অর্থনীতিতে ছয় চ্যালেঞ্জ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পাঁচ কৌশল
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৩, ১০:৪৬ পিএম
২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্য ছয়টি প্রধান চ্যালেঞ্জ শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো- সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ, লেনদেনের ভারসাম্য পরিস্থিতি উন্নয়ন, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা, রিজার্ভ বাড়ানো, অপরিশোধিত তেল সংগ্রহ এবং প্রাকৃতিক গ্যাস ও আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাজেটে বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে পাঁচ ধরনের কৌশল নেওয়া হয়। এগুলো হলো- বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে শিল্প ও ব্যবসায় কম সুদে ঋণ প্রদান, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সম্প্রসারণ, মূল্যস্ফীতিকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রেখে বাজারে পর্যাপ্ত মুদ্রা সরবরাহ নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নের জন্য বাজেটে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলো স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। এতে অর্থনীতিতে যে আঘাত এসেছে সেটিও এবারের বাজেটে অকপটে বলেছেন অর্থমন্ত্রী। এগুলো মোকাবিলা করার কৌশলের কথাও বলেছেন। তবে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বাজেট ঘোষণা করা ও হিসাব মেলানো যতটা সহজ হয়েছে, বাস্তবায়ন ততটা সহজ হবে না। টেবিলে বসে হিসাব মেলানোর সঙ্গে বর্তমানের কঠিন বাস্তবতা মিলবে না।
বাজেটে বলা হয়, বৈদেশিক খাতে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। এজন্য রপ্তানির নতুন বাজার অনুসন্ধান করা হচ্ছে। একই সঙ্গে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ করা হচ্ছে। বর্তমানে ৭০টি সবজি ও ফল রপ্তানি হচ্ছে। এতে বছরে ১০০ কোটি ডলার আয় হচ্ছে। এটি আরও বাড়ানো হবে।
রেমিট্যান্স বাড়াতে প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহারে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এজন্য পদ্ধতি সহজ করার পাশাপাশি বিভিন্ন ফি ও কমিশনে ছাড় দেওয়া হয়েছে। এতে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ কমে যাবে। পাশাপাশি আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথাও বলা হয়েছে। এজন্য বেশ কিছু খাতে শুল্ক ও ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। এতে আমদানিতে চাপ কমবে। এর মাধ্যমে রিজার্ভ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পাইপলাইনে আটকে থাকা বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ছাড় করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এতে বাজেটে আশা করা হয়েছে অচিরেই দেশের রিজার্ভ বাড়তে শুরু করবে।
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার সতর্ক থাকবে। পাশাপাশি সংকুলানমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করবে। এর মাধ্যমে চাহিদা অনুযায়ী টাকার প্রবাহ বাড়ানো হবে। যাতে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে থাকে, আবার টাকার প্রবাহ বাড়ে।
বাজেটে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর আওতায় শুল্ক হার যৌক্তিকীকরণ, রাজস্ব ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ বাড়ানো, ভর্তুকি ও নগদ সহায়তা প্রত্যাহার নিয়ে এখনই কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। খাদ্য উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়াতে এবারও কৃষিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এজন্য কৃষি ও বিদ্যুতে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি ভর্তুকির পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে।
বাজেটে বলা হয়, ডলার সংকট ও ব্যাংকে তারল্য সংকট নিরসনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর মধ্যে আগামী জুলাই থেকে সুদের হারের সীমা তুলে দেওয়া হবে। ডলারের দর বাজারভিত্তিক করা হবে। এতে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় আরও প্রতিযোগিতামূলক হবে।
অর্থনীতিতে এখন আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির হার বেশি। এ হার নিয়ন্ত্রণে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের সম্প্রসারণ করা হবে। যাতে নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য বিনামূল্যে ও কম দামে খাদ্য বিতরণ করা যায়।
আমদানির বিকল্প পণ্য উৎপাদন বাড়াতেও এবার জোর দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ভোজ্যতেল আমদানি কমাতে দেশে উৎপাদনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে ১০০টি করে মোট ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৪০০টি পারিবারিক সবজি বাগান স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কৃষকদের সহজে কৃষি উপকরণ দিয়ে কার্ডধারী কৃষকের সংখ্যা বাড়ানো হবে। বর্তমানে আছে ২ কোটি। কৃষিপণ্য সংরক্ষণে আধুনিক সংরক্ষণাগার স্থাপন করা হচ্ছে।
বাজেটে বলা হয়, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ২০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এটি আরও বাড়িয়ে ২০২৫ সালের মধ্যে ৩০ লাখে উন্নীত করা হবে। ১০৯টি হাইটেক পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে ২০৩০ সালের মধ্যে ১ লাখ তরুণ-তরুণীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। হাইটেক পার্কে ২০৪১ সালের মধ্যে ২ লাখ কর্মসংস্থান হবে।
বর্তমানে ১৭৬টি দেশে ১ কোটি ৪৯ লাখ কর্মী কাজ করেন। নতুন বাজার অনুসন্ধান করা হচ্ছে। প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ফলে জনশক্তি রপ্তানি আরও বাড়বে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো পুরোপুরি চালু হলে ৪ হাজার কোটি ডলার রপ্তানি হবে।
অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বাড়ানোর জন্য কর নেট সম্প্রসারণ, কর অব্যাহতি যৌক্তিকীকরণ, স্বচ্ছ পদ্ধতিতে কর আদায়, কর প্রশাসন অটোমেশনের কথা বলা হয়েছে। কর অব্যাহতি মাত্রা ও পরিধি যৌক্তিকীকরণের জন্য একটি জরিপ করা হচ্ছে। মধ্যমেয়াদি রাজস্ব আহরণ কৌশল প্রণয়ন করা হবে।