মুদ্রানীতি ঘোষণা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রাধান্য
ব্যাংক ঋণে চড়া সুদের ধারা অপরিবর্তিত

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে (জানুয়ারি-জুন) নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এবারের মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়নি। তবে এ হার না কমিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের বিদ্যমান হার অপরিবর্তিত রাখার বার্তা দিয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর আগের লক্ষ্যমাত্রা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। তবে কমানো হয়েছে সরকারি খাতের ঋণের প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা। এ কারণে অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা সামান্য কমানো হয়েছে। এতে মূল্যস্ফীতিতে চাপ কিছুটা হলেও কমবে। তবে বাজারে টাকার জোগান বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা আগের মতো অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগের মতো মুদ্রানীতিতে সংকোচনমুখী ধারাই অনুসরণ করেছে।
সোমবার বিকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান ভবনের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স কক্ষে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহার, ড. হাবিবুর রহমান, জাকির হোসেন চৌধুরি, ড. কবির আহমদ, বিএফআইইউ-এর প্রধান এএফএম শাহীনুল ইসলাম, গবেষণা বিভাগের নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র, সহকারী মুখপাত্র প্রমুখ।
এদিকে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে ঋণের চড়া সুদ অব্যাহত রাখার কৌশলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। তারা বলেছেন, মুদ্রানীতি ব্যবসার পরিবেশকে বাধাগ্রস্ত করবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আরও সংকুচিত করে ফেলবে। ব্যবসা বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। বিদ্যমান ব্যবসা-বাণিজ্য চলমান রাখতে খরচ আরও বেড়ে যাবে।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, নীতি সুদের হার না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সঠিক। তবে শুধু বাড়তি নীতি সুদের হার বজায় রেখে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এলে চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংক ঋণের নীতি সুদহার কমানো শুরু হবে। ২০২৪ ও ২০২৫ সাল বিনিয়োগ বৃদ্ধির বছর নয়। বিনিয়োগ বৃদ্ধির আশা দূরের কথা, স্বপ্নও দেখি না। এখন প্রধান লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি কামানো। আশা করছি, জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে নেমে আসবে। তখন ধীরে ধীরে নীতি সুদহার কমানো হবে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার আগের মতো ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এ হার কমানো বা বাড়ানো হয়নি। ফলে বাজারে ঋণের চড়া সুদের হার চলমান থাকবে। এতে ব্যবসায় খরচ বেড়ে যাবে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ, বৈদেশিক সম্পদ কতটুকু বাড়বে বা কমবে, এর একটি পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বছরে দুবার (জানুয়ারি-জুন ও জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের জন্য) মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। এবার জানুয়ারি-জুন মেয়াদের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হলো। ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি আগের মতোই ৯ দশমিক ৮ শতাংশ রাখা হয়েছে। তবে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। এদিকে গেল ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ১০ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৭ দশমিক ৫০ শতাংশ লক্ষ্য ঠিক করেছে। আগে এ খাতে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ। এ খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা কমানো হয়েছে।
আগে অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে এ লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে সাড়ে ১১ শতাংশ করা হয়েছে। এ খাতে প্রবৃদ্ধি সামান্য কমানো হয়েছে। এতে ঋণপ্রবাহ কিছুটা কমবে। ফলে মূল্যস্ফীতিতে কিছুটা হলেও চাপ কমবে।
দেশের নিট অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি করা হয়েছে। আগের মুদ্রানীতিতে জুন পর্যন্ত এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে তা বাড়িয়ে সাড়ে ৮ শতাংশ করা হয়েছে। পাশাপাশি বৈদেশিক সম্পদ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে। আগের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছিল পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়। যে কারণে এ খাতে অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ খাতে ওই সময়ে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে। এ কারণে এ খাতের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে বাস্তবভিত্তিক করা হয়েছে। নিট বৈদেশিক সম্পদ ৭ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
এদিকে মুদ্রানীতির মূল উপকরণ টাকার প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা আগের মতো ৮ দশমিক ৪ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। কিন্তু গত ডিসেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। যে কারণে এ খাতে লক্ষ্যমাত্রা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতির হার কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকার প্রবাহ বাড়াবে না। যে কারণে মুদ্রানীতির সংকোচনমুখী ধারা বজায় রাখা হয়েছে।
