বেক্সিমকো সুকুক বন্ডের তদন্ত প্রতিবেদন জমা নিয়ে গড়িমসি

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২৫, ০৭:০০ পিএম

দেশের পুঁজিবাজারে গত ১৬ বছরের অনিয়ম, দুর্নীতি ও কারসাজির ঘটনা খতিয়ে দেখতে পাঁচ সদস্যের একটি অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ৫ জনের কমিটিতে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট দুই ব্যক্তিও রয়েছেন।
ছাত্র জনতার গণঅভ্যত্থানে হাসিনার পতনের পর গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর এই কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে ৬০ দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। বেধে দেওয়া সময় পেরিয়ে গেলেও এখনও সর্বাধিক আলোচিত অনিয়ম ও পুকুরচুরিগুলো নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়েনি। বিশেষ করে বেক্সিমকো সুকুক বন্ডের তদন্ত রিপোর্ট জমা নিয়ে তদন্ত কমিটির কালক্ষেপণ পরিলক্ষিত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিএসইসি থেকে জানানো হয়, টেরা রিসোর্সেস ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জিয়া ইউ আহমেদের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন—ইয়াওয়ার সাঈদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য মো. শফিকুর রহমান, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. জিশান হায়দার এবং বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মো. আনোয়ারুল ইসলাম।
তদন্ত কমিটি যে ১২ টি বিষয় খতিয়ে দেখার কথা; তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে— বেক্সিমকো গ্রিন-সুকুক বন্ড সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়াদি, আইএফআইসি গ্রানটিড শেরপুর টাউনশিপ গ্রিন জিরো কুপন বন্ড ইস্যু ডকুমেন্ট, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের কেৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসাবে বসুন্ধরা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এবিজি লিমিটেডের অনুমোদন, মনোনয়ন ও শেয়ার বরাদ্দকরণ, বেস্ট হোল্ডিংসের আইপিও অনুমোদন, আল-আমিন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের যাবতীয় অনিয়ম ও কারসাজি, ব্লক মার্কেটে শেয়ার অধিগ্রহণ সংক্রান্ত কারসাজি এবং ওটিসি থেকে এসএমই প্লাটফরমে স্থানান্তরের জন্য বিএসইসিসংক্রান্ত শর্ত পালন, সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলসের অনিয়ম ও কারসাজি এবং ২০২০ সালে কোম্পানিটিকে ওভার-দ্য-কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেট থেকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান বোর্ডে পুনরায় তালিকাভুক্তকরণ সংক্রান্ত অনিয়ম এবং কোম্পানিটির শেয়ারমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত।
এছাড়া শেয়ারবাজারে ফরচুন সুজের যাবতীয় অনিয়ম ও কারসাজি, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে লভ্যাংশ বিতরণসংক্রান্ত অনিয়ম এবং কোম্পানিটির শেয়ারমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করার কথা এই কমিটির। রিং শাই টেক্সটাইলের মূলধন সংগ্রহ আর্থিক প্রতিবেদন অতিরঞ্জিত করে বিক্রয় বেশি দেখানো এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর/পাচার বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত। একমি পেস্টিসাইডসের যাবতীয় অনিয়ম ও কারসাজি, আইপিও'র মাধ্যমে উত্তোলিত টাকা থেকে ন্যাশনাল ফাইন্যান্সের ঋণ পরিশোধের অনিয়মের বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারের অনিয়মের তদন্তে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে তার অন্যতম এজেন্ডা হচ্ছে সুকুক বন্ড।অভিযোগ উঠেছে এই কমিটির অন্যতম এক সদস্যের প্রতিষ্ঠান সুকুক বন্ডের বিনিয়োগকারী, এমতাবস্থায় সঠিক তদন্ত হওয়া নিয়ে বেড়েছে জটিলতা। উল্লেখ্য, ২/৩টি কোম্পানীর তদন্ত রিপোর্ট জমা পড়লেও ৩০০০ কোটি টাকার বেক্সিমকো সুকুক বন্ডের তদন্ত রিপোর্ট এখনও জমা হয়নি। এই দীর্ঘসূত্রিতায় বেড়েছে সঠিক তদন্ত প্রতিবেদন জমা নিয়ে সংশয়।
মিউচুয়াল ফান্ডের বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ উপেক্ষা করে ইউনিয়ন ক্যাপিটালের মত খেলাপি প্রতিষ্ঠানে আমানত রাখে তদন্ত কমিটির ওই সদস্যের প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ইউনিয়ন ক্যাপিটালের লোকসান হয়েছে ৬২৮ কোটি টাকা। অনেক ক্ষেত্রে আমানতকারীর অর্থ যথাসময়ে ফেরত দিতে পারছে না ইউনিয়ন ক্যাপিটাল। এই আমানতের বিপরীতে ওই প্রতিষ্ঠানের মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো নিয়মিত মুনাফা পেয়েছে কিনা তা তদন্তের প্রয়োজন।
