Logo
Logo
×

সম্পাদকীয়

ছাত্র রাজনীতি কী পথ দেখাতে পারবে?

Icon

আলফাজ আনাম

প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:০০ পিএম

ছাত্র রাজনীতি কী পথ দেখাতে পারবে?

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, ২০২৪

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি জাতীয় রাজনীতিতে পরিবর্তন ও ঐক্য গঠনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্ররা। আন্দোলনে সব মত ও পথের ছাত্ররা ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। আওয়ামী রেজিমের বিরুদ্ধে দেড় দশকের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন করলেও তা সফল হতে পারেনি। এর প্রধান কারণ ছিলো রাজনৈতিক দলগুলো এক প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। কিন্তু ছাত্ররা এই অসম্ভব কাজটি সম্ভব করে তোলে। 

গণঅভ্যুত্থানে আন্দোলনরত সব রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশ নিয়েছে। তাদের পরস্পরের মধ্যে ছিলো নিবিড় যোগাযোগ। এই প্রথম আমরা দেখছি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ইসলামি ছাত্র শিবির ও বাম ছাত্র সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে ছিলো। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না রাজধানী ও আশপাশের শত শত মাদ্রাসার ছাত্র এই আন্দোলনে শরীক হয়েছে। তাদের ভূমিকা কোনো অংশে কম নয়। যে ছাত্ররা মারা গেছে তাদের বড় অংশ মাদ্রাসার ছাত্র।

 রাজপথে আমরা এমন দৃশ্যও দেখেছি, ছাত্র ফেডারেশেনের একজন নেত্রীর সাথে মিছিলে শ্লোগানে শরীক হয়েছে মাদ্রাসার ছাত্ররা। নিপীড়ক শাসকের বিরুদ্ধে এই ঐক্য আন্দোলনকে সফল করেছে। ফলে এই আন্দোলনে কোনো দল বা সংগঠনের একক কোনো কৃতিত্ব নেই। তবে জাতীয় প্রয়োজনে সবাইকে এক করার এই কৃতিত্ব অবশ্যই ছাত্রদের দিতে হবে। আরো একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে,  বিদেশে থাকা অ্যাক্টিভিস্ট ও সাংবাদিকরাও নানাভাবে এই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। সমন্বয়করা যখন আত্মগোপনে ছিলেন তাদের সুরক্ষা দিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় ও তাদের বার্তা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে তারা বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছেন।

গণঅভ্যুত্থানের পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেয়া হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাসে ফিরছেন। এরমধ্যে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন করে আলোচনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর সব ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সাথে মত বিনিময় করেছেন। সেখানে ছাত্র সংগঠনের নেতারা ছাত্র রাজনীতির পক্ষে কথা বলেছেন। এই বৈঠকে ইসলামি ছাত্র শিবিরকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সভাপতি অংশগ্রহণ করেন। যিনি একই সাথে ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেরও একজন নেতা। দীর্ঘদিন যাবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারেনি। এখন তাদের নেতাদের নাম সামনে এসেছে। অনেকে বিস্মিত হয়েছেন এ কারণে যে শিবির পরিচয় গোপন করে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। 

কোটাবিরোধী আন্দোলনের খোজঁখবর যারা রাখতেন তারা জানতেন এই আন্দোলনে শিবির ও ছাত্রদলের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিলো। সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া কোনো আন্দোলন সফল হতে পারে না। কোটাবিরোধী আন্দোলনের মতো সাধারণ ছাত্রদের সমর্থনপুষ্ট একটি আন্দোলনে বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সম্পৃক্ত হওয়া ছিলো স্বাভাবিক। সুসংহত ছাত্র সংগঠন হিসেবে শিবির এই আন্দোলনের নেতৃত্বে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। 

আন্দোলনে ছাত্র সমন্বয়কদের প্রায় পঞ্চাশ শতাংশের বেশি ছিলো শিবিরের নেতাকর্মী। হাসিনার সরকারও বিষয়টি অনুমান করতে পেরেছিলো। গোয়েন্দা রিপোর্টগুলোতে তেমন প্রতিফলনও ছিলো। ছাত্রদলও শুরু থেকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। তারেক রহমান নিজে ছাত্রদলের নেতাদের এই আন্দোলনে অংশ নিতে নানাভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন। 

পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আন্দোলন দমনের কৌশল হিসেবে আগের মতো জামায়াত-শিবির দমনের  নামে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। কিন্তু কোটাবিরোধী আন্দোলন যে ততদিনে গণআন্দোলনে রূপ নিয়েছে তা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে হাসিনা সরকার। ফলে যত বেশি মানুষ নিহত হয়েছে তত ক্ষোভের মাত্রা বেড়েছে। শেখ হাসিনার পলায়নের মাধ্যমে এই আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে।   