মুদ্রানীতিতে খেলাপি ঋণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, এ হার বেড়ে ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে ব্যাংক খাতে চাপ বাড়বে। খেলাপি ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তর্জাতিক মানের পদ্ধতি অনুসরণ করবে। ফলে আগামী দিনে এ ঋণের হার কমে আসবে বলে মুদ্রানীতিতে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
একাধিকবার নীতি সুদহার বাড়ানোর পরও মূল্যস্ফীতি কাঙ্ক্ষিত হারে না কমার কারণ জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, চাইলেই বাংলাদেশ ব্যাংক সব করতে পারবে না। দেশে এখনো রাজনৈতিক অস্থিরতা রয়েছে। তাই সময় লাগছে। যে কোনো সিদ্ধান্তের ফল আসতে ছয় থেকে ১২ মাস সময় লাগে। আর কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়ার জন্য ১৮ থেকে ২৪ মাস প্রয়োজন হয়। তাই আমরা আশা করছি, আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ থেকে ৮ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে দেশের মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশে নেমে আসবে।
এদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার স্থিতিশীল করা এবং রিজার্ভ বাড়ানোকে প্রধান চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় গত বছরের ১৮ জুলাই চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওটা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ মুদ্রানীতি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেওয়াজ অনুযায়ী সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হতো। কিন্তু রেওয়াজ ভেঙে নজিরবিহীনভাবে কোনো সংবাদ সম্মেলন না করে শুধু ওয়েবসাইটে মুদ্রানীতির ঘোষণা করা হয়। ব্যাংক খাতের বিভিন্ন অনিয়ম-জালিয়াতির তথ্য আড়াল করতে তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার ধারাবাহিকতায় এমন পদক্ষেপ নেন।
মুদ্রানীতির প্রশ্নোত্তর পর্ব : প্রশ্নোত্তর পর্বে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, এস আলমসহ বড় কয়েকজন ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে কে কত টাকা নিয়েছেন, তা তারা নিজেরাও জানেন না। আমরাও এখনো পুরোটা জানতে পারিনি। তবে ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান যাচাই শুরু হয়েছে। পাশাপাশি ফরেনসিক নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এতে বেরিয়ে আসবে কে কত টাকা নিয়েছেন, সুবিধাভোগী কারা ছিল।
এস আলমসহ ১০ বা ১১টি শিল্প গ্রুপ ও শেখ পরিবার নিয়ে যৌথ তদন্ত হচ্ছে, তারা আসলে কত টাকা নিয়েছে? জবাবে গভর্নর বলেন, প্রাথমিক হিসাবে এস আলম একাই ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা নিয়েছেন। তবে আসলে কত টাকা নিয়েছেন তা তাকে জিজ্ঞাসা করলেও বলতে পারবেন না। জাভেদ (সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ) বিদেশে সাড়ে ৩০০ বাড়ি কিনেছেন। এত বাড়ির ঠিকানা তিনি নিজেও বলতে পারবেন না।
সংকটে পড়া ব্যাংকগুলো সম্পর্কে গভর্নর বলেন, তাদের তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে, প্রয়োজনে আরও দেওয়া হবে। ইসলামী ব্যাংক ও ইউসিবি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাদের আর সহায়তার প্রয়োজন হবে না। আমানতকারীদের স্বার্থ দেখা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ, সেটা করা হচ্ছে। শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও বাংলাদেশ কেন পারছে না এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়ে পড়েছিল। খাবার ও তেলের জন্য সেখানে লাইন পড়েছিল। বাংলাদেশ সেই পরিস্থিতিতে পড়েনি। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা চলে না। বাংলাদেশের চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাব ইতিবাচক। বিনিময় হার স্থিতিশীল, রিজার্ভও বাড়ছে।
অনিয়মে জড়িত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, কী অনিয়ম হয়েছে, তা সবাই জানি। কে সহায়তা করেছে, তা খুঁজে সময় নষ্ট করতে চাই না। ব্যাংক খাতের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি জোরদার করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যাতে ভবিষ্যতে খারাপ ঋণ আর বিতরণ না হয়। অনিয়মের ঋণ উদ্ধারে দেশি-বিদেশি সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। পাচার করা অর্থ উদ্ধারে কাজ চলছে। ডলারের দাম কবে বাজারভিত্তিক হবে, জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, এখনো সে সময় আসেনি। এখনো ডলারের দাম বাড়ানোর জন্য কিছু মধ্যস্বত্বভোগী কাজ করে যাচ্ছে। তারা প্রবাসীদের ডলার কিনে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমরা ব্যাংকগুলোকে বলে দিয়েছি তাদের থেকে ডলার না কেনার জন্য। ডলারের দাম মধ্যস্বত্বভোগীরা ঠিক করতে পারে না, এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঠিক করবে।
ব্যাংক পরিচালকদের বিষয়ে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, স্বতন্ত্র পরিচালকদের একটা তালিকা করা হবে। সেখান থেকে পরিচালক নিয়োগ করতে হবে। অর্ধেক পরিচালক স্বতন্ত্র হওয়া উচিত। ২ শতাংশ শেয়ার দিয়ে পরিচালক হওয়া বন্ধ ও পরিচালকদের মেয়াদ কমিয়ে আনা দরকার। এ জন্য আইন পরিবর্তনের প্রস্তাব করব।