‘গত ১৫ বছরে চামচা পুঁজিবাদ চোরতন্ত্রের জন্ম দিয়েছে’
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৮ পিএম
বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে চামচা পুঁজিবাদ চোরতন্ত্রের জন্ম দিয়েছে। ফলে উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশ অর্থ তসরুপ হয়েছে। নানা খাতে ব্যাপত লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। সেই সঙ্গে দেশের ১০ শতাংশ মানুষ ৮৫ শতাংশ সম্পদ ভোগ করছে। শুধু দারিদ্র্যই নয়; সম্পদ ভোগের ক্ষেত্রেও বৈষম্য তৈরি হয়েছে। পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে দুর্নীতির বিষবৃক্ষ রোপন হয়েছে। সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি করেছেন পোশাক ছাড়া আমলারা। দ্বিতীয় অবস্থানে রাজনীতিক ও তৃতীয অবস্থানে ব্যবসায়ীরা। এতদিন আশংকা থাকলেও ইতোমধ্যেই বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপসহ নানা কারণে মধ্য আয়ের ফাঁদে পড়েছে দেশ।
অর্থনীতির শ্বেতপত্র কমিটির পক্ষ থেকে এসব কথা বলা হয়েছে। সমস্যা উত্তরণে ইতোমধ্যে ৬টি সুপারিশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
সোমবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন শ্বেতপত্র কমিটি সংবাদ সম্মেলনে এসব বিষয় তুলে দরা হয়। এতে মূল বক্তব্য দেন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সঙ্গে অন্যান্য সদস্যরাও তাদের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন। গত রোববার (১ ডিসেম্বর) বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তিন মাসের অনুসন্ধান শেষে তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করেছেন। এর আগে দেশের অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে অন্তর্বর্তী সরকার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকারের সময়ে গড়ে প্রতি বছর ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে প্রতিটি খাতে লুটপাট ও দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। কমিটির সদস্য ড. এ কে এনামুল হক বলেন, দেশের উন্নয়ন প্রকল্প মোট ব্যয়ের ৪০ শতাংশ ব্যয় তসরুপ বা লুটপাট করা হয়েছে।
কমিটির সদস্য ড. আবু ইউসুফ বলেন, রাজস্ব বোর্ড যে পরিমাণ টিআইএন সার্টিফিকেট থাকার দাবি করে, সেই পরিমাণ রাজস্ব আহরণ হয় না। এমনকি কেউ মারা গেলে সেই সার্টিফিকেট বা নাম্বার কী হবে, সেটির কোনো কার্যকর প্রক্রিয়া নেই। রাজস্ব বোর্ড সেটা কমিটিকে দিতে পারেনি। কীভাবে বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা খাতকে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে তার কোনো সঠিক কাঠামো নেই। তবে ১ কোটি কর দাতা নির্ধারণ করা গেলে রাজস্ব অনেক বাড়ানো সম্ভব।
কমিটির সদস্য ড. তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, অভিবাসনের জন্য মানুষের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়েছে। অভিবাসনের মাধ্যমেও অর্থপাচার হয়েছে।
ড. সেলিম রায়হান বলেন, যেসব খাতে সংস্কার দরকার সেখানে শক্তিশালী উদ্যোগ নিতে হবে।
ড. ইমরান মতিন বলেন, ১০ শতাংশ মানুষের কাছে ৮৫ ভাগ সম্পদ। টোকা দিলে যে দারিদ্র বিমোচন শেষ হয়ে যাবে, সেটিকে কার্যকর উদ্যোগ বলে না। কোনো মানুষ ২ দিন কাজ না করলেই দারিদ্র্যের নিচে চলে আসবে। এতে দারিদ্র্য হার দ্বিগুন হয়ে যাবে।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে যেসব টাকা লোপাট করা হযছে পরবর্তী প্রজন্মের ঘাড়ে সেই বোঝা থেকে গেলো। মেগা প্রকল্পের টাকা পাচার হয়েছে। ড.জাহিদ হোসেন বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে হবে। জবাবদিহিমূলক প্রশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, সরকারি তথ্য-উপাত্তে বড় গলদ আছে।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ বিষয়ে বলেন, ‘৩০ অধ্যায়ের ৪০০ পৃষ্ঠার দীর্ঘ শ্বেতপত্রে উঠে এসেছে কীভাবে ক্রোনি পুঁজিবাদ অলিগার্কদের জন্ম দিয়েছে। কীভাবে তারা নীতি প্রণয়নকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। দেশের ৮৫ শতাংশ সম্পদ ১০ শতাংশ মানুষ ভোগ করছেন বলেও জানান দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল পুরো কাঠামো। এর উৎস ২০১৮ এর নির্বাচন। পরবর্তী সময়ে যে ভোট হয়েছে সেখানে স্বচ্ছতার জায়গা নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকারের জবাবদিহি নষ্ট করা হয়েছে। জাতিসংঘ এখনও মনে করছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট। উন্নয়নশীল দেশ হবার পথে কোনো বাধা নেই। তবে ইতোমধ্যেই মধ্য আয়ের ফাঁদে পড়েছে দেশ।
সুপারিশ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা না গেলে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার কার্যক্রম করা যাবে না। পরবর্তী জাতীয় বাজেট আসার আগে দেশের অর্থনৈতিক সংস্কারে বর্তমান সরকার কী কী উদ্যোগ নেবে সেগুলোকে স্পষ্ট করতে হবে। আরও দায়বদ্ধতা আনতে হবে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এই সরকার পাঁচ বছর দায়িত্বে থাকবে না। তবে অন্তত আগামী দুই বছরের কর্মপরিকল্পনা সামনে থাকতে হবে। তিনি আরও বলেন, সরকারকে মধ্য মেয়াদে এমন পরিকল্পনা দিতে হবে যাতে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, শিক্ষার মান এবং পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠীর জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে। এছাড়া অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঠিক মূল্যায়ন করতে হবে। কেননা সেখানে যে ইচ্চাভিলাসী লক্ষ্য ধরা ছিল এগুলোর দাম কে নেবে তা স্পষ্ট করতে হবে।