হাসিনার দেড় দশকের শাসনে ছাত্রলীগ যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো সেখানে ছাত্রদল ও ছাত্র শিবিরের প্রকাশ্য রাজনীতি করা তো দূরে থাক হলগুলোতে অবস্থান করা সম্ভব ছিলো না। শিবির ট্যাগ দিয়ে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীর ওপর নিপীড়ন চালানো হয়েছে। সেখানে পরিচয় গোপন রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া ছিলো এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। এরপরও বিরোধী মতের অনেক ছাত্র-ছাত্রী পরিচয় গোপনের ট্রমার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন। 

আশার কথা হলো- গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে এক ধরনের ঐক্য আমরা দেখতে পারছি। কোনো সংগঠন একক কৃতিত্ব দাবি করে কাঁদা ছোড়াছুড়িতে লিপ্ত হয়নি। সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে ছাত্রদল, শিবির, ছাত্রশক্তি ও বাম ছাত্র সংগঠনের নেতাদের এই আন্দোলনে তাদের ভূমিকা নিয়ে আমার আলোচনা করতে দেখেছি। সেখানে কোন সংগঠনের অবদান বেশি এ নিয়ে তারা বির্তক করেনি। বরং সবার কৃতিত্ব তারা স্বীকার করেছেন। সব ছাত্র নেতারা সহাবস্থান ও নতুন ছাত্র রাজনীতির কথা বলেছেন।

অনেকে ধারণা করেছিলো ছাত্র রাজনীতি বন্ধের পক্ষে শিক্ষার্থীদের অবস্থানকে শিবির সমর্থন করতে পারে। কারণ রেজিমেন্টেড ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্র রাজনীতি প্রকাশ্য না থাকলেও শিবিরের কার্যক্রমে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে না। প্রকাশ্য ছাত্র রাজনীতি সমর্থন করায় অন্য ছাত্র সংগঠনগুলোর জন্য এটি স্বস্তির কারণ হতে পারে। 

ছাত্র সংগঠনগুলোকে একটি বিষয় অনুধাবন করতে হবে, সাধারণ ছাত্রদের বড় একটি অংশ ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৯ দফার একটি ছিলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি থাকবে না। কেন এই শিক্ষার্থীরা ছাত্র রাজনীতির বিরোধী হয়ে উঠছেন এই প্রশ্নের জবাব ছাত্র সংগঠনগুলোকে খুঁজে বের করতে হবে। মোটা দাগে ছাত্র সংগঠনগুলোর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা ও সহাবস্থানে অস্বীকৃতি থেকে সংঘাতের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।  কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই দেশের ভবিষ্যত নেতৃত্ব তৈরির জন্য ছাত্র রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই। 

ছাত্র নেতারা এখন যে সহবস্থান নতুন রাজনীতির কথা বলছেন, তা এগিয়ে নিতে পারলে ভবিষ্যত বাংলাদেশকে জাতীয় ঐক্যর ওপর গড়ে তোলা সম্ভব হবে। তবে এ ক্ষেত্রে বাধা আসতে পারে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর থেকে। ৮০ ও ৯০ দশকে ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা রাজনৈতিক দলের নেতারা দলীয় ও মতাদর্শিক রাজনীতিকে সংঘাতের পথে নিয়েছিলেন। তারা বিভাজনের রাজনীতি উস্কে দিয়েছেন। হাসিনার ফ্যাসিবাদি শাসন কায়েমের আগেও প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ছাত্রদল, ছাত্রলীগ,  শিবির ও বামসংগঠনের নেতা-কর্মীরা পরস্পরের হাতে নিহত হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা সংঘাতের পরিবর্তে গঠনমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছেন। 

নব্বই  ও আশির দশকের সময়ের নেতাদের চেয়ে বর্তমান ছাত্রনেতাদের দায় অনেক বেশি। তাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে এত বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটেনি। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে স্কুল-মাদ্রাসার ছাত্র থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রাণ দিয়েছেন। একজন ফ্যাসিস্ট শাসককে পরাজিত করতে গিয়ে প্রায় এক হাজার ৪শ মানুষের প্রাণহানি, পঁচিশ হাজার মানুষ পঙ্গু ও চোখ হারানোর মতো ভয়াবহ ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। এই বিপুল মানুষের আত্মত্যাগের ডাক কিন্তু এই ছাত্রদের কাছ থেকে এসেছে। ছাত্ররা যে রাজনৈতিক সংগঠন করুক না কেন তাদের কর্মকান্ডের জন্য এসব নিহত ও আহত মানুষের রক্তের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হবে। এ দেশের মানুষ আশা করে, ছাত্ররা আগের সংঘাতময় রাজনীতিতে আর ফিরে যাবে না। কর্মসূচি ও গুনাবলির মাধ্যমে নিজেদের রাজনীতিকে সংহত করবে। কেউ আর আত্মগোপনের রাজনীতি করবে না, সবাই ভয়ভীতি হীন তার মত প্রচার করতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠুক বহু মত, পথ ও বিশ্বাসের প্রাণকেন্দ্র। তাদের যেনো লক্ষ্য হয়, নতুন ধারার ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে তারা জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারেন।  

লেখক,  সাংবাদিক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম