত্য কিনা জানি না, আমার এ ধরনের লোকের সঙ্গে তেমন আলাপ নেই।)।
অর্থাৎ এ ঘোষণার সঙ্গে রাষ্ট্র এ ভাষাটি সম্পর্কে একটা প্রতিশ্রুতি দেয়, একটা দায় গ্রহণ করে। সেটাই নিয়ম। প্রথমে কেন্দ্র, যারা এ ঘোষণাগুলো করে স্ফীতবক্ষ বাহবা নিচ্ছে। তাদের বলতে হবে, সে এ ভাষাটি নিয়ে সে কী করবে, এর প্রচার, প্রসার ও উন্নয়নে তার ভূমিকা কী হবে। আমি জানি না, কেন্দ্র সে কথা স্পষ্ট করে কোথাও বলেছে কিনা, গুগলে আমি তেমন কিছু পাইনি। গবেষণায় আরও টাকা দেবে? উচ্চশিক্ষায় মাতৃভাষার বই তৈরি আর ছাপায় সাহায্য করবে? নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে বা প্রতিষ্ঠানে শেখানোর ব্যবস্থা করবে? উচ্চশিক্ষায় বা শিক্ষায় বাজেট কমানোর দিকে কেন্দ্রীয় সরকারের ঝোঁক যে রকম আন্তরিক ও অনিবার্য, তাতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও কতটা রক্ষিত হবে তা বলা মুশকিল। হয়তো বেসরকারি উদ্যোগ বা পিপিপি উদ্যোগের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে বিষয়টিকে। স্পষ্ট কোনো নীতি নেই। কেন্দ্রের একটা শ্বেতপত্র হোক না এ নিয়ে।
দ্বিতীয়ত রাজ্যের দায়িত্ব। রাজ্য গবেষক নিয়োগ করে ব্যাপারটা ঘটিয়ে ফেলেছে, অর্থাৎ ভাষাটিকে ধ্রুপদি বানিয়ে ছেড়েছে, এ কৃতিত্ব নিয়ে কি বসে থাকবে? সরকারি কাজে ভাষাটির ব্যবহার বাড়াবে না? স্কুলগুলোতে এ ভাষার শিক্ষা আরও ব্যাপক করে তুলবে না? উচ্চশিক্ষায় এ ভাষার ব্যবহার যাতে আরও বাড়ে তার পরিকল্পনা করবে না? শুধু সাধারণ শিক্ষায় নয়, বাণিজ্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ডাক্তারি, আইন, কারবার-পরিচালনা-ইত্যাদি সব রকমের উচ্চশিক্ষায়? ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বা কলেজগুলোতে এ ভাষা যাতে আবশ্যিকভাবে বিষয় হিসাবে শেখানো হয়, তার নীতি প্রয়োগ করবে না?
এ ভাষা যারা বলে সেই জনসাধারণেরও কি কোনো দায়িত্ব নেই, ‘পেয়ে গেছি! পেয়ে গেছি!’ বলে নাচানাচির বাইরে? আমরা নিজেরা নিজেদের ভাষাটা ঠিকঠাক বলতে বা লিখতে কোমর বেঁধে লাগব কি? আমরা কি ইশকুল-কলেজে ইংরেজি শিখেছি বলে একটা খিচুড়ি ভাষাকে আমাদের মাতৃভাষা হিসাবে শিরোধার্য করব-ওই যাকে বলে ‘বাংলিশ?’ না শুধু বাঙালির দোষ দেব কেন? ভারতে ‘হিনলিশ’, ‘পানলিশ’, ‘তামলিশ’, ‘মারলিশ’ সবই চলে। ধ্রুপদি ভাষা অন্তত এটুকু তো দাবি করে, তার সন্তানরা ভাষাটাকে খিচুড়ি না করে ঠিকঠাক বলুক? যেখানে বলা যায়, সেখানেই বলুক। শপিংমলে-রেস্তোরাঁতে গিয়ে বলুক, ট্যাক্সিচালকের সঙ্গে বলুক, সুট-বুট-টাই পরেও বলুক।
ভাষা দেখারও ও তো ব্যাপার আছে, তাই না? কলকাতার রাস্তায় রঙে রেখায় আলোতে হাজার হাজার দোকান আর প্রতিষ্ঠানের নাম দেখি। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের গেটের মাথায়? ক-টা আমাদের এ ধ্রুপদি ভাষায়? এবারে কি এসব জায়গায় তার ব্যবহার বাড়বে? জিনিসপত্রের, ওষুধের আর অন্যান্য পণ্যের প্যাকেটের ওপরে কি আমাদের ধ্রুপদি ভাষার নাম দেখতে পাব? ডাক্তার (এখন নানাভাবেই বিপন্ন) কি বাংলাভাষায় অসুখ আর ওষুধের সুপারিশপত্র লিখতে শুরু করবেন? আরও কত কত জায়গা আছে, যেখানে নিজের ভাষার ব্যবহার করা যায়। অন্তত রাজ্যের মধ্যে ডাক চলাচলে, চিঠিতে, প্যাকেটের ওপরে ঠিকানা লেখায়, গ্রামের ব্যাংকের কাজেকর্মে, বাসের টিকিটে, গাড়ির নম্বরে, অন্তত এক জায়গায়। ধ্রুপদি ভাষা হলো বলে এখন সেখানে তার ব্যবহার হবে?
অভিভাবকরা কী করবেন? তাদের ভাষা ধ্রুপদি হয়েছে, তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ছেলেমেয়েদের এ ভাষায় শিক্ষা দেওয়া শুরু করবেন, না ‘ও ধ্রুপদি দিয়ে কি আমি ধুয়ে খাব?’ বলে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলেই পাঠাবেন? অবশ্যই তারও সিদ্ধান্ত সরকারের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করবে। সরকার যদি ‘মাতৃভাষা’ মাধ্যম স্কুলগুলোকে শক্তিশালী আর সম্ভ্রান্ত না করে, উপযুক্ত শিক্ষক দিয়ে, পরিবেশ তৈরি করে সেগুলোকে উচ্চাকাক্সক্ষী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য না করে তোলে, জরাজীর্ণ অবস্থায় মাতৃহারা সন্তানের মতো রেখে দেয়, তা হলে ধ্রুপদি ভাষা কাঙালিনি হয়েই থাকবে। ইংরেজি ভাষা ভালো করে শেখানোও চলুক না পাশাপাশি।
তাই ধ্রুপদি ভাষা শুধু একটা নাম নয়, বিশেষণ নয়, অলংকরণ নয়-একটা প্রতিশ্রুতি ও সংকল্প হয়ে আসুক। রাষ্ট্র ও রাজ্যের প্রতিশ্রুতি ও সংকল্প, ভাষাব্যবহারকারী জনসাধারণের ভাষাটিকে ঘিরে শপথ ও সংকল্প। নইলে কথাটার কোনো অর্থই দাঁড়াবে না।
পবিত্র সরকার : ভারতের খ্যাতনামা লেখক; সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়