Logo
Logo
×

অর্থনীতি

বড় ঋণখেলাপিদের নিয়ে মিথ্যা রিপোর্ট দিচ্ছে ৫ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক

মিজান চৌধুরী

মিজান চৌধুরী

প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:২৬ এএম

বড় ঋণখেলাপিদের নিয়ে মিথ্যা রিপোর্ট দিচ্ছে ৫ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক

ঋণের জন্য সরকারের দেওয়া গ্যারান্টির মেয়াদ পার হয়ে গেছে অনেক আগে। এরপরও প্রতিষ্ঠানটির খেলাপিসংক্রান্ত তথ্য দীর্ঘদিন ফাইলচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে, ঋণখেলাপি ঘোষণা করা হচ্ছে না। উলটো সরকারি সুবিধায় তাদের ঋণ অশ্রেণিকৃত করে রাখা হয়েছে। বড় অঙ্কের এই খেলাপিকে ‘স্বাভাবিক ঋণ’ হিসাবে উল্লেখ করে পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক মিথ্যা রিপোর্ট দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআইবিতে। কাজটি করতে গিয়ে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও কৃষি ব্যাংক মূলধন সংকট, প্রভিশন ঘাটতিসহ নানা সংকটে পড়ছে। 

একই সঙ্গে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের (ব্যাংক) সুনাম ক্ষুণ্নসহ ব্যবসার বাড়তি ব্যয় গুনতে হচ্ছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই সরকারি প্রতিষ্ঠানটির ঋণখেলাপির এ তথ্য ধামাচাপা দেওয়া হয়। ঋণ নেওয়ার পর সংস্থাটি কীভাবে খেলাপি হয়েছে এ বিষয়ে বিএফএসআইসি’র কাছে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। 

সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে (এফআইডি) অবহিত করা হয়।

এদিকে মেয়াদোত্তীর্ণের পরও বিপুল অঙ্কের ঋণকে ‘স্বাভাবিক ঋণ’ হিসাবে দেখানোর ব্যাখ্যা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কাছে তলব করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআইবি। রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

এ প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গত মঙ্গলবার যুগান্তরকে জানান, বিএসএফআইসির চিঠি বা প্রতিবেদনটি এখনো আমার কাছে আসেনি। দেখার পর এ বিষয়ে কথা বলা যাবে।

এ বিষয়ে জানতে রোববার বিএফএসআইসি নিজ কার্যালয়ে গিয়ে চেয়ারম্যান ড. লিপিকা ভদ্রের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তিনি দেখা করতে সম্মতি দেননি। তার পিএসের মাধ্যমে এ প্রতিবেদককে জানিয়ে দেন বিষয়টি তিনি বোঝেন না, তার কোনো মতামত নেই। এর আগে গত শুক্র ও শনিবার তার মোবাইলে একাধিকবার ফোন এবং বার্তা দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। অথচ এ বিষয়টি নিয়ে তিনি গত ২৩ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে ১২ পৃষ্ঠার বিস্তারিত প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন, যা যুগান্তরের হাতে আছে।

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩২টি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপির অঙ্ক ১৮৩ কোটি টাকা। বর্তমান হিসাবে এ অঙ্ক আরও বাড়বে। তবে গোপন করা খেলাপি ঋণের অঙ্ক যোগ হলে তা প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানে বকেয়া ঋণের অঙ্ক ৬৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকা।

ঋণখেলাপি হওয়ার পরও তা অশ্রেণিকৃত ঋণের তালিকায় রাখার কারণে এটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে মনে করছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, এখানে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষ কোনো মহলের চাপ আছে কি না, কেন এমন সীমাহীন ঋণ গ্রহণ করা হয়েছিল সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সুবিধা পেয়েছে কি না বা পদ সুবিধা অর্জন করেছে কি না সেজন্য ব্যাংকের জবাবদিহিতা থাকা দরকার। যোগসাজশে হোক, বিশেষ মহলের চাপে হোক ঋণের এই অব্যবস্থাপনা দীর্ঘদিন অব্যাহত ছিল। এখন নিরপেক্ষ পারফরম্যান্স অডিটের মাধ্যমে নিরীক্ষা করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার বলে আমি মনে করি।

সূত্রমতে, চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের কাছে পাঁচ ব্যাংকের পাওনা ঋণের সুদসহ ১০ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংক পাবে ৬৩৩৩ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের ১৮৮৭ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ১০৭৭ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ১২০৮ কোটি এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের পাওনা প্রায় ১৫ কোটি টাকা।

