বেসিকোর মূলধন খেয়ে ফেলছে কর্মচারীরা

আহমদ মুসা রঞ্জু, খুলনা
প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২৫, ০৭:২২ পিএম

ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ওজোপাডিকো) মালিকানাধীন বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড (বেসিকো) এখন কাগুজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। কোনো ধরনের কার্যক্রম না থাকলেও প্রতিষ্ঠানের পেছনে বছরে অযথা ব্যয় হচ্ছে কয়েক কোটি টাকা। প্রিপেইড মিটার উৎপাদনের জন্য ২০১৮ সালে বেসিকো নামে প্রতিষ্ঠানটি যৌথ মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত হয়। যার বেশির ভাগ মালিকানা ওজোপাডিকোর। প্রতিষ্ঠানটিতে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া ৪৫ জন কর্মচারীকে কোনো কাজ ছাড়াই পুষছে কর্তাব্যক্তিরা। দুর্নীতি, অনিয়ম ও অর্থ পাচারের অভিযোগে ইতোমধ্যে কোম্পানির কার্যক্রম চার বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। বেসিকো সূত্রে জানা যায়, দেশের বিদ্যুৎ গ্রাহকদের জন্য স্মার্ট মিটার সরবরাহের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো) এবং চীনের হেক্সিং ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডের যৌথ উদ্যোগে একটি স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার ম্যানুফ্যাকচারিং/অ্যাসেম্বলিং কোম্পানি গঠন করা হয়। যার নাম দেওয়া হয় বেসিকো।
এ প্রতিষ্ঠানে ওজোপাডিকো ও হেক্সিং ইলেকট্রিক্যাল ২৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে। এর মধ্যে ৫১ শতাংশ ওজোপাডিকোর, বাকি ৪৯ শতাংশ হেক্সিং ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানির। ২০২১ সালে কোম্পানির তিন কর্মকর্তার যোগসাজশে অর্থ পাচার, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে কোম্পানিটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই সময় থেকে প্রতি বছর বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় হচ্ছে।
কোম্পানি বন্ধ হলো যেভাবে : কোম্পানি শুরুর প্রথম থেকে বিভিন্ন সেবা খাত দেখিয়ে কর্মকর্তাদের একটি চক্র প্রায় ৪০ কোটি টাকা পাচারের উদ্যোগ নেয়। অর্থ পাচারের এই চক্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ওজোপাডিকোর তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকউদ্দিন, কোম্পানি সেক্রেটারি আব্দুল মোতালেব এবং বেসিকোর উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চীনের হেক্সিং ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ ইয়ে ওয়েনজুন। এ বিষয় নিয়ে দুদকও মামলা করেছে।
অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠলে ওজোপাডিকো লিমিটেড ২০২১ সালের ১৮ জুলাই বেসিকোর আয়-ব্যয় নিয়ে অডিট করে। সেখানে অনিয়মের বিষয়টি ফুটে ওঠে। কোন কোন খাত থেকে কত টাকা অনিয়ম করা হয়, সেটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে অডিট কমিটি। ওই কমিটি এই পাচার কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ওই তিনজনের নামও উল্লেখ করে। তাদের মধ্যে শফিকউদ্দিনের ওই বছরের এপ্রিলে চাকরির মেয়াদ শেষ হয়। ইয়ে ওয়েনজুন নিজ দেশে ফিরে যান। তবে আবদুল মোতালেব চাকরিতে বহাল ছিলেন। পরে অর্থ পাচারের অভিযোগে তাকে বরখাস্ত করা হয়। একই সঙ্গে ওজোপাডিকো কর্তৃপক্ষ আদালতে দুটি মামলা করে। এরপর অভিযুক্তরা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মহলে গিয়ে জোর তদবির শুরু করে। একপর্যায়ে তৎকালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর সরাসরি হস্তক্ষেপে ২০২৩ সালের নভেম্বরে ওজোপাডিকো সেই মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। ওই সময় বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহসভাপতি এবং ওজোপাডিকোর ডিজিএম মো. নাজমুল হুদা মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন। একই সঙ্গে দুদকের মামলা প্রত্যাহারের জন্যও আবেদন করেন, যা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বোর্ড মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সেই মামলার রিভিউ আবেদন করেছে ওজোপাডিকো কর্তৃপক্ষ।
মামলা প্রত্যাহারের বিষয় নিয়ে ওজোপাডিকোর বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. হায়দার আলী বলেন, যে সময় মামলা প্রত্যাহার করা হয়, সেটা বোর্ডের সিদ্ধান্ত ছিল। আব্দুল মোতালেবের একটি রিট পিটিশনের বিষয়ে আমরা এখন রিভিউ করেছি। আশা করছি, সেখানে একটা ভালো রেজাল্ট পাব।
বিপুল অর্থের অপচয় যেভাবে : প্রতিষ্ঠার পর বেসিকোতে ৪৭ জন নিয়োগ পায়। এরমধ্যে সহকারী ম্যানেজার অ্যাডমিন ও অফিস সহকারী পদ দুটিতে দুইজনকে স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হয়। বাকি ৪৫ জনকে ‘কাজ নেই মজুরি নেই’ ভিত্তিতে নিয়োগ দেয় কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে অনিয়ম এবং অর্থ পাচারের অভিযোগ ধরা পড়লে কোম্পানিটি বন্ধ হয়ে যায়। তবে নিয়োগ পাওয়া এসব কর্মচারী প্রতিমাসে বেতন তুলছেন বসে বসে। এসব কর্মচারীর পেছনে প্রতিমাসে প্রায় ১৫ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে। বছরে শুধু বেতন বাবদ খরচ হয় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এছাড়া অফিস ভাড়া, সংরক্ষণ ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে বছরে প্রায় চার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে বলে অফিস সূত্র জানিয়েছে। ২০২১ সালে কোম্পানির পরিচালন ব্যয় হয়েছে ২ কোটি ৬৬ লাখ, ২০২২ সাথে ৩ কোটি ১৬ লাখ এবং ২০২৩ সালে ১০ কোটি ১৮ লাখ টাকা। অথচ ব্যয় কমাতে এসব কর্মচারীকে বাদ দেওয়া নিয়েও ওজোপাডিকোর কোনো মাথাব্যথা নেই। দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপনের পর ২০২১ সালে এসব কর্মচারীকে বাদ দেওয়ার উদ্যোগ নেই কর্তৃপক্ষ। তবে সেসময় আব্দুল মোতালেবের ব্যাপক আওয়ামী লবিংয়ের কারণে এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, নিয়োগ পাওয়া ৪৫ জন কর্মচারীর মধ্যে ১৫ জনই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত আব্দুল মোতালেবের নিকটাত্মীয়। আব্দুল মোতালেব যখন কোম্পানির পরিচালক (অর্থ) পদে ছিলেন, তখন তিনি প্রভাব খাটিয়ে তার আত্মীয়স্বজনকে এখানে নিয়োগ দেন। বিপুল অঙ্কের অর্থের অপচয়ের বিষয়ে বেসিকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী রোকনুজ্জামান বলেন, আমি বেসিকোর এমডি হিসাবে যোগদান করেছি কিছুদিন হলো। এখনো কাজ বুঝে উঠতে পারিনি। ব্যয় কমানোর স্বার্থে কর্মচারীদের বিষয়টি নিয়ে আমি অবশ্যই ম্যানেজমেন্টকে জানাব। তারা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন। ব্যয় কমানোর বিষয়ে ওজোপাডিকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হায়দার আলী বলেন, কোম্পানি বন্ধ রয়েছে। আমরা পরবর্তী বোর্ড মিটিংয়ে ব্যয় কমাতে করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।