থমকে গেছে বাফার গুদাম নির্মাণ প্রকল্প
আর্থিক সংকটের মধ্যে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে একের পর এক প্রকল্প। কিন্তু অনুমোদন দিলেও আর্থিক সংকটে সময়মতো এবং চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে পারেনি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। আবার যা বরাদ্দ দেওয়া হয়, ছাড় করা হয়েছিল আরও কম। ফলে কাজ আটকে গিয়ে বাস্তবায়নের গতি নেই ৪টি উন্নয়ন প্রকল্পে। এসব এখন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ৬৬৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এখন পর্যন্ত প্রকল্পগুলোর আওতায় খরচ হয়েছে ৪ হাজার ৭ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত এগুলোর মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। এ অবস্থায় শত শত কোটি টাকা গচ্চার শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ পেলে প্রকল্পের কাজ অনেক দূর এগিয়ে যেত। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রে যা চাহিদা তার অর্ধেক অর্থও পাওয়া যায়নি। ইতোমধ্যেই পণ্যের দাম বাড়ায় বিভিন্ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে ঠিকাদাররাও কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করছেন। এ অবস্থায় ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী এর আগে যুগান্তরকে বলেছিলেন, যদি সময়মতো প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হতো তাহলে হয়তো সংশোধনের প্রয়োজন হতো না। স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, টাইম ওভার রান হলে অবশ্যই কস্ট ওভার রান হবেই। অর্থাৎ সাধারণত প্রকল্পের সময় বাড়লে খরচ বাড়বেই।
প্রকল্পগুলো হলো- সার সংরক্ষণ ও বিতরণের সুবিধার্থে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৩৪টি বাফার গুদাম নির্মাণ, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন, কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ (দ্বিতীয় পর্যায়) এবং ডিজিটাল কানেকটিভিটি শক্তিশালীকরণে সুইচিং ও ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্প।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, নানা কারণে এসব প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া যায়নি। এর মধ্যে বৈশ্বিক কারণে তৈরি সংকটের প্রভাব রয়েছে। পাশাপাশি গত অর্থবছর ৩৫৩টি উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ করা হয়। এসব প্রকল্পের কাজ ৮০ ভাগের ওপরে থাকায় চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ নিশ্চিত করা হয়েছে। ফলে ধীরগতির কিছু প্রকল্পে কম বরাদ্দ দেওয়া হয়। পাশাপাশি ডলার সংকট ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক প্রকল্পের মালামাল ক্রয় করতে দেরি হয়েছে। এমনো দেখা গেছে যে, শুধু লিফট আমদানি করতে না পারায় প্রকল্পের গতি থমকে গেছে। এ রকম নানা কারণ আছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাধারণত মেয়াদ বাড়ছে ব্যয় বাড়ার শঙ্কা তো থাকেই। তবে কোনো প্রকল্পের ক্ষেত্রে আবার ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াও মেয়াদ বাড়তে পারে।
আইএমইডি সূত্র জানায়, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু সেটি না হওয়ায় ২ বছর বাড়িয়ে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের মূল ব্যয় ছিল ৬ হাজার ৪৭৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। পরে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ৬ হাজার ৫২৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) অনুযায়ী অর্থছাড় হয়নি। সেই সঙ্গে চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দও মেলেনি। এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পের আওতায় ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৫২ দশমিক ৩০ শতাংশ। এছাড়া ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৫২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ৪ অর্থবছরে পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়নি। এর মূল কারণ হিসাবে জানা গেছে, এটি ‘বি’ ক্যাটাগরিভুক্ত ছিল (আর্থিক সংকটের কারণে অর্থ মন্ত্রণালয় এর আগে সব প্রকল্পকে এ, বি ও সি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছিল)। ফলে বরাদ্দ অনেক কম দেওয়া হয়।
এছাড়া কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু গত এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৬৬ দশমিক ১৭ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় মোট ব্যয় ধরা হয় ৫৩১ কোটি টাকা। এর বিপরীতে এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১৮৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৩৫ দশমিক ১২ শতাংশ। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে ডিপিপিতে বরাদ্দ ছিল ২১৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। কিন্তু ছাড় হয়েছে ১ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশ। এছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২১০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, এর বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ৫৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এটি মোট বরাদ্দের ২৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৯৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা, খরচ হয়েছে ৭৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। যা মোট বরাদ্দের ৮০ দশমিক ০৫ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৯৭ কোটি টাকা, ব্যয় হয় ৫১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। যা মোট বরাদ্দের ৫৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ। হিসাব করে দেখা যায় প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন অর্থবছরে বরাদ্দ পাওয়া যায় ৬২২ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ছাড় হয়েছে ২০৫ কোটি ৯১ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৩৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
ডিজিটাল কানেকটিভিটি শক্তিশালীকরণে সুইচিং ও ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্পটি ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু পরে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। এটি বাস্তবায়নে মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ১৫৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। পরে কিছুটা কমিয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এপ্রিল পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৮৫ কোটি ৬ লখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৬৮ দশমিক ৯২ শতাংশ। আইএমইডি বলেছে, অবশিষ্ট ৮ মাসে ৩৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বা ৩১ দশমিক ০৮ শতাংশ বাস্তবায়ন কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ৬ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের মধ্যে ব্যাপক ফারাক রয়েছে।
এদিকে ৩৪টি বাফার গুদাম নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১৮ থেকে ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা। এটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৪৮২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। গত মে মাস পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩২২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এছাড়া প্রায় সাড়ে ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৩৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ প্রকল্পের সংশোধিত ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) প্রক্রিয়াধীন থাকায় কোনো অর্থ বরাদ্দ ও ছাড় হয়নি। এছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্যে ছাড় করা হয় মাত্র ১৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। কিন্তু সেই অর্থও খরচ হয়নি। এ প্রকল্পের দরপত্রসহ প্রাথমিক কার্যক্রম চলছে। কিন্তু ৩৪টি বাফার গুদামের নির্মাণ কাজ এখনো শুরুই করা যায়নি।