মূলত ক্ষেত্রবিশেষ সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার সময় অর্থ মন্ত্রণালয় গ্যারান্টি দিয়ে থাকে। উল্লিখিত ১০ হাজার ৫১৯ কোটি টাকার ঋণ ইস্যুর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে গ্যারান্টি দিয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বিএসএফআইসি। এই গ্যারান্টি পেয়ে ব্যাংকগুলো ঋণ ইস্যু করেছে। এর মধ্যে ৬টি রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি দেওয়া হয় সোনালী ব্যাংককে, ৪টি দেওয়া হয় জনতা ব্যাংককে। এ ছাড়া অগ্রণী ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে একটি। আর রূপালী ব্যাংক ঋণ দিয়েছে বিএসএফআইসির গ্যারান্টি পেয়ে। আর ত্রিপক্ষীয় চুক্তির ভিত্তিতে ঋণ ইস্যু করেছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। এসব গ্যারান্টির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের কথা। অথচ সোনালী ব্যাংককে দেওয়া ঋণের বিপরীতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের গ্যারান্টি মেয়াদোত্তীর্ণ হয় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। একইভাবে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মেয়াদ শেষ হয় জনতা এবং অগ্রণী ব্যাংকের। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ৯ মার্চ গ্যারান্টির মেয়াদ শেষ হয়েছে রূপালী ব্যাংকের। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১০ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায় বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের গ্যারান্টি। কিন্তু এরপরও এসব ঋণ পরিশোধ করা হয়নি।

সূত্রমতে, ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে নতুন করে গ্যারান্টি চেয়ে চিঠি দেওয়া হয় অর্থ মন্ত্রণালয়কে। তবে ওই চিঠিগুলোর কোনো জবাব মেলেনি। ফলে ব্যাংকের হিসাবে এসব ঋণ এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান বিবেচনায় ঋণকে খেলাপি না দেখিয়ে এখনো স্বাভাবিক ঋণ হিসাবে দেখানো হচ্ছে।

এই ঋণ প্রসঙ্গে সোনালী ব্যাংকের এমডি এবং সিইও মো. শওকত আলী খান সম্প্রতি চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনে পাঠানো একটি চিঠিতে বলেছেন, বিপুল অঙ্কের এই ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। এতে প্রভিশন ঘাটতি অনেক বেড়ে ব্যাংকের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে একদিকে ব্যাংকের মুনাফায় নেতিবাচক প্রবাহ চলছে, অন্যদিকে মূলধন ঘাটতির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এ ঋণ। রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি ও ত্রিপক্ষীয় চুক্তি থাকায় এই ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও অশ্রেণিকৃত রাখা হয়েছে। তবে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি) ব্যাংকের পক্ষ থেকে পাঠানো রিপোর্টে এই ঋণকে খেলাপি হিসাবে না দেখিয়ে অশ্রেণিকৃত হিসাবে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু শ্রেণিকৃত ঋণকে অশ্রেণিকৃত হিসাবে রিপোর্ট পাঠানোর জন্য ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা তলব করেছে সিআইবি।

বিএসএফআইসির ঋণ প্রসঙ্গে রূপালী ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলেছে, এই ঋণের কারণে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাংকের সুনাম ক্ষুণ্নসহ ব্যবসায়িক ব্যয় বেড়েছে। কারণ সরকারি প্রতিষ্ঠান বিবেচনায় এই ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণের পরও অশ্রেণিকৃত রাখা হচ্ছে। এতে বিপুল অঙ্কের প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে এদিকে বাড়ছে প্রভিশন ঘাটতি, অন্যদিকে মূলধন সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

সূত্রমতে, সরকারি প্রতিষ্ঠানের এই ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জনতা ব্যাংকও। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এই ঋণের বিপরীতে রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি ও ত্রিপক্ষীয় চুক্তি থাকায় ঋণ হিসাবসমূহ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সরকারি প্রতিষ্ঠান বিবেচনায় অশ্রেণিকৃত রাখা হয়। এছাড়া সিআইবিতে অশ্রেণিকৃত হিসাবে রিপোর্ট করা হচ্ছে। ঋণসমূহ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া এবং রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টির মেয়াদ ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর উত্তীর্ণ হয়। এতে ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি বিপুল পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

অগ্রণী ব্যাংকের প্রতিবেদনেও উঠে আসছে একই কথা। তাদের প্রতিবেদনেও বলা হয়, সরকারি প্রতিষ্ঠান বিবেচনায় অশ্রেণিকৃত হিসাবে রাখা হয়েছে চিনি ও খাদ্যশিল্পের এক হাজার ৭৭ কোটি টাকার ঋণ। যদিও অনেক আগেই এটি শ্রেণিকৃত হয়ে পড়েছে। তবে সিআইবিতে এই ঋণকে অশ্রেণিকৃত হিসাবে রিপোর্ট করায় ব্যাংকের কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই মত দিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকও।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম