আগস্টে ইতিবাচক হলেও সেপ্টেম্বরে সামান্য নেতিবাচক
ডলারের হিসাবে ঘাটতি কমছে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১০ পিএম
দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়ায় সরকারের চলতি হিসাবে ঘাটতি কমতে শুরু করেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা খরচের চেয়ে আয় বেশি হয়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স, বৈদেশিক অনুদান ও বৈদেশিক ঋণের প্রবাহ আগের চেয়ে কিছুটা বাড়ায় এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে ডলারের বাজারে। পাশাপাশি সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার আর্থিক হিসাবেও ঘাটতি কমছে। এর প্রভাবে বাড়ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। সব মিলে বৈদেশিক মুদ্রার সার্বিক স্থিতিতেও ঘাটতি কমতে শুরু করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে চলতি হিসাবে ঘাটতি হয়েছে ১৯ কোটি ডলার, গত অর্থবছরের একই মাসে ঘাটতি হয়েছিল ৩০ কোটি ডলার। ওই সময়ে ঘাটতি কমেছে ১১ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট এই দুই মাসে চলতি হিসাবে কোনো ঘাটতি হয়নি। বরং উদ্বৃত্ত হয়েছে ১১ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে ঘাটতি হয়েছিল ৬১ কোটি ডলার। সেপ্টেম্বরে আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণে চলতি হিসাবে আবার ঘাটতিতে চলে গেছে। এর ফলে জুলাই-সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে ঘাটতি হয়েছে ১৩ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি হয়েছিল ১৮৩ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে ঘাটতি কমেছে ১৭০ কোটি ডলার।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, এ ঘাটতি কমার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৩০ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে তা সাড়ে ৪ শতাংশ কমেছিল। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৫ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে তা বাড়েনি বরং কমেছিল। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে বৈদেশিক ঋণপ্রবাহ বেড়েছে ১২ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে তা কমেছিল ১৭ শতাংশ। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহও কিছুটা বেড়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে এফডিআই বেড়েছিল ২৫ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ২৮ কোটি ডলারের বেশি।
বৈদেশিক অনুদান গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে এসেছিল ৪৮ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ৫১ কোটি ডলার।
বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সব খাতে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা দেওয়ায় সার্বিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বেড়েছে। এর বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করার প্রবণতাও বেড়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি ব্যয় কমেছে প্রায় ১ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি ব্যয় আরও বেশি কমেছিল। এদিকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ বেড়েছে। গত জুলাই-সেপ্টেম্বরে সরকার দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধ করেছে ৩২৪ কোটি ডলার এবং স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধ করেছে ২০০ কোটি ডলারের বেশি। বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ার কারণে খরচ বাড়লেও এ খাতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। ফলে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার আর্থিক হিসাবে ঘাটতিও কমতে শুরু করেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে এ হিসাবে ঘাটতি কমে ১৪ কোটি ডলারে নেমেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এতে ঘাটতি ছিল ১৭০ কোটি ডলার। এ হিসাবে ঘাটতি কমায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়তে শুরু করেছে। গত রোববার নিট রিজার্ভ বেড়ে ২ হাজার ৬ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। একই সময়ে গ্রস রিজার্ভ বেড়ে ২ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি অবস্থান করছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে বৈদেশিক মুদ্রার সার্বিক হিসাবে ঘাটতি ১৪০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে ঘাটতি ছিল ১৭০ কোটি ডলার।
এদিকে ডলারের প্রবাহ বাড়ায় এর দামেও স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। ফলে টাকার মানও স্থিতিশীল রয়েছে। আগে আমদানিতে প্রতি ডলার সর্বোচ্চ ১৩২ টাকা করেও বিক্রি হয়েছে। এখন তা কমে এসেছে। এখন ব্যাংকে আমদানিতে ডলারের দাম সর্বোচ্চ ১২০ টাকা। কোনো কোনো ব্যাংকে এর চেয়ে কম দামেও ডলার মিলছে। ফলে আমদানিতে খরচ কমেছে। এতে এ খাতে কিছুটা স্বস্তি এসেছে। এর মধ্যে আমদানি পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। আগামী বছরে এর দামও আরও কমবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ২০২৬ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম আরও কমে যাবে বলে সংস্থাটির সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আশা করা হচ্ছে আমদানি ব্যয়ের ওপর চাপ আগামীতে আরও কমে গিয়ে আমদানি বাড়বে। গত ২০২০ সালে করোনার সময় থেকে এখন পর্যন্ত বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে আমদানিনির্ভর শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আমদানি বাড়লে এ খাতটি চাঙা হয়ে উঠবে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
টাকার মানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় মূল্যস্ফীতিতে বাড়তি চাপও কমতে শুরু করেছে। ডলার সংকটের কারণে আগে সার্বিক অর্থনীতিতে বৈদেশিক খাত নিয়ে যে দুশ্চিন্তা ছিল, বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়ায় সেই দুশ্চিন্তা কমতে শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে আগামী ডিসেম্বরের স্থগিত বকেয়া বৈদেশিক ঋণের স্থিতি শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। তখন বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ আরও বাড়বে। কারণ ডলারের ওপর বড় চাপের একটি বড় কারণ ছিল স্বল্পমেয়াদি স্থগিত বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ। এছাড়া রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আইএমএফ থেকে বাড়তি ঋণ সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এটি ডিসেম্বরের মধ্যেই পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে ডলারের জোগান আরও বাড়বে।