নিজেই উদ্যোগী হয়ে ব্যাংক দখলে সহায়তা করেন রউফ

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:০৪ পিএম

আব্দুর রউফ তালুকদার।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতে রীতিমতো ‘লুটপাটের মহোৎসব’ হয়েছে। একসঙ্গে এত ব্যাংক লুট বিশ্বের কোথাও হয়নি। নজিরবিহীনভাবে পাচার হয়েছে এসব টাকার সিংহভাগ। আশঙ্কাজনভাবে বেড়েছে খেলাপি ঋণ। এতে অতি মাত্রায় দুর্বল হয়ে পড়েছে গোটা ব্যাংক খাত। এরপর থেকেই দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে শুরু হয় ‘রক্তক্ষরণ’। যা এখনো অব্যাহত। আব্দুর রউফ তালুকদারের সময়ে অর্থনীতি ও ব্যাংকে নজিরবিহীন লুটপাট ও টাকা পাচারের ঘটনা ঘটে। এমনকি তিনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে ব্যাংক দখলে সহায়তা করেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসাবে ২০২২ সালের ১২ জুলাই নিয়োগ পান আব্দুর রউফ তালুকদার। আওয়ামী লীগের শাসনামলের শেষ গভর্নর ছিলেন তিনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব নিয়ে তিনি নানা প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো, তারল্য সংকটের সমাধান করা এবং খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা। কিন্তু পরিস্থিতি হয় উলটো।
খেলাপি ঋণ কমেনি, বরং তা বেড়ে রেকর্ড হয়েছে। তারল্য সংকট বেড়েছে। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা না ফিরে বরং ব্যাংক দখল ও ডাকাতি হয়েছে। আর এ সুযোগ করে দিয়েছেন স্বয়ং গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এজন্য তিনি ব্যাংকগুলোর প্রচলিত নীতিমালা শিথিল করে লুটপাটের সুযোগ করে দেন। এতেই তিনি ক্ষান্ত হননি।
লুটপাটের কারণে দুর্বল হওয়া ব্যাংকগুলোয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে বেপরোয়াভাবে ঋণ দেওয়া হয়েছে। সরকারকে লাগামহীনভাবে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। তার আমলেই সবচেয়ে বেশি ছাপানো টাকা বাজারে ছাড়া হয়েছে। নিজে উদ্যোগী হয়ে একটি ব্যাংককে দখলদারের হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
এছাড়া সুদের হার ও ডলারের দাম নির্ধারণে ঘনঘন নীতির বদল করে অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিলেন। অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা রক্ষায় তার দেওয়া কোনো প্রতিশ্রুতিই বাস্তবায়ন হয়নি। ব্যাংক লুটেরাদের প্রতি গভর্নরের নৈতিক, নীতিগত ও প্রত্যক্ষ সমর্থন এ খাতে বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। আব্দুর রউফ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রকাশ্যে আসেননি। তার অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে তিনি আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আসার সাহস পাননি। আড়ালে থেকেই পদত্যাগ করেছেন।
তার দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র ৬ দিনের মধ্যে ১৮ জুলাই একটি সার্কুলার জারি করে খেলাপি ঋণ নবায়নের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে খেলাপি ঋণ দীর্ঘমেয়াদে নবায়নের পাশাপাশি ডাউন পেমেন্টর হারও কমানো হয়। আগে যেখানে সর্বনিু ১০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নেওয়া হতো, ওই নীতিমালায় আড়াই থেকে সর্বোচ্চ ৭ শতাংশে নেওয়ার বিধান করা হয়। বড় অঙ্কের খেলাপিদের ডাউন পেমেন্টর হারও কামনো হয়।
আগে খেলাপি ঋণ তিন দফা নবায়ন করা যেত। ওই সার্কুলারের মাধ্যমে চার দফা নবায়ন করার বিধান করা হয়। কিন্তু এ বিধান পালিত হয়নি।
২০২২ সালের ১৬ নভেম্বর জারি করা এক সার্কুলারে বলা হয়, ব্যাংকগুলো ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে তহবিল ব্যবস্থাপনার ব্যয়ের সমান অর্থের চেয়ে বেশি অর্থ মওকুফ করতে পারবে। এর মাধ্যমে ব্যাংকের খরচের টাকা না তুলেই বাড়তি সুদ মওকুফের সুযোগ দেওয়া হয়। এতে ব্যাংকের আয় কমেছে, দুর্বল হয়েছে ব্যাংক। লাভবান হয়েছেন প্রভাবশালী গ্রাহক।
ব্যাংকগুলোর দুর্বলতার মধ্যেও ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও বড় গ্রাহকদের একাধিকবার বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়। এতেও ব্যাংক দুর্বল হয়েছে, লাভবান হয়েছেন প্রভাবশালী গ্রাহক।
আব্দুর রউফ তালুকদারের সময়ে ব্যাংক খাতে সব সূচকে অবনতি ঘটেছে। লুটপাট হয়েছে বেপরোয়া গতিতে। টাকা পাচার ও খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তারল্য সংকট প্রকট হয়েছে। ডলার সংকটে পুরো অর্থনীতি নাকাল হয়েছে। কমেছে টাকার মান। বেড়েছে মূল্যস্ফীতি।
রউফ যোগ দেওয়ার আগে ২০২২ সালের ৩০ জুন খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকায়।
আব্দুর রউফ তালুকদারের সময়ে ব্যাংক খাতে ঋণের নামে এমনভাবে লুটপাটের সুযোগ দেওয়া হয়েছে যে ওই সময়ে বিতরণ করা ঋণের সিংহভাগই পাচার হয়ে গেছে।
সুদের হার নিরূপণের ক্ষেত্রেও রউফ পরিস্থিতিকে বিশৃঙ্খল করে গেছেন। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে স্মার্ট রেট চালু করা হয়। এতে সুদের হার মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়। ২০২৪ সালের ৮ মে স্মার্ট রেট প্রত্যাহার করে বাজারভিত্তিক সুদহার চালু করা হয়। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। একই অবস্থা করে যান ডলারের বাজারে।
অর্থনৈতিক সংকটে দক্ষ ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ হয়ে সরকারকে নজিরবিহীনভাবে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়া হয়। ২০২২ সালের ৩০ জুন ছাপানো টাকায় সরকারের ঋণের স্থিতি ছিল ৬০ হাজার কোটি টাকা। গত ৩১ জুলাই স্থিতি বেড়ে ১ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা হয়। আলোচ্য সময়ে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়া হয়েছে ৯৭ হাজার কোটি টাকা।