ওই সদস্যের পুঁজিবাজার তদন্ত কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে ড. মাহমুদ ওসমান ইমাম, ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন বাজার বিশেষজ্ঞ ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন।
২০১০ সালে শেয়ার বাজার ধসের পর এম খায়রুল হোসেন ও শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম বিএসইসির চেয়ারম্যান থাকাকালে বড় ধরনের অনিয়ম ঘটে। দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক খায়রুল হোসেন বিএসইসিতে সবচেয়ে বেশি সময় দায়িত্ব পালন করা চেয়ারম্যান।
শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক। তিনি ২০২০ সালে বিএসইসি চেয়্যারম্যান হিসাবে চার বছরের জন্য নিয়োগ পান। প্রথম দফায় মেয়াদ শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় মেয়াদে আবারও চার বছরের জন্য নিয়োগ পেয়েছিলেন। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১০ আগস্ট তিনি পদত্যাগ করেন।
এই দুই কমিশনের সময় পুঁজিবাজারের বিভিন্ন অনিয়ম হলেও কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দুর্বল কোম্পানির আইপিও অনুমোদনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা মূলধন উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
এতে পুঁজিবাজারের সার্বিক উন্নয়ন তো হয়নি, বরং শেয়ার কারসাজি ও অনিয়মের কারণে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীর আস্থা নষ্ট হয়েছে বলে অভিযোগ বাজারসংশ্লিষ্টদের।
বেক্সিমকোর ৩ হাজার কোটি টাকার সুকুক বন্ড
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো লিমিটেডকে শরিয়াহভিত্তিক সুকুক বন্ডের মাধ্যমে ৩ হাজার কোটি টাকা মূলধন উত্তোলনের সুযোগ দিয়েছে কমিশন।
দেশে প্রথমবারের মতো চালু করা নতুন আর্থিক উপকরণ সুকুক বন্ডে বিনিয়োগ করতে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করা হয়েছিল।
এর আগে ২০২১ সালে বেক্সিমকো তাদের দুটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রে অর্থায়ন ও টেক্সটাইল বিভাগের সম্প্রসারণের জন্য ৩ হাজার কোটি টাকার সুকুক বন্ড ছাড়ে।
পরে বেক্সিমকো বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যবহার করে একটি সার্কুলার জারি করিয়ে নেয়। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজারের বিশেষ তহবিল থেকে সুকুক বন্ডে বিনিয়োগ করার অনুমতি দেওয়া হয়, যা পুঁজিবাজারের এক্সপোজার থেকে বাদ দেওয়া হবে।
ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো তাদের মূলধনের ২৫ শতাংশ স্টকে বিনিয়োগ করতে পারে।
কিন্তু গত জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে সালমান এফ রহমান তার নতুন রিয়েল এস্টেট কোম্পানি শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেডের (এসটিএল) অনুকূলে ১ হাজার কোটি টাকার 'আইএফআইসি আমার বন্ড' ইস্যু করিয়ে নেন। আমার বন্ডের গ্যারান্টি দিয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক। সালমান রহমান আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যানও।
বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং পরে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া সালমান গত ১৩ আগস্ট গ্রেফতার হন। ব্যক্তিগত লাভের জন্য তার সরকারি পদের ব্যবহার নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেন সালমান।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ–অভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়। এরপর পদত্যাগ করেন বিএসইসির তৎকালীন চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম। শিবলীর বিদায়ের পর ১৯ আগস্ট নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে বিএসইসিতে যোগ দেন সাবেক ব্যাংকার খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদানের পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, বিএসইসির ১০-১৫ বছরে দুই চেয়ারম্যানের সময়কালে শেয়ারবাজারে যেসব অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, নিরপেক্ষ কমিটির মাধ্যমে সেগুলোর তদন্ত করা হবে। তিনি এ–ও জানান, সব তদন্ত একসঙ্গে না করে ধাপে ধাপে সুনির্দিষ্ট বিষয় ধরে ধরে এই তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হবে। তারই অংশ হিসেবে কমিশন সভায় প্রথম ধাপে ১২ প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু সেই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন জমা নিয়ে দীর্ঘসূত্রিতা নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।